Biography-জীবনী

আমেলি এম্মি নোথার – কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমেলি এম্মি নোথারের (Emily Emmy Noether)জন্ম ১৮৮২ সালে এরলাঙ্গেলে। এই এলাকাটি জার্মানির বাভারিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। বাবা ম্যাক্স নোথার এরলাঙ্গেলে অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন। জন্মসুত্রে তিনি ছিলেন ইহুদি।

শিক্ষিত পরিবারে এম্মি নোথারের জন্ম হলেও শিক্ষা গ্রহণে এবং পরবর্তিকালে শিক্ষাদানে আমেলি এম্মি নোথারকে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছিল। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য কোথাও ভর্তি হতে পাড়লেন না। কারণ সে সময় এরলাঙ্গেনে মেয়েদের কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। ফলে তাঁকে নৃত্য ও সঙ্গীত চর্চায় মনোনিবেশ করে সন্তুষ্ট থাকতে হল।

১৯০৪ সালে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের উপর আরোপিত বিধিনিষেধ সরকার তুলে নেন। কালবিলম্ব না করে নোথার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাবার ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে বিষয় হিসাবে তিনি গণিতশাস্ত্রকেই বেছে নেন।

যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে তিনি বিশিষ্ট গণিতবিদ পল গর্ডনের অধীনে গবেষণা শুরু করেন এবং যথাসময়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এবার চাকরি খোঁজার পালা। আবারও হোঁচট খাবার পালা। বহু দরজায় ঘুরেও একটি উপযুক্ত চাকরি জোগার করতে পারলেন না। অপরাধ, তিনি মেয়ে, তার উপর ইহুদি।

হিটলার তখনও ক্ষমতায় আসেননি ঠিকই, তবে এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে ইহুদি বিদ্বেষ তখনও ছিল। অবশেষে ১৯১৫ সালে তিনি গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পেলেন। সেখানে গিয়েও আমেলি প্রথমে যথপোযুক্ত সম্মান পেলেন না। গবেষণার সুযোগসুবিধা দেওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্লাস তাকে নিতে দেওয়া হত না। এখানেও অজুহাত ওই একই- তিনি মহিলা।

এম্মি নোথারের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই অবিচারের কথা জানতে পেরে তাঁরই দুই সহকর্মী প্রখ্যাত গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট (David Hilbert) এবং ফেলিক্স ক্লাইন (Felix Klein) প্রতিবাদ করেন। ফলে তাঁকে ক্লাস দেওয়া শুরু হয়।

আমেলি এম্মি নোথার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার কিছুদিন পরে আইনস্টাইন সেখানে আসেন তাঁর নতুন গবেষণার বিষয় ‘আপেক্ষিকতাবাদ’ নিয়ে একগুচ্ছ বক্তৃতা দেবার জন্য। গবেষণার কাজ তখনও শেষ হয় নি। “এনার্জি কনজারভেশন ল”-কে কেন্দ্র করে তখনও কিছু সমস্যা ছিল। একথা তিনি হিলবার্ট-কে জানান। হিলবার্ট আইনস্টাইনের এই সমস্যার কথা এম্মি নোথার-কে বলেন এবং অনুরোধ করেন সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করতে।

হিলবার্টের অনুরোধ তিনি এড়িয়ে যেতে পারলেন না। তাঁর দুঃসময়ে এই গণিতবিদ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সে কথা তিনি ভোলেন নি। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু না হওয়া সত্ত্বেও তিনি “এনার্জি কনজারভেশন ল”-কে কেন্দ্র করে উদ্ভুত সমস্যা নয়ে মাথা ঘামাতে লাগলেন। অচিরেই তিনি এই বিষয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধগুলি পড়ে আইনস্টাইন নোথার এবং তাঁর প্রবন্ধগুলি সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করে হিলবার্ট-কে একটি চিঠি লেখেন।

হিলবার্টের দেওয়া গুরু দায়িত্ব নোথার যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। আর তা করতে গিয়ে এক নতুন তত্ত্বের সন্ধান দেন যা পদার্থবিজ্ঞানে ‘নোথারের থিওরেম’ (Noether’s Theorem) নামে পরিচিত হয়ে আছে।

এম্মি নোথারের গবেষণার বিষয় ছিল ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যালজেব্রা’ (Abstract Algebra)। গণিতের এই শাখায় তাঁর অবদান তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। দূর দূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা এবং গবেষকরা তাঁর কাছে আসতেন গণিতের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। শোনা যায়, বিশিষ্ট পদার্থবিদ এনরিকো ফারমি গটিংগেনে থাকাকালীন সুযোগ পেলেই নোথারের গণিতের ক্লাসে ঢুকে পড়তেন বক্তৃতা শোনার জন্য।

১৯৩৩ সালে জার্মানির শাসন ক্ষমতায় এসেই হিটলার ঘোষনা করেন যে জার্মানির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদিরা শিক্ষকতা করতে পারবেনা। ফলে এম্মি নোথারের চাকরি যায়। শুধু তাই নয়, জার্মানিতে থাকাটাও তখন আতঙ্কের।

ইহুদিদের প্রতি হিটলার কখন কী করে বসবে ঠিক নেই। তাই নোথার ঠিক করলেন, দেশ ত্যাগ করবেন। কিন্তু যাবেন কোথায়? ইউরোপের প্রায় সব দেশই তখন হিটলারের আক্রমনের ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার বিখ্যাত কলেজ ‘ব্রায়ান মাওয়ার’ (Bryn Mawr College) থেকে তাঁর কাছে অনুরোধ আসে সেখানে যোগদানের জন্য। দ্বিতীয়বার আর ভাবেন নি। চলে এলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৩৪ সালের শেষের দিকে অসুখ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। এই সময়ে অবিবাহিত এম্মি নোথারের পাঁশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর সহকর্মীরা এবং ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু সকলের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৯৩৫ সালের ১৪ এপ্রিল তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

আধুনিক অ্যাবস্ট্রাক্ট অ্যালজেবরায় আমেলি এম্মি নোথারের অবদান গণিতের ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে।