Engineering & Technology-প্রজুক্তি ও প্রকৌশলEnvironment-পরিবেশ

মহাকাশ ভিত্তিক সৌরশক্তি কি পারবে পৃথিবীর চাহিদা মেটাতে?

লিখেছেন - ঐন্দ্রিলা সাউ

বর্তমানে সমগ্র বিশ্বব্যপী চিরাচরিত জীবাশ্ম জ্বালানির (কয়লা, পেট্রোলিয়াম) চরম সঙ্কটের কথা কারোর অজানা নয়। উপরন্তু পরিবেশ দূষণের হাত থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্যও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার আজকাল খুবই জনপ্রিয়। এই শক্তির মধ্যে সৌরশক্তির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। তবে এই সৌরশক্তির ব্যবহারের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সর্বপ্রথম সমস্যা হল এই শক্তি উৎপাদনের বিপুল ব্যয়; তবে বেশ কিছু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা এর ব্যয়ভার অনেকটাই সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তির এত উন্নতিসাধন সত্ত্বেও কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা মেটেনি। যেমন- সৌরবিদ্যুৎ উৎপন্নকারী সোলার প্যানেল শুধুমাত্র সূর্যালোকের উপস্থিতিতেই সক্রিয় হয়, রাতের বেলায় এটি কাজ করেনা। শুধু তাই নয়, মেঘলা আবহাওয়াতেও এই একই সমস্যা দেখা দেয়, ফলে শক্তি আহরণে ছেদ পড়ে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের নতুন এক উদ্ভাবনী- Space-based Solar Panel (SBSP) বা মহাকাশ ভিত্তিক সৌরশক্তি  সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং সমগ্র বিশ্বে চিরকালের মত জ্বালানি সঙ্কটের মত এক মারাত্মক সমস্যার অন্ত ঘটাতে পারে।

Space-based Solar Panel (SBSP) বা মহাকাশ ভিত্তিক সৌরশক্তি আসলে কি?

Space based solar power(SBSP) হল বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্কপ্রসূত এক উদ্ভাবনী ধারণা যা বিশ্বে শক্তি ব্যবহারের চিত্রটা বদলে দিতে পারে এক নিমেষে।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী সৌরশক্তি পৃথিবীর মাটিতে সোলার প্যানেলের সাহায্যে বন্দি না করে তা মহাকাশে অবস্থিত কোনও space station-এ photovoltaic cell এর সাহায্যে সম্পন্ন করা হয়। সৌরশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠে আসার সময়ে প্রায় ৫৫-৬০% মেঘ, ধুলিকণা, গ্যাস প্রভৃতির দ্বারা শোষিত হয়ে যায়।

কিন্তু যদি মহাকাশে এই পদ্ধতি সম্পন্ন করা যায় তবে সৌরশক্তির সম্পূর্ণ অংশই বন্দি করা সম্ভব হবে এবং space station টি কোনও উচ্চকক্ষে অবস্থান করলে ২৪ ঘণ্টাই সৌরালোক পেতে পারবে।

এই সৌরশক্তিকে প্রথমে microwave এ রূপান্তরিত করা হয় কারণ এই তরঙ্গ সরলরেখায় চলতে পারে ও ঘন মেঘের আবরণ ভেদ করে সহজেই যেতে পারে কোনও পরিবাহী ছাড়াই। তাই শূন্যস্থান থেকে সম্পূর্ণ পরিবাহীহীন ব্যবস্থায় এই তরঙ্গ পৃথিবীতে পাঠানো হয় এবং সেখানে অবস্থিত বিভিন্ন receiver antenna এই microwave কে গ্রহণ করে তাকে বিদ্যুৎশক্তিতে পরিণত করে।

এই পদ্ধতিতে এক বিপুল পরিমাণ সৌরশক্তি পাওয়া যায় যা ২৪ ঘণ্টাই উৎপন্ন সম্ভব এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে এর উৎপাদনে কোনোরকম ব্যাঘাত ঘটে না, যা এক বিরাট সাফল্য। কিন্তু এই ব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত বাজারজাত করা সম্ভব হয়নি, পরীক্ষাস্তরেই আটকে আছে।

Space-based Solar Panel (SBSP) বা মহাকাশ ভিত্তিক সৌরশক্তি পদ্ধতিকে কার্যকরী করতে কি কি চিন্তাভাবনা করছেন বিজ্ঞানীরা?

SBSP-এর ধারণা বহু বছর আগেই উদ্ভূত হয়েছিল তবে সেই কর্মকাণ্ডে গতি আসে যখন ইউরোপ ২০৫০ সালের মধ্যে ‘কার্বনমুক্ত বিশ্ব’ গড়ার তোড়জোড় শুরু করে। বিশুদ্ধ ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির নতুন নতুন উৎস ও তাদের বিপুলভাবে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখনই নতুনভাবে এই প্রকল্পের উপর কাজ শুরু হয়। এই কাজে আরও গতির সঞ্চার হয় যখন এই সৌরশক্তি ব্যবহারের খরচ ক্রমশঃ কমতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, photovolataic(PV) solar cell-এর কার্য্যক্ষমতাও প্রায় ২৫% বেড়ে গেছে বিগত দশকের তুলনায়। Microwave-এর transmitter ও receiver গুলির প্রযুক্তিতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন।

মহাকাশে অবস্থিত satellite গুলির রক্ষণাবেক্ষণে বর্তমানে রোবট ব্যবহার শুরু হয়েছে যা এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নতির দিকে এগিয়ে দিয়েছে। এই পদ্ধতিতে যেহেতু কোনও পরিবাহী ছাড়াই শক্তির স্থানান্তর সম্ভব, তাই শুধু পৃথিবীতে নয়, চাঁদে বা অন্যান্য যেকোনো গ্রহে এই পদ্ধতিতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

Space-based Solar Panel (SBSP) বা মহাকাশ ভিত্তিক সৌরশক্তি পদ্ধতি এখনো পর্যন্ত কার্যকর না হওয়ার কারণ কি?

এই পদ্ধতিতে নতুন কোনও প্রযুক্তির দরকার নেই- বর্তমানে বিভিন্ন satellite-এর মাধ্যমে যেমন TV signal পাওয়া যায় বা ইন্টারনেটের মাধ্যেমে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, সেই একই প্রযুক্তির ব্যবহার হয় এক্ষেত্রেও, শুধুমাত্র আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে। কিন্তু এই পদ্ধতি বাজারজাত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল যে যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহৃত হবে, তা হতে হবে বিশালাকৃতির।

একটা সৌরশক্তির satellite যা মহাকাশে স্থাপন করা হবে, তার ব্যাস হতে পারে ১ কিমিরও বেশি। সমানতালে পৃথিবীতে তার যে receiver station থাকবে তার আকার, এর ১০ গুনেরও বেশি হতে হবে। স্বভাবতই মহাকাশে বা পৃথিবীতে কয়েক হাজার টন ওজনের এই ধরণের একগুচ্ছ satellite নির্মাণের জন্য চাই প্রচুর ফাঁকা জায়গা এবং খরচসাপেক্ষও বটে। যদিও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির কারণে খরচে অনেকটাই লাগাম দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

পরিকল্পনামাফিক একটি solar power satellite থেকে প্রায় ২ গিগাওয়াট শক্তি উৎপাদন সম্ভব যা সমপরিমাণ নিউক্লীয় শক্তির সমতুল্য এবং প্রায় ১ মিলিয়ন বাড়িকে আলোকিত করতে সক্ষম। এই পরিমাণ শক্তি পুরনো পদ্ধতিতে উৎপাদন করতে চাইলে প্রায় ৬ মিলিয়ন solar panel লাগবে। SBSP পদ্ধতিতে উৎপন্ন সৌরশক্তি যেহেতু কয়েক কিমি ধরে বিস্তৃত থাকবে তাই এটি যেকোনো বিমান, পাখি বা মানুষের ক্ষতি করেনা ও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী নয়।

এই অভিনব পদ্ধতিকে ভবিষ্যতের হাতিয়ার বানাতে সর্বপ্রথম ইউরোপ এগিয়ে আসে। European Space Agency (ESA) সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলক প্রকল্পের সূচনা করে যার নাম ‘Solaris’। NASA-এর বিজ্ঞানীরাও নানা এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে দিয়েছেন। চীন, জাপান, নিউ ইয়র্ক সহ বহু দেশ এগিয়ে এসেছে এই বিষয়ের উপর গবেষণা করতে। ফলে এতকাল কল্পবিজ্ঞানের একটি অংশ হিসাবে যে SBSP পদ্ধতিকে ভাবা হত, তা খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবে ফলপ্রসূ হতে চলেছে। আগামী দিনে এই পদ্ধতিতে উৎপন্ন সৌরশক্তি সমগ্র বিশ্বের জ্বালানির চাহিদা খুব সহজেই মেটাতে পারবে। বিজ্ঞানীদের আশা আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ‘কার্বনমুক্ত বিশ্ব’ গড়ার যে স্বপ্ন তাঁরা দেখছেন তা অচিরেই সত্যি হবে Space based solar power-এর হাত ধরে।