বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী চঞ্চল কুমার মজুমদার
বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী চঞ্চল কুমার মজুমদার
সায়ন দাশ
উনবিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হলেন চঞ্চল কুমার মজুমদার । তিনি একজন ঘনপদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক ভারতীয় বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি বিখ্যাত গবেষক দীপন ঘোষের পরামর্শক ছিলেন, যার সঙ্গে তিনি হাইজেনবার্গের মডেলের বিস্তৃতির উপর গবেষণা করে মজুমদার-ঘোষ মডেলটি গড়ে তোলেন। এছাড়াও তিনি নোবেল বিজয়ী ওয়াল্টার কোন এবং মারিয়া গোপারপার-মায়ারের সহকর্মীও ছিলেন। তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসু জাতীয় মৌলিক বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। চঞ্চল কুমার মজুমদার কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের উপর গবেষণার জন্য তিনটি প্রধান ভারতীয় বিজ্ঞান পরিষদ যথা- ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমী, ন্যাশনাল একাডেমী অফ সায়েন্সেস এবং ভারতীয় বিজ্ঞান একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন।
জন্ম ও বাল্যকাল
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতে বাংলার বর্তমান নদিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন চঞ্চল কুমার মজুমদার। পিতা নির্লয় কান্তি মজুমদার ও মাতা সীতাদেবীর তিন পুত্রের এক জন হলেন চঞ্চল কুমার মজুমদার। তার দুই ভাই উজ্জ্বল ও মুকুল মজুমদার পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন।
শিক্ষা ও অধ্যয়ন
তিনি কৃষ্ণনগরের সিএমএস সেন্ট জনস উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে তার প্রাথমিক কলেজ শিক্ষা সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষা সর্ব স্তরে তিনি নিজেকে একজন কৃতি ছাত্র রূপে প্রমাণ করেন ।
কর্মজীবন
১৯৬০-৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের স্নাতকোত্তর গবেষণায় অংশ নেওয়ার পর তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান দিয়েগোতে নথিভুক্ত হন এবং ওয়াল্টার কোনের পরীক্ষাগারে কাজ করেন, যিনি ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রসায়ন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।
ওয়াল্টার কোন ছিলেন তার থিসিস সুপারভাইজার। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী মারিয়া গ্যোপের্ট-মায়ারের তত্ত্বাবধানে ডক্টর মজুমদার ”দ্য এফেক্ট অফ ইন্টারেকশনস্ অন পজিট্রন অ্যানাইহিলেশন” বিষয়ে গবেষণা করেন এবং ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ডক্টর ওয়াল্টার কোনের সঙ্গে গবেষণা করার সময় কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় (সেইসময় কার্নেগী ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি) থেকে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে ফিরে আসার পর মজুমদার টাটা মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। এরপর তিনি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হন।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স এবং টেকনোলজি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এ পদার্থবিজ্ঞান এর অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কর্মকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান এর পরীক্ষাগার গুলির আধুনিকীকরণ ও তার বাস্তবায়ন দিকে তিনি বিশেষ মনোযোগ দেন।
আইএসিএসের প্যালিট ল্যাবরেটরি এবং ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারে তার গবেষণাকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধিদপ্তর সত্যেন্দ্রনাথ বসু জাতীয় মৌলিক বিজ্ঞান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় । তিনি ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এসএনবিএনএনবিএস এর প্রথম ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হন।এসএনবিএনবিবিএস-এ এক দশক ধরে নিযুক্ত থাকার পর, তিনি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন।
গবেষণার পাশাপাশি তিনি ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ফিজিক্স এর সম্পাদক ছিলেন । ১৯৮৮ – ১৯৯০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি ও ১৯৯৯ – ২০০০ সাল অবধি ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স এর সভাপতি নিযুক্ত থাকেন। এছাড়াও তিনি রমন সেন্টার ফর অ্যাপ্লাইড অ্যান্ড ইন্টারডিসিপ্লিনারী সাইন্স এর একজন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল মেম্বার হিসেবে ও তিনি নিযুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নিযুক্ত ছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর কপরেশন উইথ ইউনেস্কো।
গবেষণা ও উপলব্ধি
১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে ওয়াল্টার কোনের সঙ্গে কর্মকালে ডক্টর মজুমদারের জীবনেরমোড় ঘুরে যায়। অস্ট্রীয় বংশদ্ভুত আমেরিকান বিজ্ঞানী কোন সেইসময়ে লুটিংগার-কোহেন মডেলের জন্য বৈজ্ঞানিক জগতে পরিচিত হয়েছিলেন (পরে তিনি রসায়নে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ডক্টর মজুমদারের সঙ্গে তার সহযোগিতার ফলস্বরূপহ হিসেবে মজুমদার-কোন তত্ত্ব উদ্ভাবন ঘটে, যা ফের্মি গ্যাসের আবদ্ধ ও অনাবদ্ধ অবস্থার ধারাবাহিকতা ব্যাখ্যা করে।তারা ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ফিজিকাল রিভিউ প্রকাশিত প্রবন্ধে ফের্মি গ্যাসের আবদ্ধ ও অনাবদ্ধ অবস্থার ধারাবাহিকতার বর্ণনা দেন।
পরে, টিআইএফআর-এ তার দিনগুলিতে, ডক্টর মজুমদার ম্যাগনেটিক হ্যামিল্টনী বিষয়ে পিএইচডি গাইড হিসেবে দীপন ঘোষকে সহযোগিতা করেন।তারা সংগবদ্ধভাবে হাইজেনবার্গ মডেলের সম্প্রসারণ মজুমদার-ঘোষ মডেলটি তৈরি করেন, যা পরস্পর ঘূর্ণনযুক্ত দুটি জটিল ল্যাটিস যুক্ত হওয়া এবং দ্বিতীয় প্রতিবেশী জোড়টির প্রথমটির সাপেক্ষে অর্ধেক শক্তিশালী হওয়াকে ব্যাক্ষা করে।মডেলটি তারা তাদের বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ ”অন নেক্সট‐নেয়ারেস্ট‐নেইবার ইন্টারঅ্যাকশন ইন লিনিয়ার চেন”-এ ব্যাখ্যা করেন, যা ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে জার্নাল অফ ম্যাথমেটিকাল ফিসিক্স পত্রিকায় প্রকাশিত।
এক বছর পরে, ডক্টর মজুমদার স্যামুয়েল এডওয়ার্ডসের সঙ্গে গ্লাস সিস্টেমগুলির non-Debye stress relaxation-এ কাজ করেন, যার ফলে একটি উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তারপরে, তিনি কার্যকর চুম্বক ভ্রামক এবং ভৌত অবস্থার পরিমাণ, যেমন- হেইসেনবার্গের চেইনগুলির নির্দিষ্ট তাপ গণনা করার পদ্ধতিগুলি উন্নত করেছিলেন।
ডক্টর মজুমদার সীমাবদ্ধ চৌম্বকীয় স্তরগুলি গবেষণার জন্য বিক্ষেপণ তত্ত্বের কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। তার গবেষণার ফলাফলগুলি পরীক্ষামূলকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়েছে। তিনি সোডা-লাইম গ্লাসে মাইকেল. আর. ডগলাস এবং স্যাম এডওয়ার্ডসের কাজটি সংশোধন করেছিলেন এবং সময়-নির্ভর পীড়ন শিথিলকরণের একটি সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তার অন্য কয়েকটি কাজের মধ্যে লেনার্ড-জোন্স গ্যাসের সংকট আইসোথার্ম গণনা, আয়রন (II) এবং আয়রন(III) অনুপাতের Mössbauer প্রভাব দৃঢ়ীকরণ, গ্যাস-তরল পর্যায় সংক্রমণের সমালোচনামূলক পরামিতিগুলি নির্ণয়, ফেরোম্যাগনেটিক মডেলিং এবং ধাতুর ফার্মি শক্তির পরিমাপ করার তাত্ত্বিক পদ্ধতির উন্নয়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তার গবেষণায় অনেকগুলি নিবন্ধের মাধ্যমে নথিবদ্ধ করা হয়েছে এবং ভারতীয় বিজ্ঞান একাডেমীর নিবন্ধের সংগ্রহস্থলে তার ৪৫টি গবেষণা তালিকাভুক্ত করেছে।ডক্টর মজুমদার Annihilation of Positrons in Metals এবং S N Bose: The Man and His Work নামে দুটি উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশ করেন। শিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে ডক্টর মজুমদার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগার আধুনিকীকরণে সহায়ক ছিলেন।
তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন এছাড়াও তিনি পদার্থবিজ্ঞানের ইন্দো-মার্কিন উপকমিশনের সদস্য ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান প্যানেলের গ্রান্টস কমিশনের এবং পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের বৈজ্ঞানিক পদার্থবিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা পরিষদের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
পুরস্কার ও প্রাপ্তি
বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল ডক্টর মজুমদারকে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় বিজ্ঞান পুরস্কারের সর্বোচ্চ পুরস্কার শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার প্রদান করে।একই বছর, তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত হন এবং এশিয়াটিক সোসাইটির এম.সাহা পদক লাভ করেন এবং একই বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দ্বারা জাতীয় লেকচারার হিসাবে নির্বাচিত হন।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্ডিয়ান ফিজিক্স অ্যাসোসিয়েশনের পি.এ.পান্ডা পুরস্কার পান। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমী (আইএনএসএ) তাকে ফেলো হিসাবে নির্বাচিত করে এবং ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ইউজিসি তাকে আবার তাত্ত্বিক বিজ্ঞান গবেষণার জন্য মেঘনাথ সাহা পুরস্কার দিয়েছিল।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সত্যেন্দ্রনাথ বসু পদক লাভের মাধ্যমে তিনি আইএনএসএ থেকে আরেকটি সম্মান লাভ করেন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি ফেলো নির্বাচিত হন এবং ভারতীয় বিজ্ঞান সমিতির শান্তনু ঘোষ স্মৃতি সভায় বক্তিতা প্রদান করেন। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস সংস্থার তাকে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সত্যেন্দ্রনাথ বসু জন্ম শাশ্বত পুরস্কার প্রদান করে। তিনি ভারতের জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমী, ইন্ডিয়ান ফিজিকাল সোসাইটি এবং নিউইয়র্ক একাডেমী অফ সায়েন্সেসের সহকর্মী ছিলেন।
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স তার সম্মাননায় বার্ষিক ভাষ্য, সি, কে. মজুমদার মেমোরিয়াল লেকচার প্রতিষ্ঠা করে। বক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম মাইকেল বেরি, ডেভিড লোগান, পিটার লিটলউড, নরসীমাইহেনগার মুকুন্দা, জৈনেন্দ্র কে. জৈন এবং ড্যানিয়েল আই. খোমস্কি।
অবসান ও অমরত্ব
২০০০ খ্রিস্টাব্দে ২০ জুন হ্রদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬১ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর বছর ফিজিক্স লেটারস বি একটি সংখ্যা তার উপর ফেস্টিফ্রিফ্ট হিসাবে প্রকাশিত করেছিল।তার ৬০তম জন্মদিন স্মরণে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে এস.এন. বোস সেন্টারে পরিসাংখ্যিক পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কিত, স্ট্যাটফিস – কলকাতা ৩ নামে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।তার মৃত্যুর এক বছর পরে, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট তার স্মরণে শ্রদ্ধা জানাতে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত ইলেকট্রন সিস্টেমের উপর একটি কর্মশালা আয়োজন করেছিল।