Chemistry-রসায়নEngineering & Technology-প্রজুক্তি ও প্রকৌশল

প্রকৌশলের অন্দরমহলে রান্নাঘরেও পড়েছে নভোবিজ্ঞানের প্রভাব! – সুজিতকুমার নাহা

কৃত্তিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের ‘চাকরি’ যে রীতিমতো ‘টাফ্ জব’ তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। প্রথমে দিই উষ্ণতার প্রচণ্ড হেরফেরের বিবরণ। তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা বিহনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (international space station) সূর্য-দেখা (sun facing) দিকে 121 ডিগ্রি সেলসিয়াসের গনগনে (নাকি ‘ফুটন্ত’) উষ্ণতা আর অন্ধকার দিকে মাইনাস 157 ডিগ্রি সেলসিয়াসের অকল্পনীয় শৈত্য বিরাজ করত। অত্যল্প অভিকর্ষ (micro-gravity) ও প্রায়-নির্বাত (near vacuum) পরিবেশের চরমতার সাথে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো রয়েছে মহাকাশে বিচরণকারী ধ্বংসপ্রাপ্ত বা বাতিল স্যাটেলাইট গোছের বস্তুপুঞ্জের (সংক্ষেপে, মহাকাশ জঞ্জাল বা space debris) সাথে ঘষাঘষির আশঙ্কা ! এমতাবস্থায় মহাকাশযানের বর্হিদেশ কাঠিন্যের বর্মে মুড়ে ফেলতে পারলেই নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রশ্ন উঠবে, ‘কাঠিন্য’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে ? এবার আমরা এই জিজ্ঞাসারই উত্তর জানতে চেষ্টা করব।

কাঠিন্যের সন্ধানে

আসুন শুরুতেই বস্তুর কাঠিন্য (hardness) বলতে কী বোঝায় সেটা জেনে নিই। দুটি বস্তু ঘষাঘষি করলে কে কার গায়ে আঁচড় (scratch) কাটবে সেটা কিসের ওপর নির্ভর করে ? বস্তুর কোন্‌ গুণ জানা থাকলে দুটি জিনিস ঘষাঘষি না করেই বলে দেওয়া যাবে দাগকাটার ব্যাপারে কে কাকে টেক্কা দেবে ? আসলে, যে বস্তুর পৃষ্ঠতল ভেদ করা যত সহজ, সেই বস্তুতে দাগকাটাও তত সহজ। মজার কথা, বস্তুর শক্ততার এখানে কোনো ভূমিকা নেই। ইস্পাত কাচের চেয়ে শক্ত কিন্তু ইস্পাতের ছুরি দিয়ে কাচে দাগ কাটা যায় না অথচ কাচের ছুঁচোলো টুকরো ব্যবহার করে ইস্পাতে আঁচড় কাটা সম্ভব।

রুশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা অনেক চেষ্টা-চরিত্তির করে অ্যালুমিনিয়াম জিনিসপত্রের ওপরে অত্যন্ত কঠিন একটি অতিসূক্ষ্ম স্তর সৃষ্টি করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন সক্ষম হয়েছিলেন। তড়িৎ বিশ্লেষণের (electrolysis) নিপুণ ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত উপযোগের ফলশ্রুতিতেই এসেছিল এই আশ্চর্য সাফল্য।

পদ্ধতিটার নামটা বেশ গালভরা, ‘হার্ড অ্যানোডাইজিং’। শব্দবন্ধটির কোনো পরিভাষা নেই তাই চলুন আজ আমরাই এটা তৈরি করে ফেলি : ‘ধনাত্মক তড়িৎদ্বার-জনিত কঠিনীকরণ’। সহজ কথায়, হিমাঙ্কের চেয়ে কম উষ্ণতায় লঘু সালফিউরিক অ্যাসিড বাহে (sulphuric acid bath) বিশুদ্ধ (virgin) অ্যালুমিনিয়ামকে ধনাত্মক তড়িৎদ্বাররূপে ব্যবহার করে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতির সাহায্যে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের (Al2O3) কঠিন, পাতলা আস্তর বানানোই ‘ধনাত্মক তড়িৎদ্বার-জনিত কঠিনীকরণ’।

মহাকাশযানের ‘বর্মের’ রঁসুইঘরে প্রবেশ

রন্ধনপাত্র নির্মাতারা মহাকাশযানের ‘বর্ম’-কে আমদানি করে বানিয়ে ফেলেছেন ধনাত্মক তড়িৎদ্বার-জনিত কাঠিন্যযুক্ত রন্ধনপাত্র (hard anodized cookware)। অ্যালুমিনিয়াম রন্ধনপাত্র টমেটো, ভিনিগার, তেঁতুল ইত্যাদি খাদ্যাম্লের (food acid) ‘আক্রমণে’ পর্যুদস্ত হয়ে খাদ্যে কিয়ৎ পরিমাণে অনুপ্রবেশ করতে পারে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে শরীরে। কিন্তু অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের আস্তরওলা ‘হার্ড অ্যানোডাইজড’ রন্ধনপাত্রে এই অশান্তি নেই।

অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের আস্তরটির (সাধারণত 60 মাইক্রন, অর্থাৎ 0.06 মিলিমিটার পুরু) কাঠিন্য স্টেনলেস স্টিলের কাঠিন্যের চেয়ে শতকরা 30 ভাগ বেশি। অতএব এই পাত্রে রান্নার সময় স্টিলের হাতা খুন্তি সানন্দে ব্যবহার করতে পারবেন, পাত্রে আঁচড় পড়ার ভয় রহিত হয়ে ! স্টেনলেস স্টিলের পাত্রের মতো আস্তরটি অতীব মসৃণ হওয়ায় হার্ড অ্যানোডাইজড অ্যালুমিনিয়াম রন্ধনপাত্র ‘স্টিক রেজিসট্যান্ট’ হলেও পুরোপুরি ‘নন স্টিক’ নয়। তবে টেফলন প্রলেপিত ‘নন স্টিক’ রন্ধনপাত্রের অসুবিধেগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেতে হার্ড অ্যানোডাইজড অ্যালুমিনিয়াম রন্ধনপাত্রের কথা ভাবা যেতেই পারে !