Environment-পরিবেশ

চড়াই কেন ডাকে না – কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

এক সময় ওদের অনেক দেখা যেত। বাড়ির উঠোনে ঘুরে বেড়াত, খুটে খুটে খাবার খেত, আর ‘কিচির-মিচির’ শব্দে একে অপরকে ডাকত। হ্যাঁ আমি চড়াই পাখির কথা বলছি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। মানুষের সঙ্গ এদের খুব প্রিয়। তাই বাড়ির আশেপাশে, উঠোনে এদের প্রায়শই দেখা যেত। লক্ষ করেছেন কি এই ছোট্ট পাখিটাকে এখন আর তেমন দেখা যায় না— বিশেষ করে শহরাঞ্চলে? কলকাতা শহরে এক সময় প্রচুর ‘হাড়গিলে’ পাখি দেখা যেত। এখন আর তারা নেই। হারিয়ে গেছে। ছোট্ট চড়াইয়েরও কি একই দশা হতে চলেছে? এরাও কি বিলুপ্তির পথে? ভবিষ্যতে কি এরা শুধু বইয়ের ছবি হয়ে থাকবে, অথবা যেতে হবে কোনো মিউজিয়ামে?

শুধু চড়াই নয়, সারা পৃথিবীতে অন্যান্য অনেক পাখির সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। নানা দেশের গণনা থেকে জানা গেছে যে, গত ১২ বছরে চড়াই-এর সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। ব্রিটেনের কথাই ধরা যাক। সত্তর দশকের প্রথমদিকে সেদেশে চড়াই পাখির সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষের মতো। ২০১৩ সালে সেখানে সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৬০ লক্ষের কাছাকাছি। দেখা যাচ্ছে গত চল্লিশ বছরে শুধু ব্রিটেনেই এই পাখির সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এরা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ভারতবর্ষেও চড়াই পাখির সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে কুড়ি বছর আগেও ব্যাঙ্গালোরে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ২৫০০০ চড়াই পাখি দেখা যেত। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে পঞ্চাশটির মতো। পাখিটির সংখ্যা কেন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে তা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু এদের রক্ষা করার জন্য তেমন কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে চড়াই পাখির উৎপত্তিস্থল মধ্য প্রাচ্য। কৃষি কাজের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এরাও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। চড়াই হল একমাত্র পাখি যার বিস্তৃতি সবচেয়ে বেশি। শুধু তাই নয়, ফিলিপিন্সে এই পাখি জাতীয় পাখি হিসাবে স্বীকৃত। বাড়ির আশেপাশে যেসব চড়াই দেখতে পাওয়া যায় তাদের হাউস স্প্যারো বলা হয়ে থাকে। এরা চটক পাখি নামেও পরিচিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চড়াই হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী আমাদের বদলে যাওয়া জীবনযাত্রা। ৬০-৭০ বছর আগেও আমাদের সমাজে ফ্ল্যাট-বাড়ি কালচার ছিল না বললেই চলে। একতলা অথবা দোতলা বাড়ির সংখ্যাই ছিল বেশি। মাঝে মধ্যে দু’একটা তিন-চারতলা বাড়ির দেখা পাওয়া যেত। কলকাতা শহরে তখন এত জনসমাগম ছিল না। রাস্তায় তীব্র আলোর ঝলকানি ছিল না। গাছপালাও ছিল বেশি। শহরে যত ভিড় বাড়তে লাগল, বাসস্থানের চাহিদাও বাড়তে থাকল। গাছপালা কাটা শুরু হল, জলাভূমি ভরাট হতে লাগল, পুরোনো একতলা-দোতলা বাড়িগুলি ভেঙে তৈরি হতে লাগল ফ্ল্যাট বাড়ি। একই বাড়িতে অনেক পরিবারের বাস। অফিস-কাছারির পুরোনো বাড়িগুলি ভেঙে সেখানে তৈরি হল আকাশচুম্বী বাড়ি। এখন প্রশ্ন হতে পারে বাড়ির সঙ্গে চড়াই পাখির সম্পর্ক কী? আগেকার দিনের বাড়ি আর এখনকার বহুতল বাড়িগুলির মধ্যে নির্মাণ-শিল্পে অনেক পার্থক্য আছে। পুরোনো বাড়িগুলিতে থাকত নানা ধরনের ছোটবড় ফাঁকফোকর, ঘুলঘুলি, কড়িবরগা, চিলেঘর, জিনিসপত্র রাখার জন্য দেওয়ালের গায়ে তৈরি করা হত উঁচু তাক ইত্যাদি। এগুলি চড়াই পাখির বাসা বানানোর জায়গা ছিল। সেখানে এরা ডিম পাড়ত, ছানা বড় হত, তারপর একদিন উড়ে যেত। এই দৃশ্য দেখা যেত প্রতি বছর ওদের প্রজননের সময়। মানুষও ওদের তেমন বিরক্ত করত না। এখনকার বাড়িগুলি এভাবে তৈরি হয় না। কড়িবরগার পরিবর্তে এখন বাড়ি তৈরি হয় ঢালাই পদ্ধতিতে। দেওয়ালগুলি হয় মসৃণ। ফলে কোনো ফাঁকফোকর থাকে না। ঘুলঘুলি রাখার কথা তো স্থপতিরা ভুলেই গেছে। তাই মানুষের বাসস্থান বাড়লেও চড়াইদের বাসা বানানোর জায়গা কমে যাচ্ছে। বাসাই যদি বানানো না যায়, তাহলে ডিম পাড়বে কোথায়?

শুধু বাসা বানানোর জায়গা যে দিন দিন কমে যাচ্ছে তা নয়, খাবারেও টান পড়ছে। ছানাদের প্রধান খাদ্য পোকা। তখন তাদের বেড়ে ওঠার সময়। তাই প্রোটিনের প্রয়োজন। চড়াই দম্পতি সারা দিন খুটে খুটে নানা জিনিস খেলেও ছানাদের খাওয়ানোর জন্য ধরে নিয়ে আসে পোকা। কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পোকা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে চড়াই পাখিরা।

তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে বলে রাস্তার ধারেই হোক বা বাগান তৈরিতেই হোক দেশি গাছের বদলে বিদেশি গাছের কদর বাড়ছে। এইসব বাহারি গাছে পোকাও ধরে কম। পোকার সংখ্যা কমে যাওয়ায় পরাগ মিলনে ব্যাঘাত ঘটছে। গাছে ফলন কমছে। খাদ্য সঙ্কটের এটাও আরেকটা কারণ।

শোনা যাচ্ছে, মোবাইল ফোনের সূক্ষ্ম তরঙ্গ নাকি চড়াই পাখিদের অস্তিত্ব সঙ্কটের অন্যতম কারণ। এই তরঙ্গ হাজার হাজার চড়াইকে নিঃশব্দে হত্যা করছে। বিশেষজ্ঞদের এই অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে যে হারে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বেড়ে চলেছে তাতে এই নিরীহ ছোট্ট পাখিটির বিলুপ্তি বেশি দূরে নয়। আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাব একটি স্লোগান— ‘একদা চড়াই নামে একটা পাখি ছিল, চল তাকে দেখে আসি মিউজিয়ামে’।

তাহলে সত্যিই কি চড়াই পাখি হারিয়ে যাবে? পাখিপ্রেমী বা পাখিবিশারদরা তা চান না। চান নি আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পাখিবিশারদ মহম্মদ দিলওয়ার। বিগত আট বছর ধরে তিনি চড়াই রক্ষার কাজে ব্যস্ত আছেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে মার্চ মাসের ২০ তারিখ চড়াই দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী চড়াই পাখি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে— উদ্দেশ্য জনসাধারণকে সচেতন করা।

ব্যাঙ্গালুরুর পাখিবিশারদ দিলওয়ার-এর মতো উত্তর ভারতের গাড়োয়াল হিমালয়ের উখিমঠের বাসিন্দা পাখিপ্রেমী যশপাল সিং নেগি ঠিক করে ফেলেছেন যে তিনি চড়াইদের জন্য একটা বাড়ি বানাবেন। পাথরের তৈরি এই বাড়িতে থাকবে অসংখ্য ফাঁকফোকর যেখানে চড়াই পাখিরা নিশ্চিন্তে বাসা বাঁধতে পারবে। বাড়ির নাম হবে ‘চড়াই ভবন’। এমন উদ্যোগ ঘরে ঘরে হলে অসহায় পাখিগুলিকে আর করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হবে না।