Science News-বিজ্ঞানের টুকরো খবর

গন্ধ তো নয় মন্দ – তপন গাঙ্গুলী

ধীবরকন্যা সত্যবতী পরাশর মুনির সেবা করে মৎস্যগন্ধা থেকে যোজনগন্ধা হয়েছিলেন; তার দৌলতে হয়েছিলেন ভরতবংশের রাজেশ্বরী। সুগন্ধের এইরকম ব্যক্তিত্ব আর আকর্ষণ ক্ষমতার পরিচয় ছড়িয়ে আছে সভ্যতার আদিযুগ থেকেই।

গন্ধের আকর্ষণের ব্যবহার পশুজগতেরও এক পরিচিত আচরন। জীবজগতে ফেরোমোন হরমোন একটা বিশেষ ভূমিকা নেয় বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করতে। কুকুর, বেড়াল জাতীয় প্রাণীরা সাধারণত এই হরমোনের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে দেয় তাদের মিলনের ইচ্ছে প্রকাশ করতে।

কিন্তু মানুষের ব্যবহার একটু জটিল। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন শরীরের গন্ধের সঙ্গে মানব/মানবীর ফেরোমোন হরমোন বিভিন্ন ধরনের সংকেত পাঠায় যা সঠিক সঙ্গী খুঁজে পেতে সাহায্য করে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে বহুগামী মানব/মানবী ছাড়া অন্যদের পরিচিত জনের ফেরোমোন গন্ধের সংস্পর্শে আনলে তাদের মস্তিষ্কের কাজ বেডে যায়। এই পরীক্ষা থেকে আশা করা হচ্ছে সঠিক সুগন্ধ মানুষেরও মিলনের ইচ্ছেকে বাড়াতে পারে। ইতালিতে এক পরীক্ষায় জানা গেছে প্রিয় বন্ধু/বান্ধবীর ব্যবহার করা সুগন্ধী ছবির ওপর ব্যবহার করলে একগাদা অচেনা ছবির মধ্যে মানুষ পরিচিত গন্ধ লাগানো ছবি আগে বেছে নেয়। এ থেকে বোঝা যায় যে সুগন্ধী মানব বা মানবীর আকর্ষণ বাড়ায়। কিন্তু এই পরীক্ষার ফল সাধারনভাবে গ্রহনযোগ্য একথা বলা যায় না; তবে এটা বলা যায় যে কোনো ব্যক্তির আকর্ষণ নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্ব আর তার গায়ের গন্ধ দুটোর ওপরই।
সাধারনভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে ভ্যানিলা আর দারচিনির গন্ধ পুরুষদের আকর্ষণ করে। কিছু বিশেষ গন্ধ যেমন – ১) ওক গাছের শ্যাওলা , ২) ধনে, ৩) মেহগনি, ৪) পিচ বা কমলালেবু, ৫) অ্যাম্বার পুরুষ ও নারী উভয়কেই আকর্ষণ করে। তবে মানুষের মধ্যেও পরিচিত এবং প্রিয় ফেরোমোনের গন্ধই মিলনের ইচ্ছে বেশি জাগায়।

পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসে নিজেকে আকর্ষণের কেন্দ্রে রাখবার জন্যে বা জাহির করতে সুগন্ধীর ব্যবহারের পরিচয় পাওয়া যায় খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০ বছরের আগে থেকে। সুগন্ধী ব্যবহারের প্রমান পাওয়া গেছে মিশরে, মেসোপটেমিয়ায়, সিন্ধুসভ্যতায়, চিনে – প্রায় সমস্ত প্রাচীন সভ্যতায়। প্রথম সুগন্ধী প্রস্তুতকারক এক মহিলা ‘তাপ্পুতি’র নাম পাওয়া গেছে মেসোপটেমিয়ার পোড়ামাটির কিলকাকার (cuneiform) ফলকের লিপিতে; যিনি খ্রীষ্টজন্মের ২০০০ বছর আগে ফুলের নির্যাস, তেল, ভেষজ দিয়ে সুগন্ধী তৈরী করতেন। ২০০৪/২০০৫ সালে সাইপ্রাসে চারহাজার বছরের পুরোনো সুগন্ধী কারখানার খোঁজ পাওয়া গেছে। সেখানে সুগন্ধী তৈরি করতে ব্যবহার করা হত ধনে, রজন, বার্গামন্ট, ফুলের নির্যাস আর বিভিন্ন ভেষজ। পারস্যের রসায়নবিদ ইবন-সিনা প্রথম পাতন পদ্ধতিতে ফুলের নির্যাস বের করা আবিষ্কার করেন – এই পদ্ধতি মোটামুটি আজও ব্যবহার করা হয় সুগন্ধী তৈরি করতে।

সুগন্ধী পছন্দের থেকে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও মেজাজের পরিচয়ও পাওয়া যায়। জার্মানির মনোবিজ্ঞানী পরীক্ষা করে দেখেছেন যে কোনো মানুষের ব্যক্তিত্ব আর মেজাজ বোঝা যায় তাদের পছন্দের সুগন্ধী থেকে। যে ব্যক্তি মুখচোরা বা যে বেশি কথা বলে, তাদের পছন্দের গন্ধ আলাদা হয়।
মূলত পাঁচ ধরনের গন্ধকে আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট করা যায় –
১ ) কাঠের গন্ধ : প্রকৃতিকে যারা পছন্দ করে তারা সাধারণত সিডার, চন্দন বা প্যাক্টচৌলির সুগন্ধী পছন্দ করে।
২ ) ফুলের গন্ধ : মেয়েলি বা রোম্যান্টিকরা ফুলের গন্ধ পছন্দ করে। এরা সাধারণত ফিটফাট থাকতে, সুন্দরভাবে সাজতে পছন্দ করে।
৩ ) প্রাচ্য সুগন্ধী : নিজেকে যারা সাধারনদের থেকে আলাদা আর সাহসী দেখাতে চায়; সেই ধরনের মহিলারা এই ধরনের সুগন্ধী পছন্দ করে।
৪ ) ফলের গন্ধ : যে মহিলারা তাজা ফল পছন্দ করে; তারা পিচ, তরমুজ, রাপ্সবেরির সুগন্ধ ব্যবহার করে।
৫ ) সবুজের গন্ধ : যে মহিলারা ঘরের বাইরে বা বাগানে বেড়াতে পছন্দ করে আর নিরুদ্বিগ্ন থাকা পছন্দ করে, তারা এই ধরনের পাতার গন্ধ বা কাটা ঘাসের গন্ধ পছন্দ করে।

তবে সুগন্ধী বাছার সময় মনে রাখবেন ‘গন্ধবিচার’ করলে ব্যক্তি আর ব্যক্তিত্ব দুটোই সামনে চলে আসে; পরিচিত আর অপরিচিতরও।