Chemistry-রসায়ন

সার্ধশতবর্ষের আলোয় পর্যায়সারণি – অঞ্জনা ঘোষ

মানব সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস অনুসরণে দেখা যায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষ সোনা, রূপা,টিন, তামা, সীসা ও পারদ.. এই ধাতব মৌলগুলি ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রসায়নাগারে প্রথম আবিষ্কৃত মৌল টির নাম ফসফরাস .. সময় 1649 সাল। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে রসায়ন চর্চার অগ্রগতির সাথে সাথে আরও অনেক ধাতব ও অধাতব মৌল আবিষ্কৃত হতে থাকে এবং 1869 সাল পর্যন্ত এই সংখ্যাটা দাঁড়ায় 63 তে।

আবিস্কৃত মৌলিক পদার্থ সমূহের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে রসায়নবিদরা উপলব্ধি করেন যে আবিস্কৃত মৌল গুলি সম্পর্কে অগ্রবর্তী গবেষণার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মৌলগুলিকে সুশৃঙ্খল ভাবে একটি নিয়মের বন্ধনে শ্রেণীবদ্ধ করা। এই লক্ষ্যে রসায়নবিদরা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নানা সময়ে নানান প্যাটার্নের শ্রেণীবদ্ধতার সম্ভাব্যতা প্রকাশ করেন। তবে পর্যায়সারণি’র ইতিহাস বলে আবিষ্কৃত মৌলদের প্রথম সফল একটি নিয়মমাফিক (orderly arrangement) শ্রেণীবদ্ধকরণ … এর সঠিক দাবিদার হলেন .. রাশিয়ান রসায়নবিদ ডিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিফ (1834-1907)।

মেন্ডেলিফ তাঁর যাত্রা শুরু করেন 63 টি মৌলিক নিয়ে এবং 1869 সালে তিনিই প্রথম প্রকাশ করেন এই মৌলগুলির একটি সুশৃঙ্খল নিয়মানুগ শ্রেণীবদ্ধ রূপ … রসায়নের জগতে যার নাম পর্যায়সারণি (Periodic table)।

আসুন এবার একটু অতি সংক্ষেপে দেখে নিই ঠিক কিভাবে মেন্ডেলিফ এই কাজটা সম্পন্ন করেছিলেন।
প্রথমে তিনি 63 টা মৌলের জন্য 63 টা আলাদা আলাদা কার্ড নিয়েছিলেন।এরপর প্রত্যেকটা কার্ডে একই ক্রমানুসারে এক একটা মৌলের চিহ্ন (symbol), পারমাণবিক ওজন, তাদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এরপর একটা টেবিলের ওপর কার্ডগুলোকে সাজিয়ে ছিলেন মৌলগুলির ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক ওজন অনুসারে (সলিটেয়র গেমের তাসের সজ্জার সঙ্গে তুলনীয়)। প্রসঙ্গত .. সলিটেয়র গেম মেন্ডেলিফের খুব প্রিয় ছিল। আর এই ভাবেই তৈরি হল পর্যায়সারণি’র আদি কাঠামো। এই কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই মেন্ডেলিফ প্রকাশ করলেন তাঁর মৌল সজ্জা… রসায়নের “বাইবেল” ( এই প্রসঙ্গে সবশেষে আরও একবার আসব)… “The Mendeleef’s Periodic Table.”

এখানে একটু বলি … মেন্ডেলিফের পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে আরও অনেক সমসাময়িক রসায়নবিদও পর্যায়সারণি নিয়ে গবেষণা করছিলেন।তবে মেন্ডেলিফের কাজের গুণগত মান তাঁর সমসাময়িক দের থেকে অনেক উচ্চতর ছিল এবং 1905 সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাবিতও হয়েছিল…. তবে শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য নোবেল পুরস্কার পান নি।

পরবর্তী কালে মেন্ডেলিফ “পর্যায়সারণি’র জনক” (The Father of Periodic Table) উপাধি’তে ভূষিত হন। তাঁর লেখা “Principles of Chemistry” বইটিও বিপুল ভাবে সমাদৃত হয়। প্রসঙ্গত… এই বইটির মোট 13টি প্রকাশন এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে। শেষ প্রকাশন 1947 সালে।

এবার একটু অতি সংক্ষেপে দেখে নিই কোথায় ছিল মেন্ডেলিফের পর্যায়সারণি’র
উৎকৃষ্টতা।

আসলে পর্যায়সারণি নির্মাণের সময়ে মেন্ডেলিফ বেশ কয়েকটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আমি অত বিশদে যাবনা। তবে তার মধ্যে একটির উল্লেখ না করলে বোধ হয় এই নির্মাণটি সম্পূর্ণতা পাবেনা।

মেন্ডেলিফ তাঁর পর্যায়সারণি’তে মৌলগুলিকে এমনভাবে সাজাচ্ছিলেন যাতে একই ধর্ম বিশিষ্ট মৌলগুলি একই গ্রুপে (vertical column) থাকে। একথা তো আমরা সবাই জানি। তবে এটা করতে গিয়ে তিনি উপযুক্ত মৌলের সন্ধান না পাওয়ায় কিছু কিছু স্থান ফাঁকা রেখে দেন। শুধু তাই নয়… একই সঙ্গে অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে ঐ সমস্ত ফাঁকা স্থান গুলিতে সঠিকভাবে রাখার মত উপযুক্ত ধর্ম বিশিষ্ট মৌল সমূহ ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে আছে আবিস্কারের অপেক্ষায়।

মেন্ডেলিফের এই ভবিষ্যতবাণীর সত্যতা তো আমরা সবাই জানি। আজ আমরা আধুনিক পরিবর্ধিত পর্যায়সারণি’র যে ঘরগুলিতে গ্যালিয়াম (Ga), স্ক্যানডিয়াম (Sc) আর জারমানিয়াম (Ge) দেখি মেন্ডেলিফ এই মৌলগুলির আবিস্কারের বহু পূর্বেই পর্যায়সারণি’তে এদের সঠিক স্থান নির্দেশ করেছিলেন এবং অনাবিষ্কৃত মৌলগুলির নাম দিয়েছিলেন যথাক্রমে
একা

(eka) বোরন (Sc)
একা (eka) সিলিকন (Ge)
একা (eka) এলুমিনিয়াম ( Ga)
একা (eka) এই শব্দটির অর্থ সদৃশ/একই রকম….. খুব সম্ভবত(নিশ্চিত নই) সংস্কৃত ‘ek’ শব্দ থেকে এই শব্দটি মেন্ডেলিফ নির্বাচিত করেছিলেন।

নতুন নতুন অনাবিষ্কৃত মৌলের অস্তিত্ব সম্পর্কে মেন্ডেলিফের এই যে ভবিষ্যতবাণী এবং পরবর্তী কালে তার সত্যতা প্রমাণিত… এটাই কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী রসায়নবিদ দের অনুপ্রাণিত করেছিল আরও অনেক নতুন মৌল আবিষ্কারে এবং পর্যায়সারণি’তে সেই মৌলগুলিকে উপযুক্ত স্থানে প্রতিস্থাপন করতে।

এভাবেই বাড়তে বাড়তে পরিবর্ধিত পর্যায়সারণি’তে 2015 সালের নভেম্বরের আগে পর্যন্ত মোট 114 টি মৌল ছিল…. ফাঁকা ছিল মাত্র চারটি ঘর (113,115, 117,118 পারমানবিক সংখ্যার মৌল)। অবশেষে 2016 সালের 28শে নভেম্বর IUPAC (International Union of Pure & Applied Chemists) ঘোষনা করল অবশিষ্ট চারটি মৌলের আবিস্কারের কথা …
নিহোনিয়াম (113),
মসকোভিয়াম (115),
টেনেসাইন (117),
অরগানেসন (118)।

1869 সালে মাত্র 63 টি মৌলিক পদার্থ নিয়ে যে স্বপ্নের যাত্রা মেন্ডেলিফ শুরু করেছিলেন স্বপ্নপূরণ করে সেই যাত্রা শেষ হল 2016 সালে…… 118তম মৌলটির আবিষ্কারের দ্বারা পর্যায়সারণি সম্পূর্ণতা লাভ করল।

পরিশেষে বলি ….
যতদিন এই গ্রহে রসায়ন চর্চা অব্যাহত থাকবে ততদিন সেই চর্চায় পর্যায়সারণি’র ভূমিকাও অবিচ্ছেদ্য থাকবে। পর্যায়সারণি হল ‘রসায়নের বাইবেল’। পবিত্র বাইবেল যেমন তার অনুসরণকারী’দের সুপথে চালিত করে পর্যায়সারণি’ও তেমনই রসায়নের বিশাল গবেষণার জগতে মৌল সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় বহু তথ্য প্রদান করে গবেষণাগুলিকে সঠিক পথে চালিত হতে সহায়তা করে। তাই আজ পর্যায়সারণি’র সার্ধশতবর্ষের (2019) প্রাক্কালে মহান বিজ্ঞানী মেন্ডেলিফ এবং অন্যান্য সমস্ত রসায়নবিদ যাঁরা রসায়ন সাম্রাজ্যের স্তম্ভ স্বরূপ এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন…. তাঁদের সকলের প্রতি অর্পিত হল আমার গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধা।