Chemistry-রসায়ন

অনুঘটকের ঘটকালি – ডঃ অঞ্জনা ঘোষ

অতি সম্প্রতি আমার এক মুখবই বন্ধু আমাকে পরামর্শ দেন ‘অনুঘটক’ নিয়ে কিছু লিখতে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে প্রস্তাবটি তৎক্ষণাৎ লুফে নিই। কারণটি নীচে দ্রষ্টব্য।

ডঃ সিদ্ধার্থ মজুমদারের লেখা “বিপরীত পরাগ সংযোগ “(প্রকাশিত 2014 ডিসেম্বর) নামক বইটির “বিজ্ঞানী ও কবি: রোয়াল্ড হফম্যান ” নামক অনুচ্ছেদে স্বনামধন্য নোবেলজয়ী (1981) রসায়ন বিজ্ঞানী রোয়াল্ড হফম্যান’এর ( জন্ম 1937; বর্তমানে তিনি কর্নেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে ‘ ফ্রাঙ্ক এইচ টি রোডস অফ হিউম্যান লেটারস’ প্রফেসর পদে অধিষ্ঠিত)কবিতা ও সাহিত্য জগতেও সফল বিচরণ ও অপরূপ সৃজনশীলতার এক অতি মনোজ্ঞ বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখক এই হফম্যান’এর লেখা একটি অনন্য সুন্দর কবিতার উল্লেখ করেছিলেন। সেই কবিতার দুটি লাইন একটু বিশেষ ভাবে আমার মন ছুঁয়েছিল। রসায়ন এর শিক্ষিকা হিসেবে যতবার আমি আমার ক্লাসে ‘অনুঘটক’ সম্বন্ধে কিছু বলতে যাই ঐ দুটি লাইন আমার মস্তিষ্কে অনুরণিত হয়।

আজ ‘অনুঘটক’ নিয়ে কিছু লিখতে বসে সর্ব প্রথম আবারও হফম্যান’এর ঐ দুটি লাইন মনে পড়ছে। তাই লেখা শুরু করছি শ্রদ্ধেয় রোয়াল্ড হফম্যান’এর লেখা কবিতার ঐ দুটি লাইন দিয়ে……
” A cheap pound of Haber’s primped iron could make a million pounds of ammonia.”
অর্থাৎ এক পাউন্ড উপযুক্ত মানের লোহার উপস্থিতিতে কোটি কোটি পাউন্ড এমোনিয়া উৎপাদন সম্ভব। কেমন যেন গল্পকথার মত শোনাচ্ছে …তাই না? কিন্তু না…. একদম বাস্তব সত্যি। আসুন দেখি ব্যাপারটা কি।

এমোনিয়া একটি অতি পরিচিত রাসায়নিক যৌগ। রসায়নাগারে এর বহুল ব্যবহার ছাড়াও সারা বিশ্বের মানুষের মুখে খাবার জোগান দেওয়া.. এমন একটি বৃহৎ কাজে এই এমোনিয়া নামক যৌগটির কিন্তু পরোক্ষ ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত নাইট্রোজেন সমন্বিত যেকোন রাসায়নিক সার যেমন.. ইউরিয়া, এমোনিয়াম সালফেট, এমোনিয়াম নাইট্রেট, এমোনিয়াম ক্লোরাইড ইত্যাদি … এই সমস্ত যৌগগুলিই তৈরী হয় এমোনিয়া থেকে। তাই একথা সহজেই অনুমেয় যে এই এমোনিয়া যৌগের কি বিপুল চাহিদা সমগ্র বিশ্বে। আর এই বিপুল চাহিদার যোগান আসে হেবার পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক হারে উৎপাদিত এমোনিয়া দ্বারা। আর এই হেবার পদ্ধতির সাফল্যের পিছনে মূল ভূমিকা হল অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত একটি মৌলের ..সেটি হল লোহা।

আসুন দৃষ্টি আরও একটু ছড়িয়ে দেই…. রসায়নাগারে এবং বাণিজ্যিক রসায়ন শিল্পের(chemical industry)ক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যবহৃত যে যৌগটি… ‘রাসায়নিক দ্রব্যসমূহের রাজা(King of Chemicals)’ নামে খ্যাত …. হাঁ সালফিউরিক এসিড’এর কথা বলছি। বিপুল চাহিদার এই যৌগটি বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদিত হয় ‘কনট্যাক্ট পদ্ধতি’ তে। আর এই কনট্যাক্ট পদ্ধতির সাফল্যের মূল চাবিকাঠিও লুকিয়ে আছে এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত অনুঘটক ভ্যানাডিয়াম পেনটক্সাইড নামক একটি যৌগের সক্রিয় উপস্থিতিতে।
তবে শুধুই বাণিজ্যিক প্রয়োজনে নয়, রসায়নের বিশাল জগতে অসংখ্য রাসায়নিক বিক্রিয়া ও সংশ্লেষণ সংঘটিত হয় হরেক রকমের ‘অনুঘটক’ এর ঘটকালির মাধ্যমে। উদাহরণ দিতে গেলে এখন এক সমুদ্র উদাহরণ দিতে হবে। পাঠক তার নিজের প্রয়োজনে টেক্সট বই/গুগুল বন্ধুর সহায়তা নিতেই পারেন।

আবার একটু ফিরে আসি এমোনিয়ার প্রসঙ্গে। নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন এই দুই মৌলের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরী হয় এমোনিয়া যৌগটি। তবে নাইট্রোজেন একটি অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় মৌল। তাই হাইড্রোজেন মৌলের সঙ্গে নাইট্রোজেন মৌলের সতঃস্ফূর্ত বিক্রিয়া করানো অত সহজ কর্ম নয়। তার ওপর বিক্রিয়াটি উভমুখী.. এবং এমোনিয়ার এনট্রপি বিক্রিয়াকারী নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন এর সামগ্রিক এনট্রপির (disorder) থেকে অনেক কম হওয়ার ফলে সম্মুখভাগের বিক্রিয়ায় (forward reaction) উৎপন্ন এমোনিয়া অতিরিক্ত সক্রিয় থাকে পশচাৎমুখী বিক্রিয়া (backward reaction) অভিমুখে। ফলে উৎপন্ন এমোনিয়ার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হয়। আর এই সমস্যার সমাধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসে অনুঘটকের ব্যবহার। সামান্য পরিমান লোহার উপস্থিতিতে এবং বিশেষ তাপ ও চাপের প্রভাবে একই বিক্রিয়ার বেগ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়…. প্রচুর পরিমাণে এমোনিয়া উৎপন্ন হয়।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ….. কোটি কোটি টন এমোনিয়ার উৎপাদনে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত লোহার পরিমাণ অতি সামান্য। শুধু তাই নয় …. প্রথমবার বিক্রিয়ার সময় যে সামান্য পরিমাণ লোহা অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেই একই পরিমান লোহা বিক্রিয়া শেষে ফেরত পাওয়া যায়…. প্রতিবার বিক্রিয়ার শেষে।

অবাক কাণ্ড! পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ….. কি করে সম্ভব? হাঁ সম্ভব। আর এই সম্ভাব্যতার পেছনেই লুকিয়ে আছে অনুঘটকের ঘটকালি পদ্ধতির রহস্য।

কি এই অনুঘটক? অনুঘটক হল এমন একটি রাসায়নিক যার উপস্থিতিতে একটি অতি মন্থর রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিবেগ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ অতি দ্রুত গতিতে বিক্রিয়া হওয়ার ফলে অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণে প্রার্থিত যৌগটি উৎপন্ন হয়।
এখন প্রশ্ন হল কিভাবে? আসুন এবার একটু রসায়ন’এর ভিতর মহলে প্রবেশ করি।

আসলে প্রতিটি রাসায়নিক বিক্রিয়াই সংঘটিত হয় একটি নির্দিষ্ট পথে আর সেই নির্দিষ্ট পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্যকরী শক্তির (activation energy) প্রয়োজন। যে সমস্ত বিক্রিয়ায় বিক্রিয়াকারী মৌলিক বা যৌগ অণুগুলি যথেষ্ট সক্রিয় (highly reactive) সেই সমস্ত বিক্রিয়া সাধারণতঃ সংঘটিত হয় সাধারন তাপমাত্রায় বা সামান্য উচ্চতাপে। কারণ এই সমস্ত বিক্রিয়ায় বিক্রিয়াকারী অণুগুলির বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকরী শক্তি আসে বিক্রিয়াকারী অণুগুলির গতিশক্তি থেকে। এই গতি শক্তির দ্বারা বিক্রিয়াকারী অণুগুলি পৌঁছে যায় তাদের
প্রয়োজনীয় ‘কার্যকরী শক্তি’র লেভেলে এবং সেই শক্তির সাহায্যে পরস্পরে সংঘর্ষে (collision) লিপ্ত হয়…….. এই সংঘর্ষই রসায়নের ভাষায় ‘রাসায়নিক বিক্রিয়া’ যা জন্ম দেয় এক বা একাধিক নতুন যৌগ পদার্থের।

যে সমস্ত বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক অণুগুলি যথেষ্ট সক্রিয় নয় সেই সমস্ত ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা খুবই গুরুত্ব পূর্ণ। অনুঘটক এক বা একাধিক বিক্রিয়াকারী অণুর সঙগে যুক্ত হয়ে সমগ্র বিক্রিয়াটিকে একটি নতুন বিকল্প পথে চালিত করে… যে পথে বিক্রিয়াটির প্রয়োজনীয় কার্যকরী শক্তির পরিমাণ অনেক কম। ফলে অতি অনায়াসেই বিক্রিয়াটি সংঘটিত হতে পারে এবং স্বাভাবিক ভাবেই বিক্রিয়ায় গতি অনেক দ্রুত হয় .. অর্থাৎ নূন্যতম সময়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিমান উৎপাদন সম্ভব হয় ।

তবে একথা আগেই উল্লেখ করেছি যে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রয়োজনেই নয়, রসায়নের সুবিশাল জগতে অনুঘটকের ঘটকালির কথা সম্ভবত বলে শেষ করা যায় না। সে চেষ্টার ধারেকাছেও যাচ্ছি না।

শুধু আর একটা প্রসঙ্গ একটু ছুঁয়ে না গেলে বোধ হয় এই লেখাটির উদ্দেশ্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সেটা হল এই অনুঘটকের খবরদারি কিন্তু শুধু অজৈব রসায়নের জগতের একচেটিয়া নয়…… উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহে সংঘটিত অজস্র অসংখ্য জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিতেও অনুঘটকের গুরুত্ব অসীম ……. যাকে আমরা বলি জৈব অনুঘটক /এনজাইম।

সে আর এক অপার বিস্ময়কর রসায়নের জগত। ভবিষ্যতে আমার পাঠকদের নিয়ে আর একবার সেই জগতে বিচরণের সদিচ্ছা রইল।