Chemistry-রসায়ন

হাইড্রোজেন-ক্ষুদ্রতম কিন্তু মারাত্মক – সৌমিত্র চৌধুরী

হাইড্রোজেন। মৌলিক পদার্থ (Element), সংক্ষেপে মৌল। ভর সব চেয়ে কম। মানে সবার চাইতে হালকা। সাধারণ তাপমাত্রায় গ্যাস। তাপমাত্রা খুব কমালে (-240oC) তরল অবস্থায় পৌঁছে যায়। আরও নিচু তাপমাত্রায় হয়ে যায় কঠিন।

কঠিন, তরল বা গ্যাস তাপমাত্রা ভেদে একই জিনিসের বিভিন্ন অবস্থা। জল যেমন। কখনও কঠিন আবার তরল, বেশি তাপমাত্রায় গ্যাস। অনেক মৌলিক পদার্থ সাধারণ তাপমাত্রায় (37oC) হাইড্রোজেনেরই মত গ্যাস অবস্থায় থাকে। বাতাসের উপাদান– অক্সিজেন নাইট্রোজেন, সাধারণ তাপমাত্রায় গ্যাস। আবার কার্বন ডাই অক্সাইড কিম্বা মিথেন সাধারণ তাপমাত্রায় গ্যাস হলেও মৌলিক পদার্থ নয়। যৌগিক পদার্থ (Compound)। একাধিক মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি।

মৌলিক বা যৌগিক যেমনি হ’ক, সাধারণ তাপমাত্রায় অনেক পদার্থই গ্যাস হিসাবে থাকতে পারে। আর গ্যাস যখন – রাসায়নিক ধর্ম, অণুর আকার বা গঠন আলাদা হলেও, কিছু সাধারণ নিয়ম এরা মানতে বাধ্য। যেমন গ্যাস অদৃশ্য। চোখে ধরা পড়েনা। তবে ঝাঁজালো বা কটু গন্ধে, কখনও সুগন্ধ নাকে ভেসে এলে গ্যাসের উপস্থিতি বুঝতে পারি। বুঝবার কারণ? গ্যাস সহজেই চারদিকে ছড়িয়ে পরে। ছড়িয়ে পরার কারণ — গ্যাস অণু (Molecule) গুলো পরস্পরের সাথে কম শক্তিতে লেগে থাকে। সোনা রূপা লোহার ক্ষেত্রে এরকম হয় না। ওদের পরমাণুগুলো (Atoms) একে অন্যের সাথে শক্তিশালী বন্ধনী তৈরি করে। বন্ধনীর শক্তি বস্তু ভেদে ভিন্ন রকমের। কঠিন তরল এবং গ্যাসের মধ্যে, গ্যাসের অনু গুলো সবচাইতে কম শক্তিতে একে অন্যকে ধরে থাকে। আবার এই শক্তি, মানে পরস্পরের সাথে লেগে থাকবার পরিমাপ কার্বন ডাই অক্সাইড, অক্সিজেন কিম্বা হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে আলাদা রকম। আলাদা এদের রাসায়নিক ধর্মও।

তবুও গ্যাস হিসাবে এরা কয়েকটি নিয়মের অধীন। যেমন গ্যাসের অনুগুলো খুব জোরে ছুটাছুটি করে। কোন বদ্ধ যায়গায় ছুটতে ছুটতে একে অন্যকে ধাক্কা মারে। ধাক্কা খাওয়া অনুর গতিবেগ বেড়ে যায়। যে ধাক্কা মারে তার গতিবেগ মুহূর্তে কমে যায়। অসংখ্য অনুর মধ্যে ধাক্কাধাক্কি চলতেই থাকে। ফলে প্রতিক্ষণেই পাল্টে যায় অনুর গতিবেগ। এই জটিল অবস্থাতেও গ্যাস অনুর গতিবেগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ভর বেশি হলে গ্যাস অনু জোরে দৌড়াতে পারবে না। গড় গতিবেগ কমে যাবে। গ্যাসের অনু যত হাল্কা আর ছোট হবে ততই বাড়বে তার গতি। এ কারনেই ভর কম এবং আকারে ছোট হাইড্রোজেন সব চাইতে জোরে দৌড়াতে পারে। বেলুনের মধ্যে ভরে দিলে গ্যাস-বেলুনকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আবার তাপমাত্রা বেশি হলে ছোটার গতি আরও বাড়বে। হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে এই গতি এতটাই যে বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল কাটিয়ে সে চলে গেছে অন্তরীক্ষে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে হাল্কা গ্যাস হাইড্রোজেন পাওয়া যায় না।

হাইড্রোজেনের আইসোটোপ, ডয়টেরিয়াম (D) ও ট্রিসিয়াম (T) পরমাণু সংযুক্ত (fusion) হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম (He), নিউট্রন (n)। পারমানবিক বিক্রিয়ায় তৈরি হয় প্রচন্ড তাপ শক্তি (E)
তবে প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুতে যৌগ হিসাবে ছড়িয়ে আছে প্রচুর হাইড্রোজেন। আর সব চাইতে বড় হাইড্রোজেনের ভাণ্ডার হল জল। নদী-সমুদ্রের অগাধ জলরাশি থেকে তৈরি করা যায় হাইড্রোজেন। তৈরির অন্য উপায়ও আছে। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের মধ্যে ধাতুর টুকরো ফেলে দিলে ভুরভুর করে হাইড্রোজেন বেরিয়ে আসে। এরকমই ঘটনা দেখে ইংল্যান্ডের পঁয়ত্রিশ বছরের বৈজ্ঞানিক হেনরি ক্যাভেন্ডিস বললেন ‘আমি একটা গ্যাস আবিষ্কার করেছি’। আজ থেকে আড়াইশ বছর আগের ঘটনা। এর ন-বছর আগে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ভারত ইংরেজের অধীন। 1766 সালে গ্যাস আবিষ্কারের সময়ই কিন্তু তার নামকরন হয় নি। নামকরণ হল সতের বছর পর। ফ্রান্সের রসায়নবিদ অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়র গ্যাসটির নাম রাখলেন ‘হাইড্রোজেন’। নামের তো মানে থাকতে হবে। তিনি বললেন হাইড্রো এবং জেন শব্দেই আছে গ্যাসের মানে। গ্রীক শব্দ ‘হাইড্রো’ মানে জল আর ‘জেন’ মানে তৈরি করে। অর্থাৎ হাইড্রোজেন গ্যাস জল তৈরি করতে পারে, ওয়াটার ফরমিং।

আড়াইশ বছরে পৃথিবীর ইতিহাসে বহু বদল ঘটেছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসও লাফ দিয়ে এগিয়েছে। একক ভরের হাইড্রোজেন থেকে 238 ভরের ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে আমারা জানি। পৃথিবীর যাবতীয় মৌলিক পদার্থের খবর মানুষের হাতে। মৌলিক পদার্থ তৈরি হয় পরমাণু দিয়ে। আর পরমানু তৈরি হয় প্রোটন নিউট্রন ইলেকট্রন দিয়ে। প্রোটন নিউট্রন থাকে পরমানুর নিউক্লিয়াসে আর ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরতে থাকে। সব চাইতে ছোট ভরের হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন আর বাইরে একটা ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াসে কখনও প্রোটনের সাথে একটা বা দুটো নিউট্রন থাকতে পারে। তখন ভর যেমন 2, 3-এ বদলে যায় তেমনি নাম পাল্টে হয়ে যায় ডয়টেরিয়াম (D) কিম্বা তেজস্ক্রিয় ট্রিসিয়াম (T)। ক্ষুদ্রতম ভরের হাইড্রোজেনের অন্য রকমফেরও আছে। অর্থো হাইড্রেোজেন এবং প্যারা হাইড্রোজেন। এদের সম্বন্ধে না বলে ক্ষুদ্রতম মৌল হাইড্রোজেনের কথা বলা যাক।

মানুষের অনেক কাজে লাগে হাইড্রোজেন। উদ্ভিদ, জীবজন্ত, মানব দেহের বেশিরভাগ যৌগ হাইড্রোজেন আর কার্বন দিয়ে তৈরি। আর শরীরের ষাট শতাংশ জল। হাইড্রোজেন ছাড়া জল তৈরি হবেই না। হাইড্রোজেনের সাথে চাপ দিয়ে নাইট্রোজেন যুক্ত করে তৈরি হয় অ্যামোনিয়া। অ্যামোনিয়ার যৌগ, অ্যামোনিয়াম সালফেট জমিতে সার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গুণের শেষ নেই হাল্কা গ্যাস হাইড্রোজেনের। ভবিষ্যতে যানবাহন চলবে হাইড্রোজেনের সাহায্যে। কেমন করে?

মহাকাশের রকেট তো হাইড্রোজেনকে ব্যবহার করে ছুটে চলে

আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (NASA) পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে মহাকাশ যানে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করছে হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন থেকে শক্তি উৎপাদন করে মহাকাশযান পৃথিবীর কক্ষপথ ডিঙ্গিয়ে মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রম করে ছুটছে অন্তরীক্ষে। ভারতের মহাকাশযান দুবছর আগে (2014 সাল) মঙ্গল গ্রহে পাড়ি দিল। রকেট বা মহাকাশ যানে পেট্রোল বা গ্যাসোলিন জ্বালানী ব্যবহার হয় না। এরা চলে হাইড্রোজেনকে দহন করিয়ে। কেমন করে? বদ্ধ জায়গায় হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের মধ্যে বিদ্যুৎ চালালে জল তৈরি হয়। আবার বিদ্যুৎ শক্তি জলের অনু ভেঙ্গে তৈরি করে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। হাইড্রোজেনকে অক্সিজেনের সংস্পর্শে জ্বালিয়ে দেওয়া হলে তৈরি হয় দূষণ মুক্ত শক্তি (উত্তাপ) আর জল। উৎপন্ন জল মহাকাশচারীরা পান করে। আর হাইড্রোজেন দহনে নির্গত তাপ শক্তিকে বিদ্যুতে রুপান্তরিত করে মাহাকাশচারীরা বহু কাজ সমাধা করেন। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর বড় চাহিদা বিকল্প শক্তি। কয়লা বা পেট্রলের মজুত ভাণ্ডার শেষ হয়ে যাচ্ছে। হাইড্রোজেন ব্যবহার করে বিকল্প শক্তি তৈরি করা সম্ভব। হাইড্রোজেন দহনে তৈরি হবে তাপ শক্তি। নির্গত হবে জলীয় বাষ্প। বাতাসে কোন বিষাক্ত গ্যাস ছড়াবে না। ভবিষ্যতে গাড়ির জ্বালানি ট্যাঙ্কে থাকবে তরল হাইড্রোজেন। বাতাসের সংস্পর্শে দহনের ফলে উৎপন্ন তাপ থেকে তৈরি হবে বিদ্যুৎ। পরীক্ষা মূলক ভাবে হাইড্রজেন-গাড়ি চালানো সম্ভব হয়েছে। গাড়ির জ্বালানি ট্যাঙ্কে হাইড্রোজেন মজুত রাখবার উন্নততর কৌশল তৈরি হচ্ছে। দুনিয়া জুড়ে এ নিয়ে বিষয়ে গবেষণা চলছে বিস্তর। ভারতও পিছিয়ে নেই।

ক্ষুদ্রতম হাইড্রোজেনের কেরামতি এখানেই শেষ নয়। হাইড্রোজেনকে কাজে লাগিয়ে সূর্যের অভ্যন্তরে তৈরি হয় ভয়ঙ্কর তাপ। সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রে চারটে হাইড্রোজেন পরমাণু যুক্ত হয়ে তৈরি করে এক পরমাণু হিলিয়াম। আর উৎপন্ন হয় প্রচন্ড তাপ। হাইড্রোজেন বোমার ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। হাইড্রোজেন পরমাণু জোড়া লেগে হিলিয়াম তৈরির প্রক্রিয়া। বিক্রিয়ায় নির্গত প্রচণ্ড শক্তি। এই শক্তিকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করা যায় আবার বিদ্যুৎ তৈরির মত প্রয়োজনীয় কাজেও। ধ্বংসাত্মক না সৃষ্টিশীল — কোন ধরনের কাজে আমরা ব্যবহার করবো ক্ষুদ্রতম মৌলের এই শক্তি?