Astronomy-জ্যোতির্বিজ্ঞান

বিস্ময় ভরা আর্দ্রা নক্ষত্র – কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

অনেকগুলি তারা নিয়ে গঠিত কালপুরুষ তারকামণ্ডল। এর সংস্কৃত নাম মৃগনক্ষত্র আর পাশ্চাত্য নাম ওরিয়ন (Orion)।

এই তারকামণ্ডলের ১৩ টি তারা পৃথিবী থেকে খুব সহজে খালি চোখে দেখা যায়। তারাগুলি কাল্পনিক রেখা দিয়ে যুক্ত করলে কালপুরুষ মণ্ডলে একটি পুরুষের আকৃতি লক্ষ করা যায়।

এর দক্ষিণ বাহুতে যে দুটি তারা আছে তার পূর্বেরটির নাম আর্দ্রা (Betelgeuse)। তাম্রবর্ণের এই বিশাল তারাটির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নানা বিস্ময়।

আর্দ্রা নক্ষত্রটি আমাদের কাছে নানা নামে পরিচিত। সংস্কৃতে একে অভিহিত করা হয়েছে ‘বাহু’ নামে (যেহেতু এই তারাটি কালপুরুষের একটি বাহুর উপর অবস্থিত)।

ইরানে পার্সীদের কাছে এর পরিচয় ছিল ‘বেস্‌ন’ নামে— যার অর্থ ‘বাহু’। ইউরোপে স্লোভেনদের (Sloven) কাছে এর নাম ছিল ‘বেটেল গেজা’ (Betelgeza)। আরব দুনিয়ায় তারাটি তিনটি নামে পরিচিত ছিল—

  • আল ধিরা (Al Dhira), যার অর্থ ‘বাহু’।
  • আল মান্‌কির (Al Mankib), অর্থ ‘স্কন্ধ’।
  • আল ইয়দ আল ইয়ম্মা (Al Yad al Yamma), অর্থাৎ দক্ষিণহস্ত।
  • কোপ্টিকদের কাছে আর্দ্রা পরিচিত ছিল ‘ক্লারিয়া’ (Klaria) নামে, যার অর্থ বাহুবন্ধনী (armlet)। ইউফ্রেতিস নদীর তীরে যারা বাস করত তারা এই তারাটিকে ডাকত ‘গুলা’ (Gula) নামে।

পৃথিবী থেকে তারাটির দূরত্ব প্রায় 427 ± 92 আলোকবর্ষ (131 পারসেক)। এত দূরে থাকা সত্বেও তারাটিকে কালপুরুষ মণ্ডলের অন্যান্য তারার তুলনায় যথেষ্ট বড় ও উজ্জ্বল দেখায়।

তারাটি কত বড় হতে পারে? উত্তর শুনলে অবাক হতে হয় বৈ কি। বৈজ্ঞানিকরা হিসেব করে দেখেছেন যে 16 কোটি সূর্য এই তারার ভিতর অনায়াসে ঢুকে যাবে। আর যদি পৃথিবীকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে প্রায় 20800000 কোটি পৃথিবী এর ভিতর এঁটে যাবে। এই হিসেব থেকেই বোঝা যায় তারাটি কত বড়। আমরা খালি চোখে আকাশে যত তারা দেখতে পাই তাদের মধ্যে আর্দ্রাই সবচেয়ে বড়।

Betelgeza compared to Earth & Jupiter | Image Source: Google

এত বড় তারা হয়েও আর্দ্রা সূর্যের চেয়ে ঠান্ডা। সূর্যের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা যেখানে 5800 কেলভিন সেখানে আর্দ্রার পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা 3100 কেলভিনের কাছাকাছি। এমনটা হওয়ার কারণ কী?

বৈজ্ঞানিকদের অনুমান আর্দ্রার হাইড্রোজেন জ্বালানী শেষ হয়ে গেছে, কেন্দ্রে এখন শুধু হিলিয়াম দহন চলছে। কম তাপমাত্রা আর বিশাল আকৃতির জন্য একে শীতল দানব তারা (cool supergiant star) বলা হয়ে থাকে। এই ধরনের তারা মহাকাশে খুব কম দেখা যায়।

বৃশ্চিক রাশিতে (constellation scorpio) এই ধরনের আরেকটি লাল বর্ণের তারা আছে। তার নাম জ্যেষ্ঠা (Antares)। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের ছায়াপথে প্রতি দশ লক্ষ তারার মধ্যে একটি এই ধরনের তারার সন্ধান মিলতে পারে।

অতি বৃহৎ তারা হওয়া সত্বেও আর্দ্রার ভর তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সূর্যের ভরের 20 গুণও নয়। এমনটা হওয়ার কারণ তারাটি প্রতি বছর 2×1024 কিলোগ্রাম ভর (0.000001 সৌরভর পরিমাণ পদার্থ) বাইরে নিক্ষেপ করে চলেছে। এই হিসেব থেকে অনুমাণ করা যায় যে জীবনের মূল পর্যায়ে তারাটির বর্তমান ভরের দ্বিগুণ ভর ছিল। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আর্দ্রার ব্যাস প্রায় 60%- এর মতো বাড়ে কমে। ফলে এর আকার-আয়তনেরও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।

আর্দ্রা নক্ষত্রকে ঘিরে আছে ধুলো ও গ্যাসের বলয়। একটা-দুটো নয়, অনেকগুলি। সবচেয়ে দূরের বলয়টি আছে নক্ষত্রটির কেন্দ্র থেকে 3.3 আলোকবর্ষ দূরে (1 আলোকবর্ষ= 950000 কোটি কিলোমিটার)। নক্ষত্রটির চারপাশে যে প্রধান ধূলিবলয়টি আছে তার ব্যাস বর্তমানে 0.3 আলোকবর্ষের মতো। এটা প্রতি সেকেন্ডে 10 কিলোমিটার বেগে প্রসারিত হচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা আর্দ্রার বর্ণমণ্ডলে যে গ্যাস আর ধুলো আছে তা নাক্ষত্রিক বাতাসে তাড়িত হয়ে এই ধুলোর বলয়গুলি সৃষ্টি হয়েছে। নক্ষত্রটির বর্ণমণ্ডলও কম বিস্ময়কর নয়। এর প্রান্তবর্তী অঞ্চলে গ্যাসের উষ্ণতা 2600 কেলভিনের মতো। আবার তার পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে 1500 কেলভিন উষ্ণতার অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ুস্রোত। এধরনের ঘটনা খুব কমই দেখা যায়।

আরেকটি বিস্ময়ের কথা বলবো। সেটা হল এর আবহমণ্ডল। সূর্যের আবহমণ্ডলের তুলনায় এর আবহমণ্ডল অত্যন্ত হালকা। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন আর্দ্রার আবহমণ্ডলের ঘনত্ব সূর্যের আবহমণ্ডলের তুলনায় দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। প্রকান্ড তারা হয়েও আদ্রার অন্যান্য বৈশিষ্টগুলি অবাক করার মতো, তাই নয়?

তবে এই বিশাল তারাটির বর্ণমণ্ডলটি বিশাল। কত বড় হতে পারে? গণিতের হিসেবে না গিয়ে অন্যভাবে ধারণাটা দেবার চেষ্টা করছি। সূর্য ও আর্দ্রার মধ্যে যদি স্থান পরিবর্তন করা যায় অর্থাৎ আর্দ্রাকে যদি সূর্যের জায়গায় বসানো যায় তাহলে নক্ষত্রটির বর্ণমণ্ডলের সীমা নেপচুন এবং প্লুটোর কক্ষপথের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবী আর্দ্রার পেটের ভিতর ঢুকে যাবে।

আর্দ্রা একটি বিষমতারা (variable star)। এর দীপ্তি বাড়ে কমে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এর প্রভার মান 0.2 থেকে 1.2 এর মধ্যে ওঠানামা করে। এর দুটি সঙ্গী তারা আছে। প্রথমটি 5 A.U. দূর থেকে এবং দ্বিতীয়টি 45 A.U. দূর থেকে আর্দ্রার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।

জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে’— এ কথা বিশ্ববাসীদের কাছে এমন সত্য মহাবিশ্ববাসীদের কাছেও তেমন সত্য। আর্দ্রাও এগিয়ে চলেছে এই শেষ পরিণতির দিকে। আগেই বলেছি তারাটির কেন্দ্রে এখন চলছে হিলিয়াম দহন। এই দহন শেষ হলে এটি নিয়ন-অক্সিজেন শ্বেত বামনে (Ne-O white dwarf) রূপান্তরিত হবে। তখন এর আকার সঙ্কুচিত হতে হতে পৃথিবীর মতো হবে। এই সময় এর ঘনত্ব এবং ঔজ্জ্বল্য অবিশ্বাস্য রকম বেড়ে যাবে।

The red supergiant star Betelgeuse, in the constellation of Orion, has been undergoing unprecedented dimming. This stunning image of the star’s surface, taken with the SPHERE instrument on ESO’s Very Large Telescope late last year, is among the first observations to come out of an observing campaign aimed at understanding why the star is becoming fainter. When compared with the image taken in January 2019, it shows how much the star has faded and how its apparent shape has changed. | Image Source: ESO/M. Montargès et al

কয়েকটি পর্যায় পেরিয়ে আর্দ্রা নক্ষত্র সুপারনোভার দিকে এগোতে থাকবে।

নক্ষত্রটির কেন্দ্রে এখন হিলিয়াম দহন চলছে। কেন্দ্রের তাপমাত্রা 60 কোটি কেলভিনে পৌঁছলে শুরু হবে কার্বন দহন এবং তৈরি হবে নিয়ন আর হিলিয়াম। এই পর্যায়টা চলবে 600 বছর ধরে।

এরপরে তাপমাত্রা 120 কোটি কেলভিনে পৌঁছলে শুরু হবে নিয়ন দহন এবং তৈরি হবে ম্যাগনেসিয়াম ও অক্সিজেন। মাত্র এক বছর পরেই কেন্দ্রের তাপমাত্রা পৌঁছে যাবে 150 কোটি কেলভিনে। শুরু হবে অক্সিজেন দহন আর সেই সঙ্গে তৈরি হবে সিলিকন ও হিলিয়াম।

ছয় মাস পরে কেন্দ্রের তাপমাত্রা যখন 270 কোটি কেলভিনে পৌঁছবে তখন সিলিকন পুড়ে তৈরি হবে নিকেল যা নিউট্রনাইজেশন (Neutronization) হয়ে লোহায় রূপান্তরিত হবে। ব্যাস দহন শেষ। কেন্দ্রে যত লোহা জমতে থাকবে অভিকর্ষ চাপ তত বাড়তে থাকবে। ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধির ফলে নক্ষত্রটির কেন্দ্রের ঘনত্ব এক সময় প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে 3×109 গ্রামে পৌঁছে যাবে।

নক্ষত্রটির এই অতি ঘন অবস্থাটা কেমন হবে তা সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি। লুডো খেলার ছক্কার আয়তনের সমপরিমাণ পদার্থ তুলে আমরা আমাদের হাতের তালুতে রাখতে পারব না। কারণ ওইটুকু পদার্থের ভর হবে তিন লক্ষ কিলোগ্রামের মতো।

এবারে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে কী প্রচন্ড চাপ তৈরি হবে নক্ষত্রটির কেন্দ্রে। কেন্দ্রের ভর ও ব্যাস যথাক্রমে এক সৌরভরের বেশি ও তিন হাজার কিলোমিটার হলে প্রচন্ড অভিকর্ষীয় চাপে ঘটবে বিস্ফোরণ যা সুপারনোভা নামে পরিচিত। চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে গামা রশ্মি।

বিজ্ঞানীদের মতে এটি হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর সুপারনোভা। বিস্ফোরণের ঠিক পর মুহূর্তে (এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ে) তাপমাত্রা পৌঁছে যাবে 500 কেলভিনে। সেইসঙ্গে শেষ হবে আদ্রা নক্ষত্রের জীবনকাল। তবে সেটা হতে এখনও অনেক দেরি। আমরা কেউই দেখে যেতে পারব না। আশঙ্কা হয়, যে হারে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে তাতে সেইসময় মানুষের অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকবে কিনা।