Life Science-জীববিজ্ঞান

শ্রীমান কোপিনা আর্‌নোল্‌ডি – কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রীমান কোপিনা (Copeina arnoldi / Copella arnoldi) থাকে দক্ষিণ আমেরিকায়। আমাজন ও তার শাখা নদীতে সুখে শান্তিতেই আছে। খাচ্ছে-দাচ্ছে, নদীতে সাঁতার কাটছে, আর প্রজনন ঋতু এলে শ্রীমতী কোপিনার সঙ্গে সংসার ধর্ম পালন করছে।

তবে ভয় যে একেবারে নেই তা নয়। শত্রুর আক্রমণে মাঝে মধ্যে কপাৎ-কোঁৎ হয়ে তাদের পেটে চালান হয়ে যায়। এমন দুর্ঘটনা তো একটু-আধটু ঘটতেই পারে। অত ভয় করলে কি চলে? তাহলে তো বেঁচে থাকাই দায়। মানুষ তো অত বুদ্ধিমান জীব। তাদের কি দুর্ঘটনা ঘটে না? আর দুর্ঘটনা মানেই তো চিৎপটাং। যাইহোক, অতসত ভেবে লাভ নেই। বেঁচে থাকতে হলে ওসব মেনে নিতে হয়।

স্থানীয় লোকেরা এই মাছকে ‘কোপিনা আর্‌নোল্‌ডি’ বলে না, বলে ‘চ্যারাসিন’। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এরা নিজেদের খুব বুদ্ধিমান বলে মনে করে। হাসি পাচ্ছে? তা পেতে পারে। মাছের আবার বুদ্ধি কিসের? উহুঁ বাবা, অত আন্ডার এস্টিমেট করা ঠিক নয়।

এরা কোথায় থাকে তা তো জানা আছে। ভয়াল আমাজন নদীতে। কত শত্রু ওৎ পেতে বসে আছে। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে বেঁচে থাকা কি চাট্টিখানি কথা? আমি-তুমি কি পারতাম? দুদিন পরেই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে পালানোর পথ খুঁজতে হত। কোপিনাদের বুদ্ধির দৌড় এখনই কী দেখলেন? আসল চমক অপেক্ষা করে আছে যখন ওদের সন্তান লালন-পালনের কথা বলব।

ভবঘুরেদের ঘরসংসার থাকে না। শ্রীমান কোপিনারা তো আর ভবঘুরে নয়? প্রকৃতির নিয়ম মেনেই তারা সংসার ধর্ম পালন করে। তাই সময় হলেই তাদের বেরিয়ে পড়তে হয় পাত্রীর খোঁজে।

এদের সমাজে অবশ্য শ্রীমতীরাই পাত্র নির্বাচন করে। তাই শ্রীমতীদের মন জয় করার জন্য শ্রীমানদের অনেক কসরৎ শিখতে হয়। প্রয়োজনে নাচ গানও একটু-আধটু করতে হয়। জানা তো নেই কোন শ্রীমতী কী পছন্দ করে?

যাইহোক, দেখাশোনা, মন দেয়া-নেয়ার পর শ্রীমতী চলল শ্রীমানের সঙ্গে ঘর বাঁধতে। শ্রীমান কি আগে থেকেই সুন্দর একটি বাসা বানিয়ে রেখেচগে? মোটেই না। খেটে খুটে ঘরদোর বানানো শ্রীমান কোপিনাদের ধাতে নেই। এরা মনে করে ওগুলো পণ্ডশ্রম। ক’দিনের ঘর সংসার, তার জন্য কে অত খাটে? শ্রীমতীরা এতে মনে কিছু করে না। তখন তারা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। শ্রীমান যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই সে থাকতে রাজী।

আন্দাজ করুন তো, কোথায় নিয়ে যেতে পারে? শ্রীমতীকে নিয়ে শ্রীমান এমন জায়গায় চলে যায় যেখানে কোনো গাছের পাতা বা ডাল জলের থেকে মাত্র এক কী দুই ইঞ্চি উপরে ঝুলছে। জলের নীচে এত জায়গা থাকতে দুজনে এখানে এল কেন?

ঘরবাড়ি বানানো হয় নি। শ্রীমতী ডিম পাড়বে কোথায়? ছেলেমেয়দের নিরাপদে রাখতে হবে তো? এখানেই তো কোপিনাদের বুদ্ধির চমক। ঐ যে জলের ঠিক উপরেই গাছের পাতাটা মৃদু হাওয়ায় ধীরে ধীরে দুলছে ওটাই তো হবে শ্রীমতীর ডিম পাড়ার জায়গা। কচিকাঁচারাও ওখানে নিরাপদে থাকতে পারবে। জলের শত্রুরা ওদের নাগালই পাবে না। জলের নীচে থেকে ফ্যালফ্যাল করে দেখবে আর লালা ঝড়াবে। কিছুই করতে পারবে না। কেমন বুদ্ধির প্যাঁচ কষেছি বল?

ডিম পাড়ার কায়দাটাও বেশ মজার। দু’জন দু’জনকে পাখনা দিয়ে সাপটে ধরে দে-লাফ। হুস্‌ করে জলের উপর উঠে পাতাটার উপর গিয়ে পড়ে। হাত-পা তো নেই? পাখনা দিয়েই ঝটাপটি করে কোনোমতে পাতাটাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। সেই ফাঁকেই শ্রীমতী কাজ সেরে ফেলে।

Copeina arnoldi mating | Image Source: Google

পাতার উপর এক দঙ্গল ডিম পাড়ে। তারপর আবার ঝপাং করে জলে। একবারে হয় না। বার কয়েক লাফ মারতে হয়। প্রতিবারই শ্রীমতী পাতাটার উপর কিছু না কিছু ডিম পাড়ে। পাতায় আটকে ডিমগুলো ঝুলতে থাকে জলের উপর। যেন দোলনায় দোল খেতে খেতে ঘুমোচ্ছে ছেলেপুলেরা।

দুশমনরা ঘুরপাক খেতে খেতে জলের নীচ থেকে দেখে যাচ্ছে। যদি দু-একটা টুপটাপ জলে এসে পড়ে। বৃথাই চেয়ে থাকা। পাতায় সেঁটে আটকে আছে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

Copeina arnoldi eggs |Image Source: Google

ডিম তো পাড়া হল। ডিম ফুটে বাচ্চা বের না হওয়া পর্যন্ত তাদের দেখাশোনা তো করতে হবে যাতে ডিমগুলো নষ্ট না হয়ে যায়। তাই বাবা-মার দায়িত্ব এখন অনেক। বয়েই গেছে শ্রীমতীর এই দায়িত্ব নিতে। ডিম পাড়া শেষ, তারও কাজ শেষ। এবার ঘর-সংসার মিন্‌সে একা সামলাক।

কোপিনা শ্রীমানরা কিন্তু এ নিয়ে ঝগড়াঝাটি করে না। বাচ্চা বড় করার সমস্ত দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে শ্রীমতীদের ছুটি দিয়ে দেয়। শ্রীমতীরাও আর অপেক্ষা করে না- দে-চম্পট।

শত্রুর হাত থেকে তো ডিমগুলো বাঁচলো। কিন্তু আমাজনের গরম হাওয়ায় সেগুলো যে শুকিয়ে আমসি হয়ে যাবে? ম্যায় হুঁ না? শ্রীমানের সেদিকে সজাগ দৃষ্টি। মাঝে মধ্যেই পাতার নীচে এসে ল্যাজের ঝাপটায় জল ছিটিয়ে ডিমগুলো ভিজিয়ে দেয়। মাত্র তিন দিনের ব্যাপার তো? বাবা হয়ে মা-হারা সন্তানদের জন্য এইটুকু কষ্ট স্বীকার করতে পারবে না?

শিশু কোপিনারা জন্মেই মনে করে তারা বড় হয়ে গেছে। বাবার শাসনে থাকা, নৈবচ। তাই ডিমের খোলস ছেড়ে টুপটাপ জলে পড়েই বাবাকে বলে- “ড্যাড, টা… টা… বাই… বাই…”।