Physics-পদার্থবিজ্ঞান

প্লাজমা অবস্থা – ইন্দ্রনীল মজুমদার

আচ্ছা, বস্তুর বিভিন্ন অবস্থা(State)-এর নাম কী কী? অনেকেই হয়তো এই প্রশ্নের উত্তরে বলবেনঃ-‘বস্তু তিন প্রকারঅবস্থায় পাওয়া যায়। যথা কঠিন (Solid), তরল (Liquid) ও বায়বীয় বা গ্যাস (Gas)।’ কিন্তু এতে প্রশ্নটির উত্তর যথাযথ পাওয়া গেল কি?

উত্তর হল ‘না’। বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে আমরা বলতে পারি যে,উল্লেখিত অবস্থাগুলি ছাড়াও আরো তিন রকমের অবস্থার কথা জানা গিয়েছে। যথাঃ- প্লাজমা (Plasma), বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন (Bose-Einstein Condensation) এবং অতিপরিবাহীতা (Superconductivity)। এখন আমরা আলোচনা করব বস্তুর এই চতুর্থ অবস্থা অর্থাৎ প্লাজমা অবস্থা নিয়ে। তার আগে দু-একটি কথা বলে নেওয়া যাক। আমরা সকলেই জানি যে প্রতিটা বস্তুর মধ্যে অণু (molecule) বর্তমান। অণুর মধ্যে রয়েছে পরমাণু (atom)। কঠিন অবস্থার ক্ষেত্রে অণুরা রয়েছে একেবারে আঁটোসাঁটো ভাবে। অর্থাৎ তারা যে খোলাখুলি ভাবে চলে ফিরে বেড়াবে তার উপায় নেই। এক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে তাদের মধ্যে আন্তঃ-আণবিক বল (Intermolecular force) বেশী এবং আন্তঃ-আণবিক দেশ (Intermolecular space) একেবারে কম বা নেই বললেই চলে। তাইতো, এই অবস্থার নাম যে কঠিন! এবার আসি তরল অবস্থার কথায়। সেখানে অণুদের কঠিন অবস্থার মতো অমন করুণ অবস্থা না হলেও তারা পুরোপুরি খোলামেলায় থাকে না। কিছুটা হলেও ফাঁক থাকে তাদের মধ্যে। অর্থাৎ, এদের মধ্যে আন্তঃ-আণবিক দেশ বেশি এবং আন্তঃ-আণবিক বল কম।

গ্যাসের অণুদের তো আরো বিন্দাস অবস্থা। তাদের মধ্যে আন্তঃ-আণবিক বল নেই বললেই চলে অর্থাৎ, তারা যে যার মতো হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে। যার ফলে, তাদের মধ্যে আন্তঃ-আণবিক দেশ বিপুল। তাহলে, আমরা দেখলাম যে অণুদের আন্তঃ-আণবিক বল ও আন্তঃ-আণবিক দেশ এই দুটোর সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক। একটা কমলে অন্যটা বাড়ে। এই আন্তঃ-আণবিক দেশ বাড়ানো যায় তাপের ফলে। অর্থাৎ, বস্তুর উপর তাপ দিলে অণুরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারফলে, তারা ছোটাছুটি করতে শুরু করে এবং তাদের মধ্যে আন্তঃ-আণবিক বল কমে যায়। এই তাপের ফলেই বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। একটি উদাহরণের মারফতে বিষয়টি বুঝিয়ে দিই। ধরা যাক, একটি বরফের টুকরো (কঠিন বস্তু) নেওয়া হল এবং সেটাকে তাপ দেওয়া হল বা গরম করা হল তবে সেটি জলে (তরল অবস্থায়) পরিণত হবে। আরোও তাপ দিলে তা জলীয় বাষ্পে (গ্যাসে) রূপান্তরিত হবে। আবার, তাপ শুষে বা ঠান্ডা করলে জলীয় বাষ্প জলে পরিণত হবে আবার আরো ঠান্ডা করলে তরল জল কঠিন বরফে পুনরায় রূপান্তরিত হবে। বোঝাই যাচ্ছে যে, বস্তুর অবস্থার রূপান্তর তাপ শক্তির খেলা বই বিশেষ কিছু নয়। এইবার, আসল কথায় আসি। তার আগে পরমাণুর অন্দরমহলে ঘুরে আসা যাক। অণুদের ভাঙলে পরমাণুদের পাওয়া যায়। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস যা আধানহীন নিউট্রন ও ধনাত্মক আধানযুক্ত প্রোটন কণাদের নিয়ে গঠিত আর এই কেন্দ্রের চারপাশের কক্ষগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঋনাত্বক আধানযুক্ত ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াস এই ইলেকট্রনদের এক আকর্ষণীয় বলের মাধ্যমে ধরে রেখে দিয়েছে। তবে, যে সমস্ত ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি কক্ষে আছে তাদের উপর আকর্ষণ বল বেশি কাজ করে, যে দূরে আছে তার উপর কম। অতিরিক্ত তাপ দিলে দূরের বা একদম শেষের কক্ষে বসবাসকা্রি ইলেকট্রন বা ইলেকট্রনের দল পরমাণু থেকে ছিটকে বেড়িয়ে যায়। সেক্ষেত্রে, পরমাণু আর পরমাণু থাকে না ‘আয়ন’ হয়ে যায় আর এই প্রক্রিয়াটিকে বলে ‘আয়নিত’ করা। মনে করা যাক, কোনো এক ক্লাসরুমের কথা যার বাইরে বা শেষ বেঞ্চের কাছে দরজা আছে। এবার যেইসব ছাত্র মাস্টারমশাইয়ের কাছাকাছি বসেছে তারা মন দিয়ে পড়া শুনছে বা একটি বাঁধনে বা শৃঙ্খলায় আছে। দূরের বেঞ্চে যারা বসেছে তারা মাস্টারমশাইয়ের পড়ায় অতটা মন দিচ্ছে না। আবার এদিকে মাস্টারমশাইয়েরও আছে ঢিলেমি ভাব। তাই, যদি শেষ বেঞ্চে যে বা যারা বসেছে তারা যদি লোভনীয় বস্তু দেখতে পায় তবে ক্লাস ছেড়ে তারা পালাবে। এক্ষেত্রে ‘মাস্টারমশাই’ হলেন নিউক্লিয়াস, ‘ছাত্ররা’ ইলেকট্রনের দল ও ‘লোভনীয় বস্তু’ হল তাপ বা শক্তি। সাধারণত পরমাণুতে ইলেকট্রনের সংখ্যা ও প্রোটনের সংখ্যা এক থাকে আর সেজন্যই পরমাণু আধানহীন হয়ে থাকে। ইলেকট্রন জুড়লে বা ছাড়লে পরমাণু হয়ে ওঠে আয়ন অর্থাৎ চার্জযুক্ত পরমাণুকে বলা হয় আয়ন। ইলেকট্রন জুড়লে হয় anion (ঋণাত্মক আয়ন) আর ছাড়লে হয় cation (ধনাত্মক আয়ন)। এইবার পদার্থের চতুর্থ অবস্থা প্লাজমার কথায় আসি।

আচ্ছা, আমরা তো দেখলাম যে তাপের সাহায্যে বস্তুর রকমফের ঘটানো আবার এই তাপের সাহায্যেই পরমাণুকে আয়নিত করানোর কথা। আমরা এখন যদি ভাবি যে গ্যাসকে অতিরিক্ত তাপ দিলে সেক্ষেত্রে কি হবে? সেক্ষেত্রে, গ্যাসের পরমাণু থেকে ইলেকট্রন ছিটকে বেড়িয়ে যাবে আর ধনাত্মক আয়ন আর ইলেকট্রনের দল ঘুরে ফিরে হেসে-খেলে বেড়াবে যেমন গ্যাসের মধ্যে থাকা কণাদের মতো। এক্ষেত্রে, বস্তুর এরকম দশাটিকে বলা হয় ‘প্লাজমা অবস্থা (Plasma state)’। বলাই যায় যে প্লাজমায় কণাগুলি না অণু না পরমাণু, এরা ধনাত্মক আয়ন এবং ইলেকট্রনের দল। তাই, প্লাজমাকে তৈরি করার জন্য পরমাণুকে আয়নিত (এক্ষেত্রে ইলেকট্রনকে সরিয়ে দেবার মতো) অতি উচ্চ তাপমাত্রা দরকার। মজার কথা এই যে, আমাদের পৃথিবীর মাটিতে এই প্লাজমা দেখা না গেলেও, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের 99% বস্তুকেই প্লাজমা অবস্থয় দেখা যায়। নক্ষত্ররা সবাই প্লাজমা অবস্থাতেই থাকে তাদের উত্তাপের দরুন। ধূমকেতুর লেজ, মেরুপ্রভা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সবাই প্লাজমার দলে পড়ে। প্লাজমাদের কণাগুলি যেহেতু বৈদ্যুতিকভাবে আধানযুক্ত থাকে তাই প্লাজমারা বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়।

বর্তমান যুগে প্লাজমা অবস্থা নিয়ে এবং তাদের প্রয়োগমূলক এবং নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নিয়ে নানা গবেষণা চলছে। নিউক্লিয়ার ফিউশনের মারফতে প্রচুর শক্তির সাথে সাথে প্লাজমাদেরও তৈরি করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আশা করা যায় যে ভবিষ্যতে প্লাজমা বিষয়ে আরোও অনেক গবেষণা হবে এবং ‘প্লাজমা পদার্থবিদ্যা (Plasma Physics)’- এর এক নব দিক উন্মোচিত হবে।