পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে ভয়াবহ ও মারাত্মক অ-পারমাণবিক বিস্ফোরণ
১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সালে ঘটে যাওয়া পুলওয়ামায়ায় ঘটানো বিধ্বংসী বিস্ফোরণের ভয়াবহ স্মৃতি প্রতি মূহুর্ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের আজও। আর একই সঙ্গে মনে এসে ভীড় করছে অতীতে ঘটে যাওয়া এমনই আরো অনেক ভয়াবহ বিস্ফোরণের কথা। নিয়মমাফিক অনুসন্ধান ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সেই সমস্ত বিস্ফোরণের কারণও আমরা জেনেছি। কিন্তু তবুও বারে বারে ঘটে চলেছে একই রকমের ধ্বংস আর হত্যালীলা। চরম উদাসীন ও অপদার্থ এই গ্রহের মানুষ আমরা – ব্যার্থ হয়েছি এই বিস্ফোরণের পরম্পরা রুখতে।
এই বিস্ফোরণের ইতিহাস কিন্তু খুব নতুন নয়। আসুন কয়েক দশক পিছিয়ে যাই। 1947 এর 16ই এপ্রিল। স্থান.. আমেরিকার টেক্সাস বন্দর। একটি কোমল রৌদ্রস্নাত সুন্দর সকাল। বন্দরে নোঙর করে আছে একটি মালবাহী জাহাজ – ‘S.S.Grandcamp’। জাহাজটি বোঝাই করা হয়েছে এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নামক একটি রাসায়নিক যৌগ দ্বারা। সারা বিশ্বে এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এটি অতি পরিচিত ও বহুল ব্যাবহৃত উৎকৃষ্ট রাসায়নিক সার হিসেবে চিহ্নিত। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়ার কথা জাহাজটির। সহসা ঘটল এক চরম বিপর্যয়, যা আজ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে ভয়াবহ ও মারাত্মক non-nuclear explosion হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আর এই বিস্ফোরণ আমেরিকার ইতিহাসে সবচাইতে মারাত্মক lndustrial explosion হিসেবে কুখ্যাত।
কি ভাবে ঘটল এই বিস্ফোরণ?
কারণ হল ঐ জাহাজেরই এক কর্মী খুব সম্ভবত ধূমপান অন্তে জ্বলন্ত সিগারেটের শেষ অংশটুকু হেলায় ছুঁড়ে ফেলেছিল কাগজের বস্তাবন্দি এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট’এর স্তুপের ওপর…. তবে সে নিশ্চিতই নিজে তাকিয়ে দেখার সুযোগ টুকুও পায়নি তার মারাত্মক কুকর্মের ফলের বিশালতার। প্রায় 600 লোকের প্রাণহানি ঘটে এবং হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়। এমনই শক্তিশালী ছিল এই বিস্ফোরণ যে নিকটস্থ আরো একটি এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বোঝাই জাহাজ..’High Flyer’, মূহুর্তে এই বিস্ফোরণের গ্রাসে আক্রান্ত ও সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, বন্দরের নিকটে অবস্থিত অনেকগুলি তৈল শোধনাগারের সবকটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। জাহাজের 5 টন ওজনের একটি মাস্তুল উপরে গিয়ে পড়ে দুমাইল দূরে। ঐ সময়ে বন্দরে কর্তব্যরত একজন কর্মীও প্রাণে বাঁচেন নি।
এবার একটু দেখা যাক কি এই এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট যৌগ… যা একাধারে একটি উৎকৃষ্ট সার এবং বহু বিধ্বংসী বিস্ফোরণের নায়ক। এ হল রসায়নের রহস্যময়তা। আসুন একটু অনুসন্ধান করা যাক।
এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট যৌগটি একটি আপাত নিরীহ সাদা গুঁড়ো লবন এবং সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হল যৌগটি নিজে অদাহ্য। তাহলে যৌগটি এত বিশাল বিস্ফোরণের ও অগ্নি সংযোগের কারণ হল কি করে?
আসলে এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট একটি অতি শক্তিশালী জারক পদার্থ (oxidising agent)। তাই সে অন্য দাহ্য পদার্থ যেমন কাগজ, তেল, কাঠ ইত্যাদির দহনের অত্যন্ত সহায়ক হয়।
অল্প/ অনুচ্চ তাপে প্রথমে এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিযোজিত হয়ে (thermal decomposition) নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস ও জলীয় বাষ্প উৎপন্ন করে। কিন্তু এই বিয়োজন বিক্রিয়াটি অতিমাত্রায় তাপ উৎপাদক (highly exothermic)। তাই প্রাথমিক পর্বে উৎপাদিত যথেষ্ট পরিমাণ তাপ এর দ্বারা সংশ্লিষ্ট দাহ্য বস্তু সমূহ জ্বলতে শুরু করে এবং এর ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। এই বিপুল পরিমান তাপ জন্ম দেয় একটি স্বতঃ প্রনোদিত শৃঙ্খল বিক্রিয়ার (self sustaining chain reaction)। এর ফলে একটি আবদ্ধ সীমিত আয়তনের মধ্যে বিপুল পরিমান এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত থাকায় (high concentration condition) বিক্রিয়া রূপ নেয় এক মারাত্মক বিস্ফোরণের।
এই বিস্ফোরক ধর্মের জন্য এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট শুধুমাত্র উৎকৃষ্ট সার হিসেবেই নয়; Mining, quarrying & civil construction (উপযুক্ত পরিভাষা করতে অসমর্থ হওয়ার জন্য দুঃখিত। কেউ যদি করে দেন বাধিত হব)ইত্যাদি বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে এর বহুল ব্যাবহার প্রচলিত আছে। আর এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট’এর এই বিস্ফোরক ধর্মকেই বেছে নিয়েছে দুষ্কৃতকারীর দল তাদের কুকর্ম সিদ্ধ করতে।
বছরের পর বছর ঘটিয়ে চলেছে একের পর এক বিধ্বংসী বিস্ফোরণ অবলীলায় …অতি সহজেই (যদিও আইনতঃ সম্ভব নয়) তারা সংগ্রহ করে ফেলে বিপুল পরিমাণ এ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং ঘটিয়ে চলেছে একের পর এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ।
আমরা সাধারণ মানুষ ক্ষোভে দুঃখে আর নিষ্ফল আক্রোশে দুচার দিন লাফালাফি করি। তারপর আবার ফিরে আসি জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে। আর ওদিকে দুষ্কৃতকারীর দল নিশ্চিন্তে ছক কষে পরবর্তী বিস্ফোরণের স্থান, কাল ও পাত্রের।
ড. অঞ্জনা ঘোষ: বিজ্ঞান লেখিকা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অজৈব রসায়নে পিএইচডি | বর্তমানে অশোক হল বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সিনিয়র বিভাগ)-এর শিক্ষিকা।