নোবেলজয়ী ‘ক্যানাডিয়ান-আমেরিকান মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট’ সিডনি অলটম্যান
সিডনে অলটম্যানের জন্ম ১৯৩৯ সালের ৭ মে। বাবা মা দুজনেই ছিলেন ইমিগ্রেন্টস। বাবা ইউক্রেন থেকে আর মা এসেছিলেন রাশিয়ান-পোলিশ বর্ডার থেকে। বাবা ছিলেন একজন কৃষি শ্রমিক। একটি লটকনে (গ্রসারি) দোকানও চালাতেন। অলটম্যানের মা প্রথমে একটি বস্ত্র কারখানার একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। সিডনি আর তার দাদা দুজনেই তখন খুব ছোটো; তাই বাধ্য হয়েই মা’কে সে কাজ ছাড়তে হয়। স্বভাবতই সিডনির ছেলেবেলায় ওদের পরিবারে অভাব আর দারিদ্র্য ঘিরে ছিল। উপার্জনের এক মাত্র জায়গা – বাবার ওই দোকানটি। সেই টাকাতেই চলে পরিবারের যাবতীয় খরচ।
কয়েক বছরের মধ্যে বাবার গ্রসারি দোকানের ব্যবসা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেল। স্বাচ্ছন্দ্য এল। তারপর থেকে পরিবারে সুরাহা হল। এবার আর সিডনির হাই-স্কুলে পড়াশোনা চালানোর ক্ষেত্রে আর কোনো অসুবিধা থাকল না।
কে এই সিডনি অলটম্যান? ভবিষ্যৎ যার পরিচয় লিখবে – নোবেলজয়ী ‘ক্যানাডিয়ান-আমেরিকান মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট’ হিসেবে। এবার সংক্ষেপে তাঁর আবিষ্কারের কথা বলার চেষ্টা করি সকলের বোঝার মতন করে। তার আগে একটু প্রেক্ষাপট বলে নেওয়া দরকার। কোন জায়গায় দাঁড়িয়েছিল সে সময়ের জীববিজ্ঞানের জ্ঞান।
ষাটের দশকের আগেই বিজ্ঞানীরা জেনে গিয়েছিলেন যে, লম্বা প্যাঁচানো চেনের মতন DNA আর RNA অণুর কথা। এছাড়াও, জানা ছিল – ‘এনজাইম’ (বায়ো-ক্যাটালিস্ট) – এর কথাও। যা হল এক বিশেষ ধরনের পদার্থ, যারা শরীরের কোষের মধ্যে বিভিন্ন প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সংঘটিত করতে পারে। এনজাইম ছাড়া শরীরের কোশগুলির কোনো বিক্রিয়াই সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা জানতেন সব ‘এনজাইম’-ই ‘প্রোটিন’ গোত্রের হয়।
এই ধারণা আমূল বদলে গেল সত্তরের দশকে এসে। জানা গেল যে, এক বিশেষ ধরনের ‘আরএনএ’ (RNA) আছে, যাদের মধ্যেও রয়েছে ‘ক্যাটালাইটিক ক্ষমতা’। অর্থাৎ বিশেষ ধরনের ওই ‘আরএনএ’ অণুর উপস্থিতির কথা জানা গেল, যারা এনজাইমের মতন কাজ করতে সক্ষম। অর্থাৎ, ওই বিশেষ ধরনের RNAগুলির ক্যাটালাইটিক ক্ষমতা রয়েছে যারা ‘প্রোটিন’ গোত্রের নয়। এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের এতদিনের ধারণার ভিত নাড়িয়ে দিল।
এই অভাবনীয় সত্যটি প্রথম উন্মোচিত করেন – সিডনি অলটম্যান। এ নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন সত্তর দশকের একদম শুরুর দিকে। প্রায় দু-দশক ধরে গবেষণা চালিয়ে অলটম্যান আবিষ্কার করেন ‘catalytic properties of RNA’ । অলটম্যান তখন আমেরিকার ‘ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে’ অধ্যাপনা করছেন। এই রকম ক্যাটালাইটিক ক্ষমতা সম্পন্ন ‘আরএনএ’- ‘রাইবোজাইম’ নামে পরিচিত।
অনেকেই ‘রাইবোজোম’ এর নাম শুনেছি। ‘রাইবোজাইম’ এর সঙ্গে যাতে গুলিয়ে না যায়, তাই আলাদা করে আর একটু বলি। কোশের মধ্যে নানান প্রকোষ্ঠ থাকে। বিভিন্ন প্রকোষ্ঠের বিভিন্ন কাজ। আর সবের মধ্যে রয়েছে নিপুণ সমন্বয় ব্যবস্থা। এভাবেই চলে কোশের কার্যকলাপ। সেরকমই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকোষ্ঠ হল ‘রাইবোজোম’, একটি ‘আণবিক মেশিন’। রাইবোজোম-এর মধ্যেই ‘প্রোটিন সিনথিসিস’ – এর কাজ সংঘটিত হয়। ‘রাইবোজোম’ হল বেশ বড়সড় একটি স্পেসালাইজড-‘RNA ও প্রোটিন-এর কমপ্লেক্স’। আর এই ‘রাইবোজোম’-এর অন্তর্গত একটি বিশেষ এবং ছোট্ট অংশ-ই হল ‘রাইবোজাইম’। যার মধ্যে রয়েছে এনজাইম-এর কার্যকরী ক্ষমতা (catalytic power)। ‘রাইবোজাইম’ কে তাই ‘ক্যাটালাইটিক আরএনএ’ বলে। প্রোটিন সিনথিসিসে অংশ নেওয়া ছাড়াও রাইবোজাইমের আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
আবার অলটম্যানের আবিষ্কারে ফিরে আসি। আরএনএ – তা আবার কী করে এনজাইমের মতন কাজ করবে! দীর্ঘ সময়ের বিজ্ঞানীদের গড়ে ওঠার ধারণা ভেঙ্গে গেলে যা হয় তাই হল শুরুতে। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই মেনে নিতে পারলেন না অলটম্যানের কাজ। অলটম্যান পরে এ নিয়ে বলেছেন এক জায়গায় – ‘I tried to get people to take notice, but no one would listen.’। যাই হোক, বেশ কয়েক বছর পরে যখন অন্য একটি ল্যাবরেটরি থেকে স্বাধীনভাবে গবেষণা করে বিষয়টি আবার উঠে এল, তখন আবার বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসলেন। অন্য যে বিজ্ঞানীর কথা বললাম তিনি আমেরিকার কলরেডো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত রসায়নবিদ অধ্যাপক টমাস চেক।
টমাস ঠিক কী করেছিলেন তা সংক্ষেপে একটু বলার চেষ্টা করি। তিনি অন্য আর একটি দিক দেখালেন, যাতে জানা গেল RNA-র ‘উৎসেচক ধর্ম’ যা RNA অণুকে কাটতে এবং জুড়তে (যাকে splicing বলা হয়) পারে। তাই রাইবোজাইমের মূল দুটি ধর্ম হল – ‘রাইবজোম’ প্রকোষ্ঠের মধ্যে প্রোটিন তৈরি করার ক্ষেত্রে দুটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের মধ্যে সংযোগকারী বন্ধন (peptide bond) তৈরি করা। এবং দ্বিতীয়টি হল – RNA splicing বা কাটা – যে কাজটি কোশের কেন্দ্রে (nucleus) সংঘটিত হয়।
পৃথিবীতে কোন বায়োলজিক্যাল অণু প্রথম এসেছিল? এই নিয়ে দীর্ঘ সময়ের বিতর্ক বিজ্ঞানীদের। এক দল বলেন- প্রোটিন। অন্য দলটি বলেন- না, প্রোটিন নয়, ডিএনএ-ই হল আদি প্রাণ অণু। কারণ ডিএনএ-র মধ্যেই তো রয়েছে প্রোটিন তৈরি হওয়ার সংকেত। ‘ক্যাটালাইটিক আরএনএ আবিষ্কার’ আমদানি করল নতুন মতবাদের। পৃথিবীর আদি অণু হল – আরএনএ। অলটম্যান এবং টমাসের আবিষ্কার থেকেই ‘RNA world’ মতবাদের প্রবর্তন হয়। অর্থাৎ ‘পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির প্রথমে RNA-ই ছিল প্রথম অণু ।
আরএনএ অণুর এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার কথা আণবিক জীববিদ্যার ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, তাঁদের ক্যাটালাইটিক আরএনএ-র এই যুগান্তকারী আবিষ্কার শুধু বায়ো-সায়েন্সের সেন্ট্রাল ডগমা-কে বদলে দিল।বস্তুত অলটম্যান ও টমাসের এই দিগদর্শী আবিষ্কার আধুনিক জীববিদ্যার সমস্ত টেক্সট-বইয়ের একাধিক সংশ্লিষ্ট চ্যাপ্টারগুলি নতুন করে সংশোধন করতে হল। তাঁদের আবিষ্কার জেনেটিক ইনজিনিয়ারিং বিভাগের ক্ষেত্র প্রসারিত করে তুলতে সমর্থ হল। ভাইরাল সংক্রমণের ক্ষেত্রে প্রতিরোধের নতুন দিশা দেখাবে।
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্যে ১৯৮৯ সালে রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগে সিডনি অলটম্যান পেয়েছেন নোবেল পুরষ্কার। যুগ্মভাবে সেবার নোবেল পান টমাস।
ড. সিদ্ধার্থ মজুমদার: বিজ্ঞান গবেষক এবং বিজ্ঞান প্রশাসক, অ্যাকাডেমিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগ, সিএস.আই.আর.-আই.আই.সি.বি. (অবসরপ্রাপ্ত)