সরীসৃপ সংবাদ – ২
সরীসৃপদের শীত-সহনক্ষমতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয় গাছ থেকে পড়ে যাওয়া নির্জীব হিমশীতল এক গিরগিটি
দক্ষিণ ফ্লোরিডায় এই দশকের সবথেকে শীতলতম রাতটি কেটে যাবার পর, খেজুর গাছ থেকে পরপর গিরগিটিদের চার পা তুলে মাটিতে পড়তে দেখা যায়। এই ভূপতিত সরীসৃপদের নিয়ে অনুসন্ধানরত বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে এইসব নিরক্ষীয় শীতলশোণিত প্রাণীরা শীতে অনেক বেশি নমনীয় হয়ে উঠেছে। এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীদের গিরগিটিদের সম্বন্ধে আগের সমস্ত ধারণা পাল্টে দিয়েছে।
মানবসৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তনে চরম প্রতিকূল আবহাওয়ায় কীভাবে এইরকম জীব-প্রজাতি প্রতিক্রিয়া দেয় তার উপরেও আলোকপাত করেছে এই অনুসন্ধান। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই সম্ভবত বিশ্বের সার্বিক তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিজ্ঞানীরা ভাবছেন উষ্ণ স্রোত, শৈত্য প্রবাহ, খরা এবং প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো চরম প্রতিকূলতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে পারে।
সরীসৃপ সংক্রান্ত গবেষণায় এক নতুন দিশা
বিবর্তনিক পরিবেশবিদ জেমস স্ট্রাউড (James Stroud) দক্ষিণ মিয়ামির একটি দ্বীপ কি বিস্ক্যেন-এ (Key Biscayne) থাকা তাঁর এক বন্ধুর থেকে যখন রাস্তার পাশে পড়ে থাকা প্রায় ৬০ সেমি দীর্ঘ ইগুয়ানার একটি ছবি পান, তখন তিনি বেশ অবাকই হন। এর ফলে সরীসৃপদের নিয়ে এক নতুন ধারণার জন্ম হয়।
সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ জেমস স্ট্রাউড বলেন, ‘বাতাসের তাপমাত্রা যখন স্বাভাবিক মাত্রার থেকে অনেক কমে যায় তখন গিরগিটিরা গমনক্ষমতা হারায়’। এমনকী গাছে রাত কাটানো গিরগিটিরা গাছের ডাল আঁকড়ে থাকতে পারে না। তাদের দৃঢ় মুষ্টি আলগা হয়ে যায় ও মাটিতে পড়ে যায়। ভূপতিত গিরগিটিগুলি তখন শিকারিদের কাছে সহজলভ্য শিকারে পরিণত হতে দেখেছেন স্ট্রাউড। বলা বাহুল্য, দক্ষিণ মিয়ামির ঘটনাটির আগের দিন রাতে কি বিস্ক্যেন দ্বীপে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) নীচে।
তিনি বুঝতে পেরেছেন যে এই তীব্র শৈত্য প্রবাহ থেকেই গবেষণার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরো চরম প্রতিকূল আবহাওয়া এইরকম প্রাণীদের উপর কী প্রভাব ফেলবে তা নির্ণয় করা যেতে পারে। সেইসময় মিয়ামি এলাকায় স্ট্রাউড এবং তাঁর সহকর্মীরা যত বেশি সম্ভব নানা প্রজাতির গিরগিটির মতো জীবন্ত নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
এরপরে গবেষকরা ঐ অঞ্চল থেকে পাওয়া ছয়টি প্রজাতির গিরগিটির উপর পরীক্ষা চালালেন। তাঁরা সেগুলিকে বরফের বিশাল শীতলক (cooler)-এর মধ্যে রেখে সেগুলির গায়ে থার্মোমিটার লাগিয়ে দেখতে চাইলেন যে শীতকালে গিরগিটিগুলি ঠিক কতটা উষ্ণতা সহ্য করতে পারে এবং ঠিক কতটা ঠাণ্ডায় তারা নির্জীব হিমশীতল হয়ে পড়ে। যখন তাদের উল্টেপাল্টে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হয়।
২০১৬ সালে ঠিক একই রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছিল এই সমস্ত প্রজাতির গিরগিটিদের উপর যা থেকে জানা যায় যে সাম্প্রতিকতম গিরগিটির উদাহরণের মতোই এই প্রকার সরীসৃপগুলিও তীব্র শৈত্য প্রবাহ সহ্য নাও করতে পারে। গিরগিটিগুলির শীতসহনক্ষমতার মাত্রা মোটামুটিভাবে পুয়ের্তো রিকান ক্রেস্টেড অ্যানোলের (Anolis cristatellus) ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৭.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বাদামী ব্যাসিলিস্কের ক্ষেত্রে (Basiliscus vittatus) সর্বোচ্চ আনুমানিক ১১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে।
অতিরিক্ত শীত সহ্য করে সেই পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য সরীসৃপদের দেহে ঘটেছে পরিবর্তন
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে সরীসৃপেরা আরো আনুমানিক ১ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম উষ্ণতা সহ্য করতে পারে এবং এই আবিষ্কারের খবর গবেষকরা জানিয়েছেন অক্টোবর মাসে প্রকাশিত বায়োলজি লেটারস-এ। এইসব গিরগিটির প্রজাতির মধ্যে আকারগত, বাস্তুতান্ত্রিক এবং শারীরবৃত্তীয় নানাবিধ ফারাক রয়েছে বিস্তর। স্ট্রাউড জানাচ্ছেন, ‘এই আবিষ্কারের ফলাফল সত্যই অপ্রত্যাশিত, কোনো গবেষকের কাছেই এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই’।
প্রাকৃতিক নির্বাচনই হয়তো এই পার্থক্যের মূলে। অস্বাভাবিক মাত্রায় শীতে যারা বেঁচে থাকতে পারবে না তারাই মারা যাচ্ছে আর যাদের মধ্যে এমন প্রতিকূলতাতেও তুলনায় বেশি টিকে থাকার ক্ষমতা রয়েছে তারা রয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, অতিরিক্ত শীত সহ্য করা এবং সেই পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য সরীসৃপদের দেহেও কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। স্ট্রাউড আশা করছেন খুব শীঘ্রই কোনো বিশেষ শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস ছাড়াই তিনি ভবিষ্যতে গিরগিটির শীতসহনক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারবেন এবং তার পরেই সেই পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার সহায়ক রূপে তার দৈহিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘসময় ধরে চিন্তা-ভাবনা করেছেন নিরক্ষীয় প্রজাতিগুলিকে নিয়ে যেগুলি সাধারণত স্থিতিশীল তাপমাত্রায় অভ্যস্ত, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তনে এই প্রজাতিগুলিই হয়তো দূর্বল প্রমাণিত হতে পারে। এই নতুন গবেষণা দেখাচ্ছে যে হয় কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রজাতিগুলি খুব দ্রুত বিবর্তিত বা অভ্যস্ত হয়ে পড়বে অথবা চরম আবহাওয়াতে প্রজাতিগুলির বাস্তুতন্ত্রেও নমনীয়তা দেখা দেবে, এমনটাই মত লণ্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের পরিবেশবিদ অ্যালেক্স পিগটের যিনি সরাসরি এই গবেষণায় অংশ নেননি।
তবে শেষে পিগট একটি প্রশ্ন রেখেছেন – এই একইরকম নমনীয়তা কি উচ্চ তাপমাত্রার মতো চরম আবহাওয়াতেও দেখা যাবে গিরগিটিগুলির মধ্যে? তার মতে, ‘আগের সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী উচ্চ তাপমাত্রা সূচকের তুলনায় নিম্ন তাপমাত্রাতেই এই প্রজাতিগুলি বেশি নমনীয়’।
সীমন রায়: জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখালেখি।