অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল প্রতিরোধ
অ্যান্টিবায়োটিক…চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক সর্বোত্তম আবিস্কার!
সেই সুদূর ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিস্কারের পথ বেয়ে বহু জীবনদায়ী অ্যান্টিবায়োটিক এর আবিস্কার ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাদের সফল প্রয়োগ সমগ্র চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অতি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে আজ কিন্তু পরিস্থিতি বেশ কিছুটা পাল্টেছে। মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক’-এর ব্যাবহার, self medication (অনেক সময়েই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন/ বহু অ্যান্টিবায়োটিকই available over the counter) ইত্যাদির ফলে আজ আমরা এমন এক সংকটের সম্মুখীন যা কিন্তু মোটেই অগ্রাহ্য করার মত নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO এর পরিসংখ্যান অনুযায়ি আধুনিক বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া এক বড় সমস্যা।
কি এই অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল প্রতিরোধ?
WHO প্রদত্ত সঙ্গা অনুযায়ী কোন একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিব্যায়োটিক যখন দীর্ঘদিন/মাত্রাতিরিক্ত ভাবে অথবা অপ্রয়োজনীয় ভাবে শরীরে প্রবেশ করে তখন সেই শরীরে থাকা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াগুলি (pathogenic bacteria) ধীরে ধীরে এক রকমের ডিফেন্স মেকানিজম গড়ে তোলে … যার ফলে ঐ অ্যান্টিব্যায়োটিক যা অতীতে একসময়ে ঐ একই ব্যাকটেরিয়াগুলিকে ধ্বংস করতে পারতো এখন আর সেভাবে কার্যকরী হয়না।
মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিব্যায়োটিক সেবনের ফলে কিছু প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া মরে যায় ঠিকই কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয় এবং এরা ক্রমশ বংশ বৃদ্ধি (multiply) করে। কোন কোন প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া আবার তাদের ড্রাগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও সঞ্চারিত করে। আসলে মানুষ বা গৃহপালিত পশু, যাদের শরীরে অ্যান্টিব্যায়োটিক প্রয়োগ করা হয় তারা কিন্তু অ্যান্টিব্যায়োটিক প্রতিরোধী হয়না।
প্রতিরোধী হয় মানুষ বা পশুর দেহে থাকা ব্যাকটেরিয়া.. আর এইসব প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া মানুষ ও পশুর দেহে নানা রোগের সংক্রমণ ঘটায়। এইসব অ্যান্টিব্যায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রান্ত রোগ অনেক বেশি জটিল হয়। এইসব অ্যান্টিব্যায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত রোগ ই হল যাকে আমরা বলি হসপিটাল সংক্রমণ (hospital infection)। এই হসপিটাল সংক্রমণ অনেক বেশি জটিল হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে বাঁচানো দুষ্কর হয়ে ওঠে। এছাড়াও এই হসপিটাল সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীকে অনেক দীর্ঘ সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়… যা রোগীর ওপর অতিরিক্ত মানসিক এবং আর্থিক চাপের কারণ হয়।
তবে বিজ্ঞানের গবেষণা তো কখনোই থেমে থাকেনা। মানব সভ্যতার অগ্রগতির এক প্রধান শর্তই তো নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যা সাধারণ মানুষের মঙ্গলে নিয়োজিত হয়, জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করে। আর এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করি … আজ বিশ্বের বহু দেশেই চিকিৎসক ও গবেষকরা নিয়োজিত আছেন ‘অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল প্রতিরোধ’এর বিরুদ্ধে লড়াই-এ। এমনই এক সফল গবেষণার কথা এখানে বলব।
‘অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল প্রতিরোধ’এর বিরুদ্ধে লড়াই
সুইডেনের চেলমার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মার্টিন অ্যান্ডারসন এর নেতৃত্বে একদল গবেষক বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে চলেছেন … প্রধানত অস্ত্রোপচার পরবর্তী ক্ষত বা post surgical wounds (a very big concern in many hospitals) ও অন্যান্য গভীর ক্ষতের দ্রুত ও উপযুক্ত নিরাময় পদ্ধতি নিয়ে। অ্যান্ডারসন গ্রুপের এই দীর্ঘ গবেষণার ফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ACS Biomaterials Science & Engineering জার্নালে।
এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষতস্থান নিরাময়ের জন্য প্রচলিত যে সমস্ত অ্যান্টিব্যায়োটিক ব্যবহৃত হয় – সেই সমস্ত অ্যান্টিব্যায়োটিকের বিরূদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলোর চরিত্র/গতিবিধি/কার্যকারণ এবং সর্বোপরি এই সমস্ত প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করার উপযুক্ত অ্যান্টিব্যায়োটিক অষুধের খোঁজ।
অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হাইড্রোজেল ও অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল পেপটাইড
গবেষকদের দীর্ঘ পরিশ্রম, মেধা আর তীব্র অনুসন্ধিৎসা অবশেষে তাঁদের সাফল্যের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। এরা প্রস্তুত করেছেন এক বিশেষ ধরনের হাইড্রোজেল যা ক্ষতস্থানের ওপর প্রয়োগ করলে তা শুধুমাত্র প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়াগুলোকেই ধ্বংস করেনা, একই সাথে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। কি বিশেষত্ব এই হাইড্রোজেলের?
খুব সংক্ষেপে বলি.. এই নতুন আবিষ্কৃত অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হাইড্রোজেল প্রস্তুত করা হয়েছে একাধিক অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল পেপটাইডের সংযোগে। আর পেপটাইড গুলোর প্রত্যেকটাই কিন্ত আমাদের ইমিউন সিস্টেমের মধ্যে বর্তমান।
বস্তুত পেপটাইডের অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ধর্ম সম্পর্কে বেশ কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা অবহিত আছেন। আর এই পেপটাইডদের আরও একটা বিশেষত্ব হল এরা যখন কোন ব্যাকটেরিয়া কে আক্রমণ করে তখন শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়ার কোষের সবচাইতে বাইরের প্রাচীর (outermost cell membrane) প্রভাবিত হয়। পেপটাইডদেরএই bacterial Surface attack এর ব্যাপারটা গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এর কারণ পরবর্তী অংশের ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট হবে।
পেপটাইড কী?
পেপটাইড হল খুব কম দৈর্ঘ্যের অ্যামিনো অ্যাসিড সিকোয়েন্সের প্রোটিন(সীমিত সংখ্যক অ্যামিনো অ্যাসিড ইউনিট পরস্পর জুড়ে থাকে পেপটাইড বন্ডের মাধ্যমে)।
দীর্ঘদিন ধরে গবেষকরা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন… কি করে এই ছোট ছোট পেপটাইডগুলোকে সফলভাবে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা যায়। কারণ এই প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রধান সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল তা হল… এই পেপটাইডগুলো যখনই বডি ফ্লুইড/ রক্তের সংস্পর্শে আসে পেপটাইডগুলো ভেঙে যায়।
তবে প্রফেসর অ্যান্ডারসন ও তাঁর সহযোগী গবেষকদল অবশেষে এই সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ হয়েছেন … smart solution প্রয়োগ করে অর্থাৎ তাঁরা তৈরি করেছেন ন্যানোস্ট্রাকচার হাইড্রোজেল। তাঁরা দেখেছেন .. এই ন্যানোস্ট্রাকচার হাইড্রোজেলের সংস্পর্শে পেপটাইডগুলো স্থায়ী ভাবে ক্ষতস্থানে/শরীরে যুক্ত হতে পারে। গবেষকদল দাবি করেছেন … এই বিশেষ ভাবে প্রস্তুত হাইড্রোজেল ক্ষতস্থানে প্রয়োগ করলে তা প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করার পাশাপাশি প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়।
বিশেষ ভাবে প্রস্তুত হাইড্রোজেল প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয় কি ভাবে?
খুব সংক্ষেপে বলি…ব্যাকটেরিয়াল কোষের একদম বাইরের দিকের প্রাচীর(outermost cell membrane) এর গা’এ(surface এ) বেশ কিছু সংখ্যক efflux pump যুক্ত থাকে (চিত্রে দ্রষ্টব্য) যেগুলোর মাধ্যমে কোষের নানা প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পাদিত হয়। প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলো এই efflux pump এর কিছু সংখ্যক কে ব্যবহার করে অ্যান্টিব্যায়োটিকের অণু গুলোকে পাম্প আউট করে ব্যাকটেরিয়ার কোষ থেকে বের করে দেয়। এর ফলে ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরের অ্যান্টিব্যায়োটিকের পরিমাণ কমে যায় .. ফলে অ্যান্টিব্যায়োটিকের কাজ করার ক্ষমতাও কমে যায়।
আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার ডি এন এ ‘র মিউটেশন এর ফলে অতিরিক্ত efflux pump তৈরি হয় যার ফলে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল প্রতিরোধ আরো জোরদার হয়।
কোন কোন প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া আবার এক বিশেষ ধরনের এনজাইম উৎপন্ন করে। এই এনজাইম গুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাহায্যে অ্যান্টিব্যায়োটিকের অনুগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় যাতে তারা ব্যাকটেরিয়ার কোষের দেওয়াল ভেদ করে নির্দিষ্ট টার্গেট এ পৌঁছতে না পারে।
ফিরে আসি আরও একবার হাইড্রোজেল প্রসঙ্গে। অ্যান্ডারসন গ্রুপের দাবি …এই হাইড্রোজেল সম্পূর্ণ ভাবে প্রিভেন্টিভ এবং নন- টক্সিক। এটা সরাসরি চামড়ার ওপর নিরাপদে(safely) প্রয়োগ করা যায়। ইতিমধ্যেই এই নতুন আবিষ্কৃত ন্যানোস্ট্রাকচার হাইড্রোজেলের clinical trial শুরু হয়েছে। ইউরোপের অনেক veterinary clinic এ এই হাইড্রোজেল প্যাচ গৃহপালিত পশুর ওপর প্রয়োগ ও পর্যবেক্ষণ চলছে।
অ্যান্ডারসন ও তাঁর সহযোগী গবেষক দলের মতে ন্যানোস্ট্রাকচার হাইড্রোজেল প্যাচ এমন এক মেডিক্যাল ডিভাইস যার মাধ্যমে অ্যান্টিমাইক্রোব্যায়াল পেপটাইডের সর্বপ্রথম সফল প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে..Clinically as well as commercially.
নব আবিষ্কৃত এই ন্যানোস্ট্রাকচার হাইড্রোজেল এর নির্মাণ ও সফল প্রয়োগ বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিমাইক্রোব্যায়াল প্রতিরোধী সংক্রমণ-এর সমস্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট আশার সঞ্চার করেছে।
ড. অঞ্জনা ঘোষ: বিজ্ঞান লেখিকা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অজৈব রসায়নে পিএইচডি | বর্তমানে অশোক হল বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সিনিয়র বিভাগ)-এর শিক্ষিকা।