কিংবদন্তি এক বাঙালি স্থাপত্যবিদের কাহিনী
আমরা সবাই জানি যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতে বাঙালি জাতির অবদান অপরিসীম। প্রযুক্তির জগতে যেসব বাঙালি কৌশলী শ্রেষ্ঠত্বের অবদান রেখে গেছেন তাঁদের মধ্যে ডক্টর এফ.আর. খান অন্যতম। ডক্টর এফ.আর. খান, যাঁর পুরো নাম ডক্টর ফজলুর রহমান খান (Dr. Fazlur Rahman Khan), হলেন বিশ্ব বিখ্যাত বাঙালি স্থপতি, পুরকৌশলী। তাঁর জন্ম হয় ৩রা এপ্রিল,১৯২৯ সালে ঢাকায়। তাই বলা যায়, কিছুদিন আগেই আমরা তাঁর ৯০তম জন্মবার্ষিকী পার করে এলাম। তাঁর পিতা খান বাহাদুর রহমান ছিলেন শিক্ষাবিদ। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার শিবচর থানার ভান্ডারিকান্দি গ্রামে।
এফ.আর. খান ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক (যা এখনকার এস.এস.সি) এবং ১৯৪৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক(যা এখনকার এইচ.এস.সি) উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ(যার বর্তমান নাম আইআইইএসটি)-এ ভর্তি হন। কিন্তু, ১৯৪৬ সাল থেকে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাংলা সহ গোটা দেশ জর্জরিত ছিল যার আঁচ ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা ও বিভাজনের পরেও লেগেছিল। তাই, ১৯৫০ সালে দাঙ্গার কারণে তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছেড়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়ে ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ(বর্তমান যার নাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট)-এ ভর্তি হন এবং সেখানকার পরীক্ষায় পুরকৌশল(সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এসসি. (ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি এরপর আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই লেকচারার হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৫৩ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে ‘থিওরিটিক্যাল অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স’- এই বিষয়ে এম.এস. ডিগ্রি লাভ করেন।
এম.এস. পাশ করার পর তিনি প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা ‘Skidmore Owinge and Merrill (SOM)’-এ যোগদান করেন। এই পদে থাকাকালীনই ১৯৫৭ সালে তিনি প্রণয়ন করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রাকপীড়নকৃত (prestressed) কংক্রিটের রেলসেতুর ডিজাইন। এই ১৯৫৭ সালেই তিনি দেশে ফিরে ‘করাচী ডেভেলপমেন্ট অথরীটী’-তে কিছুদিন কাজ করে আবার তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে SOM কোম্পানিতে যোগদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে,ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি১৯৬০ সালে ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ‘Adjunct professor of Architecture’ পদে অধিষ্ঠিত হন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। SOM প্রতিষ্ঠানে তাঁর ক্রমাগত পদোন্নতি হওয়ার দরুন ১৯৭০ সালে ওই প্রতিষ্ঠানে অংশীদার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
এবার, আলোচনা করা যাক তাঁর স্থাপত্যের অবদান নিয়ে। তিনি নির্মাণ-পদ্ধতির ক্ষেত্রে নলাকৃতি (Tubular)-এর বিন্যাস উদ্ভাবনের জন্য বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছেন। এছাড়াও, তিনি বিশ্বের উচ্চতম ভবনের ডিজাইনার হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ব্বোচ্চ এবং আমেরিকার সর্ব্বোচ্চ ভবন সিয়ার্স টাওয়ার (Sears Tower)-এর নকশার প্রণেতা তিনি। এই ভবনের মোট উচ্চতা ৪৪৩ মিটার বা ১৪৫৪ ফুট। ১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার (যার উচ্চতা ৪৫০ মিটার) উদ্বোধন হওয়ার আগে সিয়ার্স টাওয়ারই ছিল বলা যায় বিশ্বের সর্ব্বোচ্চ ভবন। মোট কথা, বলতে পারি তিনি তাঁর জীবদ্দশ্যায় তাঁর ডিজাইনে গড়া সিয়ার্স টাওয়ারকেই বিশ্বের উচ্চতম টাওয়ার হিসেবে দেখে গেছেন। এর চেয়ে গর্বের আর কি কিছু আছে?
সিয়ার্স টাওয়ার ছাড়াও তাঁর করা অনবদ্য ডিজাইনের নিদর্শন হল জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হজ্ব টার্মিনালের পঞ্চাশ হাজার বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট বৃহত্তম ছাদ কাঠামো প্রণয়ন করা যার জন্য তিনি সম্মানীয় ‘আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার’ লাভ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য এই যে এই হজ টার্মিনালটিতে ৮০,০০০ হজ যাত্রী যেখানে একত্রে একনাগাড়ে ৩৬ ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে সক্ষম। আলোচিত দুই স্থাপত্য নিদর্শন ছাড়াও তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য অবদানগুলি প্রকাশিত হয়ে থাকে একশো তলা বিশিষ্ট জন হ্যানকক সেন্টার এবং মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য মডেলের প্রণয়ন করার মাধ্যমে।
১৯৭২ সালে এফ.আর. খান ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডে ‘Construction Man of the Year’ হিসেবে অ্যাখ্যা লাভ করেছিলেন। শুধু সেইবার নয়, মোট চারবার তিনি এই সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লি হাই বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইস ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ ও ১৯৮০ সালে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক গগনচুম্বী ভবন ও নগরায়ণ পরিষদের চেয়ারম্যান রূপে পদলাভ করেছিলেন। ইসলামীয় স্থাপত্য নিয়ে তাঁর নানা ধরনের গবেষণা আছে যার দরুন তিনি ‘স্টাডিজ ইন ইসলামীক আর্কিটেকচার’ -এর উপদেষ্টা হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ‘International Council of Tall Building and Urban Habitat’ উঁচু ভবনের ডিজাইন সম্পর্কিত যে মনোগ্রাফ পাঁচ খণ্ডে প্রকাশ করেছে তার অন্যতম প্রধান সম্পাদক হিসেবে ছিলেন এফ. আর. খান।
প্রকৌশলের দুনিয়ায় তাঁর অবদান তো আমরা দেখলাম। এখানে জানিয়ে রাখা দরকার যে প্রকৌশলের দুনিয়ার দিক্পাল ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন যা ভোলার নয়।সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সিয়ার্স টাওয়ার ডিজাইন করছিলেন কিন্তু বারবার ডিজাইনের কাজ ফেলে রেখে আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন এক স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলার জন্য।
১৯৮২ সালের ২৬শে মার্চ (বাংলাদেশ স্বাধীনতা দিবসে) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জেদ্দায়(সেই জেদ্দায় যেখানে তাঁর স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে) তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান, রেখে যান তাঁর ডিজাইনে গড়া অনবদ্য স্থাপত্যগুলি যা যুগের পর যুগ আকৃষ্ট করবে স্থাপত্যে আগ্রহী বিশ্বের সমস্ত মানুষকে।বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে তাঁকে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদক’ দান করে এবং সেই বছরেই তাঁর স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।৪ টাকা মূল্যের সেই ডাকটিকিটে তাঁর আবক্ষ চিত্রের সাথে পটভূমিতে রয়েছে তাঁরই গড়া সিয়ার্স টাওয়ারের ছবি। তাঁর কর্ম,অবদান ও সম্মান আমাদের সবার গর্বের নিদর্শন। তিনি বাংলার গর্ব, তাঁর প্রতি রইলো দুই বাংলার আপামর বাঙালির শ্রদ্ধার্ঘ্য।
ইন্দ্রনীল মজুমদার: বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর, বর্তমানে বিজ্ঞান লেখক।