মৌলের রূপবৈচিত্র্য
মৌলিক পদার্থ
রসায়নের প্রাথমিক পাঠ। সজ্ঞা অনুসারে মৌলিক পদার্থ সরলতম পদার্থ কারণ এরা গঠিত হয় মাত্র একরকমেরই পরমাণু দ্বারা। তাই বলেই মৌলরা (অধিকাংশই) অত সহজ সরল বস্তু নয় কিন্তু। বর্ণে, ছন্দে, চাকচিক্যে, গঠনের বৈচিত্র্যে রসায়ন জগতকে সমৃদ্ধ আর আকর্ষণীয় করে তুলতে মৌলদের ভূমিকাও কিছু কম নয়। বর্তমান উপস্থাপনায় আমি তেমনই একটি মৌলের খবর নিয়ে হাজির হয়েছি।
মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে একটা পর্যবেক্ষণের কথা বলি।
- 12 গ্রাম বিশুদ্ধ চারকোল
- 12 গ্রাম বিশুদ্ধ গ্রাফাইট
- 12 গ্রাম বিশুদ্ধ হিরে
- 12 গ্রাম বিশুদ্ধ ভুসোকালি (lamp black/soot)
এদের প্রত্যেকটিকে আলাদা করে বিশুদ্ধ ও শুষ্ক অক্সিজেনের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে পোড়ালে(দহন) প্রত্যেকেই উৎপন্ন করবে 44 গ্রাম বিশুদ্ধ কারবনডাইঅকসাইড গ্যাস(অবশ্যই দহনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার পরিমাণ প্রত্যেকের জন্য আলাদা হবে)। দহন শেষে কারো ক্ষেত্রেই কঠিন বা তরল কোনো অবশেষই থাকবে না। খুব আশ্চর্য লাগছে কি। হাঁ… রসায়নের ভুবনে আশ্চর্যের বিষয়ের অন্ত নেই।
আসলে ওপরের পর্যবেক্ষণে সব ক’টি বস্তুই মৌল হিসাবে এক… কার্বন।
অমূল্য হিরেই বলুন আর ভুসোকালিই বলুন। মৌল হিসেবে উভয়েই কার্বন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাহলে ‘হিরে’ কেন ‘হিরে’ আর ‘ভুসোকালি’ কেন ‘ভুসোকালি’? কারণ একটাই … হিরে, গ্রাফাইট, চারকোল, ভুসোকালি… মৌল হিসাবে সবাই কার্বন হলেও এদের মধ্যস্থ কার্বনের পরমাণুগুলির ‘সজ্জা-বিন্যাস’ এর পার্থক্যই এদের অন্তর্গঠন ও বহিরঙ্গের ফারাকের মূল কারণ।
মৌলিক পদার্থের এই যে ধর্ম অর্থাৎ, একই মৌলের বিভিন্ন রূপে অবস্থান এবং এই বিভিন্ন রূপগুলির ভৌত ধর্মসমূহ সম্পূর্ণ আলাদা (রাসায়নিক ধর্ম যদিও মোটামুটি এক, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু রাসায়নিক ধর্মের পার্থক্যও থাকে)। মৌলের এই ধর্ম-কে বলে ‘বহুরূপতা’ (Allotropy) নামে পরিচিত। আর একই মৌলের বিভিন্ন রূপগুলির প্রত্যেকটিকে বলা হয় ঐ মৌলের ‘রূপভেদ’ (allotrope)।
আশ্চর্যের বিষয় হল… একই কার্বন পরমাণুর সমাহারে তৈরি হিরে হল কঠিনতম পদার্থ, অষ্টতল(সামান্য বিচ্যুতিসহ) স্ফটিক, অতি উজ্জ্বল আকর্ষণীয় উপস্থিতি। বিদ্যুতের অপরিবাহী… ‘ডায়মন্ড কিউবিক’ নামে পরিচিত। মো’র স্কেলে হিরের কাঠিন্য 10।
এদিকে গ্রাফাইটের স্ফটিক তৈরি হয়েছে একেবারে ভিন্ন ধরনের কার্বন সজ্জায়। গ্রাফাইট স্ফটিক বহুতল বিশিষ্ট … 6টি করে কার্বন পরমাণু দ্বারা তৈরি একাধিক ষড়ভূজ পরস্পরে যুক্ত হয়ে এক একটি তল সৃষ্টি হয়েছে (hexagonal layered sheet structure) আর এই একাধিক তলগুলির মধ্যে যে ফাঁক (গ্যাপ) আছে.. তার কারণেই গ্রাফাইট হিরের মতো কাঠিন্য লাভ করতে অক্ষম। মো’র স্কেলে গ্রাফাইটের কাঠিন্য 1-2, এছাড়াও গ্রাফাইট বিদ্যুতের অত্যন্ত সুপরিবাহী। আর বাকি দুই রূপভেদ … চারকোল ও ভুসোকালি… এরা অনিয়তাকার (amorphous)…. নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই।
তবে বহু পরিচিত এই রূপভেদগুলি ছাড়াও কার্বনের আরও একটি রূপভেদ আবিষ্কৃত হয়েছে। 1985 সালে তিন বিজ্ঞানী.. রবার্ট কারল, হ্যারল্ড ক্রোটো ও রিচার্ড স্মলি… এঁদের সমবেত প্রচেষ্টা ও গবেষণার ফলে সন্ধান মেলে কার্বনের আর একটি অপরূপ ‘রূপভেদ’ এর।
গ্রাফাইট কে প্রথমে লেসার রশ্মির সাহায্যে বাষ্পীভূত (LASER evaporation technique) করে তারপরে ঐ বাষ্পের সুদীর্ঘ বিশ্লেষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার শেষে 1985 সালে তাঁরা আবিষ্কার করেন কার্বনের আর একটি রূপভেদ.. C60 (আণবিক ভর 720)। এরপর আরও বিস্তৃত ও গভীর অনুসন্ধানের শেষে 1990 সালে এই C60 অণুর গঠণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা উপলব্ধ হয়।
দৃশ্যত এই C60 অণু ঠিক যেন একটি চিত্রিত ফুটবল। আকারে স্ফেরয়ডাল, আসলে প্রতিটি C60 স্ফেরয়ডাল অণু 20টি ষড়ভূজ আর 12টি পঞ্চভূজের সমাহারে তৈরি এক একটি icosahedron যার 60 টি শীর্ষ বিন্দু এবং প্রত্যেক শীর্ষ বিন্দু দখল কর আছে এক একটি কার্বন পরমাণু(নীচের চিত্রে দ্রষ্টব্য)। প্রখ্যাত আমেরিকান আর্কিটেক্ট বাক মিনিস্টার ফুলার’-এর (Richard Buckminster Fuller) ডিজাইন করা domed structure এর সঙ্গে সাদৃশ্য থাকার কারণে কার্বনের এই নতুন আবিষ্কৃত রূপভেদটির নামকরণ হয়… বাকমিনিস্টার ফুলারিন।
এই অপরূপ ‘রূপভেদ’টি আবিষ্কারের জন্য ঐ তিন বিজ্ঞানী 1996 সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কার্বনের এই C60 অণুর আবিষ্কার রসায়নের গবেষণার এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়। এই C60 অণুর গবেষণার পথ অনুসরণ করে পরবর্তীকালে কার্বনের আরও কয়েকটি প্রায় একই গঠনের (কোনো কোনোটা আবার নলাকৃতি/tubular) রূপভেদ আবিষ্কৃত হয়। এই ঘরানার প্রায় সমগঠনের সবগুলি রূপভেদকে সমষ্টিগত ভাবে বলা হয় ‘ফুলারিনস’ (Fullerenes)। এই ফুলারিনস তাদের বিশিষ্ট গঠনের কারণে শক্তিশালী antiviral, antioxidant, antidamaging এজেন্ট হিসাবে কাজ করতে সক্ষম। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞান ও কসমেটিক দুনিয়ায় এই ফুলারিনস’এর খুব কদর।
এই ফুলারিনস’এর মতোই না জানি আরও কত মৌলের কত মূল্যবান রূপভেদ প্রকৃতির বুকে লুকিয়ে আছে… এখনো আমরা তার খোঁজ পাইনি। তবে রসায়নের গভীর গহীন সমুদ্রে অভিযান … সে তো জারি আছেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আর নতুন নতুন আবিষ্কারের উত্তেজনা, আনন্দ আর পরিতৃপ্তি একদিকে যেমন গবেষক বিজ্ঞানীদের আরও নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় উজ্জীবিত রাখবে তেমন আমরা সাধারণ মানুষ সেইসব
মহামূল্যবান আবিষ্কারের সুফলগুলি ভোগ করে ধন্য ও কৃতজ্ঞ থাকব।
ড. অঞ্জনা ঘোষ: বিজ্ঞান লেখিকা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অজৈব রসায়নে পিএইচডি | বর্তমানে অশোক হল বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সিনিয়র বিভাগ)-এর শিক্ষিকা।