জীবাণু-কিছু কথা
সর্বত্র শিটিয়ে আছি আমরা। ভয়ে তঠস্থ। জীবাণু আক্রমনের ভয়। শীত গ্রীষ্ম বর্ষায়, ঘরে বাইরে খেলার মাঠে, এমনকি হাসপাতালেও সংক্রমণের শিকার মানুষ, এমনকি পশুও। বর্ষার জমা জলে বা শীতকালে, বাসি-পচা খাবার অথবা রাস্তার কাটা ফল খেলে বহু রকম ‘ইনফেকশন’ হয়। ইনফেকশন মানে জীবাণু সংক্রমণ। এসব তো জানা কথা। কিন্তু জীবাণু মানে কী এবং কেমন করেই বা হয় সংক্রমণ?
প্রশ্ন সহজ কিন্তু উত্তরটা নয়। সহজ কথায় জীবাণু মানে ক্ষুদ্র প্রাণী (Microorganism)। আকারে এতই ছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না। কেমন করে দেখতে পাওয়া যাবে? অণুবীক্ষণ যন্ত্রে লেন্স দিয়ে দেখলে। এই যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, জীবাণু বা আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা বহু ধরণের। যেমন ব্যাকটেরিয়া (Bacteria), প্রটোজোয়া–ফাঙ্গাস, ছত্রাক (পরজীবী)। কেউ বলেন ভাইরাস এর অন্তর্গত, অনেকের ভিন্ন মত। কারো মতে ভাইরাস প্রাণহীন। তবে ভাইরাস জীবাণুটি জড় পদার্থ না প্রানী এ নিয়ে অবশ্য দ্বিমত আছে।
জীবাণুদের অসংখ্য রকমফের এবং বিচিত্র ব্যবহার। আধুনিক গবেষণায় জানা সম্ভব হয়েছে এদের বিশাল ব্যাপ্তি এবং কর্মকাণ্ডের কথা। এরা সর্বত্র বিরাজমান। ‘…স্থলে জলে নভতলে বন উপবনে/ নদী-নদে গিরিগুহা-পারাবারে’ এরা নিত্য ক্রিয়াশীল। জীবনী শক্তি এতটাই যে উষ্ণ প্রস্রবণের জলে, সাগরের সাত মাইল গভীরে, উন্মুক্ত আকাশে, পৃথিবীতলের চল্লিশ মাইল উর্ধে, অন্তরিক্ষে এরা বেঁচে থাকে। এমনকি বিনা অক্সিজেনেও টিকে থাকতে পারে অনেক জীবাণু।
জীবাণু রাজ্যর (Microbes) সদস্য বহু রকম আণুবীক্ষণিক প্রাণী। এরাই বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে হাজারো জীবাণু। সুযোগ মত এরা আক্রমণ করে। মানুষের শরীরে ডেরা বেঁধে দ্রুত বংশ বিস্তার করে আমাদের কাহিল করে দেয়। যেমন টাইফয়েড কলেরা ম্যালেরিয়া এমনকি সর্দির জন্যও দায়ী জীবাণু। মানুষ ছাড়াও জীবজন্তুর দেহে বহু রোগ সৃষ্টি করে। যেমন গরু বা শুকরের মারণ ব্যাধি অ্যানথ্রাক্স। এগুলো অবশ্য মানুষেও সংক্রমিত হয়।
জীবাণু রাজ্য ব্যাকটেরিয়া খুবই গুরুত্ব পূর্ণ সদস্য। মুলত ব্যাকটেরিয়া প্রসঙ্গেই বর্তমানের এই আলোচনা। রোগ সৃষ্টি ছাড়াও ব্যাকটেরিয়ার কিছু উপকারী গুন আছে। ল্যাকটোব্যাসিলাস (Lactobacillus) ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়ায় দুধ থেকে দৈ তৈরি হয়। সমুদ্রের অনেক ব্যাকটেরিয়া (Cyanobacteria) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অর্ধেক অক্সিজেন তৈরি করে। ওদের ছাড়া আমরা অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকতেই পারতাম না। এ ছাড়াও ব্যাকটেরিয়ার বহু গুণ। যেমন পরিবেশের আবর্জনা বা মৃতদেহ ধংস করে, মাটিকে খাদ্য যোগায় (Azotobacter, Rhizobium)। মানুষের পরিপাক ক্রিয়ায় সাহায্যকরি উপকারি ব্যাকটেরিয়াও আছে (E.Coli, উপরের চিত্র)। ব্যাকটেরিয়া এককোষী এবং আশ্চর্যের কথা, এদের কোষে নিউক্লিউস থাকে না।
এদের সম্পর্কে জানতে কয়েকশো বছরের নিরলস শ্রমসাধ্য গবেষণা করতে হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে আমরা প্রথম জানতে পারি দৃষ্টি শক্তির অন্তরালে ক্রিয়াশীল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীর অস্তিত্ব। একজন ডাচ বস্ত্র ব্যবসায়ী অ্যানটোনিও লিয়েনহুক (Antonie Van Leeuwenhoek, 1632–1723), [ডাচ উচ্চারণে লিউভেনু(হ)ক] নিজের তৈরি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে প্রথম দেখতে পান জলের মধ্যে অসংখ্য পোকার মত বস্তু কিলবিল করছে। উনি এদের নাম দিলেন আনিম্যালকুলি (Animalcule)। রক্তের মধ্যে এদের উপস্থিতির কথা উনি প্রথম বলেছেলিন। হল্যান্ডের লিয়েনহুক কাঁচ ঘসে লেন্স বানাতেন এবং প্রথম উন্নত মানের সরল অণুবীক্ষণ যন্ত্র (Simple microscope) বানাবার কৃতিত্ব তাঁর।
ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানি রবার্ট হুক (Robert Hooke, 1635-1703) যৌগ অণুবীক্ষণ যন্ত্র (Compound microscope) দিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীদের পর্যবেক্ষন করতেন। তিনি আইজ্যাক নিউটনের সমসাময়িক এবং পদার্থ বিদ্যায় ‘হুকের নিয়ম’ (Hooke’s law) এর প্রবক্তা। রবার্ট হুক, তাঁর অভিজ্ঞতা চাক্ষুষ জ্ঞান ছবি সহ বই আকারে (Micrographia) প্রকাশ করে (1665) জীববিজ্ঞানে নতুন ইতিহাসে আলোড়ন তুললেন। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সোলা বা কর্কের গঠন বুঝতে গিয়ে তিনি প্রথম দেখলেন এদের ভিতরে অসংখ্য ঘর (কক্ষ বা cell) আছে (ছবি 2)। হুকের আবিস্কারের পর সেল বা কোষ সম্পর্কে জোরদার গবেষণা শুরু হয়েছিল। এখন আমরা জানি উদ্ভিদ এবং প্রাণী দেহ অসংখ্য কোষ বা সেল দিয়ে তৈরি এবং কোষের ভিতর আছে অসংখ্য উপাদান এবং ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি।
রবার্ট হুক এবং আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীর আবিস্কারের ফলে হাজার হাজার বছর ধরে জমে থাকা অনেক প্রশ্নের উত্তর খুজে পাওয়া গেল। যেমন মানুষের আদ্যিকালের জিজ্ঞাসা, খাবার বা ফলে পচন ধরে কেমন করে? উত্তর, জীবাণু পচন ধরায়। পরবর্তী প্রশ্ন, জীবাণু কি এমনি এমনি জন্মায়?
লিয়েনহুকের আবিষ্কারের আগে (1675) মানুষ আদপেই জানতো না কী কারনে খাদ্য ফল বা মৃতদেহে পচন ধরে। এমন কি তিনিও (লিয়েনহুক) পচনক্রিয়া ও জীবাণুর যোগসূত্র বুঝতে পারেন নি। লিয়েনহুক শুধু প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে দৃষ্টি শক্তির আড়ালে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অসংখ্য ক্রিয়াশীল প্রানির অস্তিত্ব আছে। এদের দেখা সম্ভব একমাত্র অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে।
মাছ মাংস বা খাবারে পচনের কারণ খুঁজতে গিয়ে আরেকজন ইটালির যাজক ও বিজ্ঞানি ল্যাজারো স্পালানজানি (Lazzaro Spallanzani, 1729–1799) দেখলেন যে তরকারি বা মাংসের ঝোল (soup, broth) ফুটিয়ে নিলে এর মধ্যে ক্রিয়াশীল জীবাণুগুলো (Active Microbes) মরে যায়। অর্থাৎ পরিশুদ্ধ বা জীবাণু মুক্ত করবার উপায় হচ্ছে ঝোল তরকারি বা সুপকে ফুটিয়ে নেওয়া। আবার এদের (পরিশুদ্ধ ঝোল তরকারি) বাতাসে ফেলে রাখলে জীবাণু সংক্রমণ ঘটে যায়। তা হলে জীবাণুদের জন্ম হচ্ছে কেমন করে? এদের জন্ম কি স্বতঃস্ফুর্ত? কে এদের বাবা-মা?
জীবাণুদের জন্ম কেমন করে হয়, পরীক্ষার মাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন ফরাসী বৈজ্ঞানিক লুই পাস্তুর (LouisPasteur, 1822–1895)। জীবাণুমুক্ত দুটি সুপের প্রথমটিতে খুব বাঁকানো আকারের বাতাস ঢুকবার পথ রাখলেন (ছবি 3, উপর অংশ)। দ্বিতীয়টিতে সোজা পথ, বাতাস ধূলিকণা সহজেই ঢুকতে পারে। কয়েক দিন পর উপর পাত্রের ঝোল-তরকারি, ধুলো-বাতাস ঢুকতে না পারার কারণে জীবাণু মুক্ত থাকলো। অপর পাত্রের সূপে ঘোলাটে রং ধরল অর্থাৎ জিবানু সংক্রমণের ফলে ঘটে গেল সুপের রঙ বদল। পরীক্ষার ফলে প্রমাণিত হল, জীবাণুরা বাইরের বাতাস বা ধূলিকণার মাধ্যমে খাবারে প্রবেশ করে। এমনি এমনি জন্মায় না। দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ধারণা (স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে জীবাণুদের জন্ম) ভ্রান্ত প্রমাণিত হল।
লিয়েনহুক, রবার্ট হুক এবং লুই পাস্তুরের দুশো বছরের গবেষণায় এটুকু মাত্র জানা গেল যে জলে বাতাসে অনুবিক্ষনীক প্রানীরা উপস্থিত এবং এদের উৎপত্তির পিছনে স্বতঃস্ফুর্ত জন্মের (Spontaneous creation) কোন তত্ব নেই। কিন্ত এই জীবাণুরা যে সত্যি রোগ ছড়ায় তার প্রমাণ পেতে আরো অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট হেইনরিখ হেরম্যান কখ (Robert Koch 1843–1910) প্রমাণ করেন যে জীবাণু বহু ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। যেমন, অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত গরুর রক্তে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া (ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস, Bacillus anthracis) পাওয়া যায়। আক্রান্ত গরুর রক্ত অন্য সুস্থ্য গরুর দেহে প্রবেশ করালে সেটিও রোগের কবলে পড়বে। পরের বছর (1883) তিনি ভয়ংকর পেট খারাপের জীবাণু (কলেরা রোগের ব্যাকটেরিয়া, Vibrio cholera) আবিস্কার করেন। টিউবারকিউলোসিস সংক্রান্ত গবেষণা এবং এর কারক ব্যাকটেরিয়া (Mycobacterium tuberculosis) আবিষ্কারের জন্য উনি নোবেল পুরস্কার পান (1905)।
জীবাণু, বিশেষত ব্যাকটেরিয়া সংক্রান্ত আলচনার মূলত দুটি দিক। এরা অসুখ সৃষ্টি করে আবার উপকারি। অসুখ সৃষ্টিকারী জীবাণু-সংক্রমণ প্রতিরোধ করা উচিত। প্রাথমিক উপায়, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন এবং জল জীবানু মুক্ত রাখা। তাই দাঁত মাজা, সাবান দিয়ে স্নান, হাত ধোয়া, পচা খাবার কিম্বা দীর্ঘক্ষন ফেলে রাখা কাটা ফল না খাওয়া–অতি সাধারন এবং অবশ্য পালনীয় স্বাস্থ্য বিধি। কিন্তু জীবাণুর ক্রিয়া এত বিচিত্র ও জটিল যে বহু সাবধানতা সত্বেও বিভিন্ন ভাবে মানুষ এবং জীবজন্তুর শরীরে জীবাণু সংক্রমণ ঘটে। তার ফল কখনও ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী অসুখ কখনও বা মহামারি। জীবাণু-আক্রমণ প্রতিহত করবার ওষুধও (Antibiotics) আবিস্কার হয়েছে, তবুও মারণ রোগে মৃত্যু অব্যাহত।
আবার উপকারী জীবাণুও আছে। তাদের কথা আগে বলা হয়েছে। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গ। সামগ্রিক ভাবে, সাড়ে তিনশো বছরের জীবাণু সংক্রান্ত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে অনেক নতুন আবিস্কার ঘটানো সম্ভব হয়েছে। যেমন মানুষের ইনসুলিন তৈরির জিণ ব্যাকটেরিয়ার (E.Coli) দেহে প্রবেশ করিয়ে মানুষী ইনসুলিন (Human insulin), বানিজ্যিক নাম হিউমিলিন তৈরি হয়েছে। মাইক্রোবের সাহায্যে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের জিনগত চরিত্র বদলে দেওয়া যায়। জীবাণু সংক্রান্ত গবেষণার ফলে নতুন নতুন প্রয়োজনীয় আবিস্কার ঘটছে। ওষুধ খাদ্যবস্তু এমন কি কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরিও ইদানীং সম্ভব। এযুগে জীবাণু সংক্রান্ত গবেষণা বিজ্ঞানের অতি মূল্যবান একটি শাখা।
অপর এক গুরুত্বপূর্ণ জীবাণুর নাম ভাইরাস। পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনার ইচ্ছে রইল।
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী: পূর্বতন বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্, চিত্তরঞ্জন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা সংস্থান, কলকাতা।