কল্পবিজ্ঞানঃ বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সংযোগ সেতু – পর্ব ২
কল্পবিজ্ঞানের জনপ্রিয়তার কারণ
আজকাল কল্পবিজ্ঞান বহুচর্চিত বিষয়ের অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ক্রমে জনপ্রিয়ও হচ্ছে। এককালে যা অবশ্যই বাঁধা ছিল কিছু সীমিত পাঠকের মধ্যে। জুলে ভার্ণ, ভিক্টর হুগো, ফিওদর দস্তয়ভস্কি, এইচ জি ওয়েলস, আর্থার সি ক্লার্ক, মেরি শেলি ও আরও অসংখ্য বিদেশী ফিকশন লেখক লেখিকা কল্পবিজ্ঞানকে অক্ষয় করে রেখেছেন। বাঙ্গালীদের মধ্যে অদ্রীশ বর্ধন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, হেমেন্দ্র কুমার রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ আরও অনেক।নাম বলতে শুরু করলে শেষ করা কঠিন।
এককালে অদ্রিশ বর্ধনের সম্পাদনায় ‘আশ্চর্য’ বলে পত্রিকাটি আমাদের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মনকে মোহিত করে রাখত প্রতি সংখ্যায় প্রকাশিত রোমহর্ষক কাহিনীগুলি। এর মধ্যে সবগুলিই যে কল্পবিজ্ঞানের ছিল তা নয়। বেশ কিছু আজব আর রোমহর্ষক বটে।
ভয় এমন একটা জিনিস যাতে মানুষ কাতর আর কাহিল হয়ে পড়ে। তবে ভয় পুলকের একটি উপাদান হতে পারে। ভয় মিশ্রিত পুলক অবশ্যই একটি অন্য মাত্রার বিনোদন। আর সেটাই হল থ্রিলারের জনপ্রিয়তার কারণ।
এই প্রসঙ্গে অবশ্যই মনে পড়ে যেতে পারে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত রোমহর্ষক উপন্যাস ‘দি হাউন্ড অফ বাস্কারভিলসের’ কথা। ১৯০২ সালে রচিত উপন্যাসটি মূলত একটি গোয়েন্দা উপন্যাস হলেও একটি থ্রিলারের সমান। অবশ্য কোনান ডয়েলের প্রতিটি রচনা শুধু চমক সাসপেন্স দিয়ে ভরা। তবে এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা যায় থ্রিলার বা ডিটেকটিভ গল্প বা উপন্যাস কোনও অংশেই কল্পবিজ্ঞান নয়।
কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে কি কি আছে?
আছে কল্প আছে বিজ্ঞান আর অবশ্যই সাহিত্য। তবে এই সাহিত্য হল কেবলই মাধ্যম। আলুর দম যতই সুস্বাদু হোক না কেন লুচি ছাড়া তেমন জমে না। মানুষ লুচি কিন্তু অনেক বেশি খায় আলুর দম খায় অল্প। এ ক্ষেত্রে লুচি যত বেশি সুন্দর আর সুদৃশ্য হবে এবং হবে সুসজ্জিত ও সুপরিবেশিত আলুর দম তত বেশি উপাদেয় হয়ে উঠবে। কল্পবিজ্ঞানে বিজ্ঞানের ভাবী কল্পনা যা আপাতদৃষ্টিতে অলীক তা পরিবেশিত হয় সাহিত্যের সুদৃশ্য মোড়কে। অজানা জিনিসের প্রতি আকর্ষণ, কৌতূহল, রোমাঞ্চ, পুলক সব নিয়ে একটা টান টান ভাব। সাহিত্যের রসে পরিপূর্ণ। সাহিত্যিকের তুলিতে আঁকা।
কল্পবিজ্ঞান কিন্তু পুরোপুরি বিজ্ঞান নয়
কল্পবিজ্ঞান অবশ্যই পুরোপুরি বিজ্ঞান নয়, তবে এমন কিছু থাকতে হবে যা বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধিৎসু করে তুলতে পারে। তাকে ভাবতে সাহায্য করতে পারে। আজ হয়ত এটিকে বিজ্ঞান নয় বলে মনে হচ্ছে কিন্তু কাল হয়ত এটি বিজ্ঞানকে দিতে পারে এক অভিনব ধারণা। আর হয়ত অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে একটি বিজ্ঞানের আবিষ্কারে পর্যবসিত হতে পারে।
অর্থাৎ স্বাভাবিক বিজ্ঞান যেখানে যাওয়ার আর পথ পাচ্ছে না তাকে কল্পনার দৌড়ে বেশ একটু এগিয়ে রাখা। এখানে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সূত্র ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। পুষ্পক রথ কি বিমানের ধারণা দেয় না? অতীতের তীর-ধনুক কি মানুষকে উদবুদ্ধ করে নি বন্দুক বা কামানের আবিষ্কারে? আবার ধরুন সাবমেরিনের আবিষ্কার, বেতার, দূর সংযোগ ইত্যাদি বহু জিনিস।
কল্পবিজ্ঞান তবে বিজ্ঞানের সঙ্গে আলাদা কিসে বা সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কই বা কি?
এটা আগেই বলা হয়েছে কল্পবিজ্ঞান বিজ্ঞান নয়। তবে বিজ্ঞানের ছোঁয়া আছে তাতে। অর্থাৎ এই কল্পনায় বিজ্ঞানের একটা ভিত্তি কিছুটা হলেও থাকতে হবে। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান হলে সেটি অবশ্যই লেখা হত বা হয় বিজ্ঞানের নিজস্ব ভাষায়। সেটি বিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্যে। আপামর জনতার জন্যে নয়। কিন্তু কল্পবিজ্ঞান অবশ্যই সাহিত্য। তাই তার ভাষা, ভাব আর ভঙ্গি সাহিত্যেরই হতে হবে। সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে একটি দূর-বিজ্ঞানের কল্পনা যা আপামর মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে পারে বিজ্ঞানের বিষয়ে।
সকলের চোখে-মুখে একটাই প্রশ্ন ভাসবে- এমন হলে কেমন হয়? কিংবা আহা এমনটা কেন হয় না? কল্পবিজ্ঞানের গল্প একটি গল্পই তবে তা অত্যন্ত আকর্ষণীয় আর কৌতূলোদ্দীপক হতে হবে। ভরা থাকবে আজকের পক্ষে অলীক তবে একদা ভবিষ্যতের জন্য ‘হয়ত বাস্তব’ এই তখমা নিয়ে। কল্পনা কিংবা কষ্টকল্পনায় ভরা এই গল্প মানুষকে যেমন আকর্ষণ করবে তেমন বিজ্ঞানীদেরও। ভাষার চমৎকার জাল বিছিয়ে এগুলি করা হয় আর স্বাধারণ অসাধারণ সবাই খুব বেশি আগ্রহী আর আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এর জন্যে। ভাব, ভাষা আর উপস্থাপনায় মানুষের চোখ হবে বিস্ফারিত। মন হবে কৌতূহলী আর প্রসন্ন।
রূপকথা হল অতীতের সেরা কল্পবিজ্ঞান
আসুন রূপকথার কথায়। রূপকথা হল অতীতের সেরা কল্পবিজ্ঞান। পক্ষীরাজ ঘোড়া, ড্রাগন, আগুনমুখো রাক্ষস, ডানাওলা পরী, নিমেষে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে যাওয়া এমন কত কি। কল্পনা অনেকাংশেই তার সীমারেখা অতিক্রম করে অবিশ্বাস্যভাবে এগিয়ে গেছে অনেক অনেক দূর। আগেকার দিনে ঠাকুমারা ঠাকুমার ঝুলি খুললেই নাতি-নাতনির সামনে ছড়িয়ে পড়ত অবাক করা মণিমুক্তো রাশি রাশি। দৈত্য-দানো, রাক্ষস-রাক্ষুসি, ভূত-পেত্নি, তেপান্তরের মাঠ, ভূষুন্ডির মাঠ আর গুপ্তধনের গল্প। এই সব লোম খাড়া করা গল্পগুলোতে শিশুরা ভয় পেলেও কিন্তু আকৃষ্ট হত।
এই আকর্ষণের কারণ অবশ্যই সীমাহীন বিস্ময়ের ডালি। মানুষ যা নেই তাকে চোখের সামনে পেতে খুব আগ্রহী। খুব ছোট্টবেলায় পড়া সেই দু’মুখো পাখিটার গল্প আজও আমাদের মনকে বিস্ময়ে আবিষ্ট করে রাখে। যদিও আমরা জানি এমন সম্ভব নয় তবু মনে আশা ইস যদি এমনটা সম্ভব হত?
রূপকথা এমন ভাবে প্রিয় শুধু আমাদের দেশেই নয়। বরং পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই। প্রত্যেকটি দেশেই রয়েছে তাদের নিজ নিজ ভাব ভাষা আর ভঙ্গিতে নির্মিত রূপকথার গল্প। এই গল্পগুলির অধিকাংশই অবাস্তব কল্পনার আধিক্যে ভরা বটে তবে এগুলোর অনেকের মধ্যেই কিন্তু গুঁজে দেওয়া আছে উপদেশ আর পরামর্শ। আর এমন ভাবেই পরিবেশিত হয় যে এই উপদেশগুলি শিশুর মনে আপনা থেকেই গেঁথে যায়। রূপকথার গল্প পড়ার থেকেও শুনতে খুব ভালবাসে শিশুরা। ইংরেজি সাহিত্যে হ্যারি পটার একটি খুব বিখ্যাত রূপকথার গল্প সেটা হয়ত সকলেই জানে।
কল্পনাবিলাসিতা কিন্তু এক বিনোদন
মানুষ তো কখনই তার নিজের সীমানায় আর অবস্থানে সন্তুষ্ট নয়। যার কিছু নেই সেও যার অনেক আছের কল্পনায় নিজেকে মশগুল রাখে। এই কল্পনাবিলাসিতা অবশ্যই এক বিনোদন যা কমবেশি প্রত্যেকটি মানুষই পেতে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ত কল্পনা পরিণত হয়েছে কষ্ট কল্পনায়। বিজ্ঞানের সাধনায় কিন্তু এই কষ্টকল্পনা কুয়াশার জাল ছাড়িয়ে আবার বাস্তবের জমিতে পা রেখেছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার হয়ে মানব সমাজে সেবা আর উন্নয়নের ধ্বজা তুলে ধরেছে।
অতীতের মুনীঋষি, দেব-দেবীরা চোখ বুজলেই দূরের বহু জিনিস দেখতে পেতেন। কেউ বিশ্বাস করে কেউ করে না। বিশ্বাস জিনিসটা বড়ই ব্যক্তিগত। তার ওপর জোর হয়ত খাটে না। তবে এই বিশ্বাস কি বিজ্ঞানীদের কিছুমাত্র প্ররোচিত করে নি দূরদর্শন, দূরসংযোগ, দূর নিয়ন্ত্রণ বা দূর প্রক্ষেপনের ক্ষেত্রে? বিজ্ঞানের চমকপ্রদ আবিষ্কার রিমোট সেন্সিং (Remote sensing) আজ না গিয়েও মহাকাশের বস্তুর উপাদান খুঁজে নিচ্ছে। মঙ্গল গ্রহে জল আছে কি বাতাস আছে তার সন্ধান দিচ্ছে? এমন আরও কত কি।
আজব কাহিনী (Fantasy), রোমহহর্ষক বা রোমাঞ্চকর কাহিনী (thriller), কল্প-কাহিনী (fiction) আর কল্পবিজ্ঞান (science fiction):
আজব কাহিনী হল লেখকের উদ্ভট কল্পনার ফসল। এই উদ্ভট কল্পনার মধ্যে বিজ্ঞানের কিছু আছে কি নেই সে বিষয়েও লেখকের ধারণা না থাকারই কথা।আর পাঠকও সে নিয়ে চিন্তিত নয়। লেখক তার কল্পনার ডানা মেলে দেন শুধু তাঁর সৃষ্টির আকাশে। সেই আকাশে নেই কোনও যুক্তির এ-টি-সি বা এয়ার ট্র্যাফিক কনট্রোল।
এই ধরণের কাহিনীর ক্ষেত্রে মানুষ কোনও যুক্তিকে চায়ও না। বরং যুক্তি থাকলে তাদের মনে হয় যেন উপভোগের রস কেটে গেল। তবে কৌতূহল, ভীতি, চমৎকারিত্ব বা রোমহর্ষকতার দিক থেকে দেখলে এই ধরণের কাহিনীও উপভোগ্য হতে পারে বা হয়। সারা পৃথিবীর সব দেশেই প্রায় এমন প্রচুর কাহিনী আছে। তা থেকে প্রচুর চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে আর মানুষের বিনোদন আর মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে এক অসামান্য মাত্রা এনে দিয়েছে। এক্ষেত্রে এই কল্পনা তার সীমা ছাড়িয়ে যে কোনও অংশে বিচরণ করতে পারে।
সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি মারাত্মক পার্থক্য বিদ্যমান – এইচ জি ওয়েলসের The Invisible Man’ ফিকশন
কল্পবিজ্ঞানে বিজ্ঞানের কিছু ছোঁয়া থাকবেই। যেমন ধরুন invisible man বা অদৃশ্য মানুষের কাহিনী। হঠাৎ করে মানুষের মনে কখনও হয়েছিল এটা যে মানুষ অদৃশ্য হলে কি হয়। সেই নিয়ে লেখা হল এইচ জি ওয়েলসের The Invisible Man’ ফিকশনটি। ১৮৯৭ সালে লেখা এই উপন্যাসটি একটি চমৎকার কল্পকাহিনী বা Fantasy হতে পারত যদি না এতে বিজ্ঞানের কিছুমাত্র উপাদান না থাকত। এই গল্পের নায়ক গ্রিফিন নিজে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন এবং তিনি আলোকের তত্ত্ব (properties of light) নিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁর কাজ ছিল আলোকের প্রতিসরাঙ্ক বা refractive index নিয়ে। এখানে মানে এই কাহিনী কিন্তু একটি বিজ্ঞানের প্রচলিত সূত্রের কাল্পনিক বিস্তারণ (imaginative expansion) বলা যেতে পারে। কি সেই তত্ত্ব? কিন্তু তত্ত্বের এত গভীরে আমি যাব না। যাব সেই প্রশ্নে। একটি বস্তু অদৃশ্য হয় কি করে? অনেক বলবেন কেন ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে। কিন্তু তাহলে তো ঘরের সব কিছুই অদৃশ্য হয়ে যাবে।
এই যে অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপার তার মধ্যে রয়েছে একটা আপেক্ষিকতা। যেমন লাউডগা সাপেরা কচি লাউগাছের ডগার মধ্যে মিশিয়ে থাকে। অদ্ভুত ভাবে এরা দুজনে সদৃশ্য। তাই এদের আলাদা করা খুব কঠিন। আবার ধরুন প্রকৃতিতে যে অনেক পশু পাখি আছে তারা প্রকৃতির সেই বিশেষ অংশে এমন ভাবে মিশিয়ে থাকে যাতে তাদের অদৃশ্য বলেই মনে হয়। খুব সহজ উদাহরণ হল ঘোর সবুজ রঙের টিয়াপাখির ঘন সবুজ পেয়ারা পাতার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে থাকে। অর্থাৎ রঙের সঙ্গে রঙ মিশিয়ে গিয়ে দুই বস্তুর পার্থক্য নিরূপণ হচ্ছে না।
এবার একটু বিজ্ঞানের দিকে আসি। গাঢ় নীল আকাশে যদি একটা গাঢ় নীল রঙের বেলুন উড়ে যায় তবে খুব সহজে তা চোখে পড়ে কি? যদি বেলুনের উপাদানের আলোক কম্পাঙ্ক আর নীল আকাশের আলোক কম্পাঙ্ক একেবারে মিলে যায় তো বেলুনটা দেখাই যাবে না। একটা কাঁচের গ্লাসের মধ্যে দিয়ে ঠিক একই রকম আর একটি কাঁচের গ্লাসকে কি আপনি দেখতে পান? দুটো কাঁচের যদি একই উপাদান হয় তবে তাদের আলোক প্রতিসরাঙ্ক অভিন্ন হয়। আর আলো একটি কাঁচের মধ্যে দিয়ে এসে অন্য কাঁচে পড়ে তার গতিপথ পালটায় না। প্রতিসরাঙ্ক ভিন্ন হলে কিন্তু পাল্টায়।
তার মানে দুই বস্তুর সমান প্রতিসরাঙ্ক হলে একটার মধ্যে দিয়ে আর একটাকে দেখা যাবে না। তাহলে কোনও একটি বস্তুর প্রতিসরাঙ্ক যদি বাতাসের প্রতিসরাঙ্কের সমান হয়ে যায় তবে সেই জিনিসটা বাতাসে রাখলে আর দেখা যাবে না। অর্থাৎ বস্তুটি থাকবে কিন্তু দেখা যাবে না।
এই তত্ত্বই উদবুদ্ধ করেছিল গল্পের নায়ক গ্রিফিনকে নতুন এক কল্পনা মনে গাঁথতে। সেটি হল কোনও মানুষকে অদৃশ্য করে দেবার কল্পনা। মানুষের দেহের উপাদানের প্রতিসরাঙ্ক যদি বাতাসের প্রতিসরাঙ্কের সঙ্গে সমান করে দেওয়া যায় তবে মানুষটিকে আর দেখা যাবে না। এই নিয়েই এই কল্পবিজ্ঞানের গল্পটি।
এই রোমহর্ষক গল্পটিতে যে বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে তা নিয়ে সাধারণ পাঠক ভাবিত নয়। কিন্তু কল্পবিজ্ঞানের লেখক ওয়েলসের কাছে বিজ্ঞানের এই সূত্রটি মূল্যবান ছিল। এইটি হাতিয়ার করেই তিনি গল্পটি লিখেছিলেন। একটা মস্ত ট্র্যাজেডি হল এই যে এই গল্পের নায়ক গ্রিফিন নিজেকে অদৃশ্য করতে পারলেও আর দৃশ্যমান হতে পারেন নি। কিন্তু দৃশ্যমান হলে বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী তিনি আর একটি চমৎকার রোমহর্ষক গল্প বলতে পারতেন। সেটা হল এই যে অদৃশ্য হওয়া কালীন তিনি কিছুই দেখতে পান নি। কারণ তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কেন?
কারণ অদৃশ্য হওয়ার জন্যে তাঁর শরীরের প্রতিটি অংশের আলোক প্রতিসরাঙ্ক বাতাসের প্রতিসরাঙ্কের সমান করতে হয়েছিল। তাই আলো তাঁর শরীরের সমস্ত অংশ দিয়ে ঢুকে সরাসরি বেরিয়ে গিয়েছিল কোনও বিচ্যুতি বা deviation হয় নি। তাহলে চোখের কর্ণিয়া দিয়ে প্রবিষ্ট সমস্ত আলোক রশ্মির তো একই দশা হয়েছিল। অর্থাৎ তারা সোজা বেরিয়ে গিয়েছিল। মানে রেটিনার মিলিত হতে পারে নি। রেটিনায় মিলিত হলে ক্যামেরার সূত্র অনুসারে একটি প্রতিবিম্ব রেটিনায় গঠিত হয় আর এর পেছনে থাকা অপ্টিক নার্ভ (optic nerves) সেই ছবির অনুভূতি মস্তিষ্ককে দেয় আর সে দেখতে পায়। কিন্তু রশ্মিগুলি মিলিত না হয়ে সমান্তরাল ভাবে বেরিয়ে গেলে প্রতিবিম্ব গঠিত হয় না। তবে ভেবেই দেখুন তো মানুষ অদৃশ্য হলে সে দেখতে পাবে কি করে?
মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন
তেমনি চমকপ্রদ আর রোমহর্ষক এক গল্প হল মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। লেখিকার মাত্র আঠার বছর বয়েসের এই লেখাটি সাফল্যের এক চূড়ায় উঠেছিল যা আজও সমান ভাবে জনপ্রিয়। আর শুধু তাই নয় এটি একটি মূল্যবান প্রবাদের জন্মও দিয়ে গেছে।
গল্পের নায়ক বিজ্ঞানী চেষ্টা করছিলেন কোনও মৃত ব্যক্তির মগজ কোনও জীবিত প্রাণীর মগজের সঙ্গে পরিবর্তিত করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা যায় কিনা দেখতে। একটি অবরুদ্ধ শিম্পাঞ্জীর মস্তিষ্ক লাগানো হয়েছিল মৃত সেই মানুষের মগজে। ব্যক্তিটি প্রাণ ফিরে পেলেও ফিরে পেল না নিজস্ব মস্তিষ্কের অনুভূতি। বিপরীতে পেল সে সেই অত্যাচারিত শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের অনুভূতি। সে ভয়ানক প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠে অবশেষে হত্যা করল তার জীবনদাতাকেই।আজকের দিনে শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রতিস্থাপনের ভাবনা এই কল্পবিজ্ঞান থেকেই যদি আসে এমন মনে করাটা কি কল্পনার ওপর খুব বেশি অত্যাচার?
এর থেকে যে প্রবাদটি উঠে এসেছে তাও ভয়ংকর। সেটা হল মস্তিষ্ক হল প্রাণীর আসল অংশ যা তার মন আর শরীরকে চালায়। অতএব মস্তিষ্কের প্রতিস্থাপন যদি কখনও সম্ভব হয়ও তবে প্রতিস্থাপনযোগ্য মস্তিষ্ক এমন ভাবে বাছতে হবে যাতে কোনও ফ্রাংকেনস্টাইন সৃষ্টি না হয়। অর্থাৎ শ্রষ্টাকেই সে যেন ধ্বংস না করে।
কল্পবিজ্ঞানে কম্পিউটার মাল্টিমিডিয়ার অবদানঃ
যখনই আবিষ্কৃত হোক না কেন ২০০০ সালের পর থেকে কম্পিউটারের উৎপাদন, প্রচার, প্রসার আর ব্যবহার অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর পেতেই থাকছে। এটা অবশ্যই অত্যন্ত সঠিক যে কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক মস্ত বড় আবিষ্কার। এর সাহায্যে মানুষ ইচ্ছামত যা খুশি করতে পারে আর পারছে।
কম্পিউটার ডিভাইসের ইনপুট থেকে প্রাপ্ত শক্তিগুলি প্রথমে তড়িৎশক্তি পরে সংখ্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রসেসর তার গননা করে উপহার দিচ্ছে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যাই। আউটপুট ডিভাইস সেই সংখ্যা আবার লজিগ গেটের মাধ্যমে প্রথমে তড়িৎ ও পরে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
অর্থাৎ খুব সহজ করে বলতে গেলে বলা যেতে পারে কম্পিউটার একটি গননাযন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। নেট ব্যবস্থা যোগাযোগকে যে কতগুণ বাড়িয়ে তুলেছে তা আমরাও যে টের পাই না তা নয়। শুধু মাত্র তাৎক্ষণিকতার বিচারে নয় তথ্য সংরক্ষণের (Data base) ক্ষেত্রেও এই যন্ত্রটি অতুলনীয়।
কম্পিউটার এনেছে মাল্টিমিডিয়াকে। অডিও, ভিডিও, টেক্সট, গ্রাফিক্স আর অ্যানিমেশন এই পাঁচ আঙ্গুল নিয়ে তৈরি এক মুঠি এই মাল্টিমিডিয়া একটি কম্পিউটার ম্যাজিক ছাড়া কিছু নয়। এর সাহায্যে বিশ্বের যত আজব কল্পনাকে মুহূর্তে মূর্ত করে তোলা যায়। আজ যত সহজে রূপকথার গল্প, আজব কাহিনী, পোরাণিক উপাখ্যান ইত্যাদির অডিওভিসুয়াল রূপ দেওয়া যায় মাল্টিমিডিয়া ছাড়া তা ছিল অতি কষ্টসাধ্য বা বেশ কিছু ক্ষেত্রে অসম্ভব।
যেকোনো কল্পবিজ্ঞান, ফিকশন বা ফ্যান্টাজিতে মাল্টিমিডিয়ার প্রয়োগ আবিষ্কারের জগতে অতুলনীয় এক মাত্রা এনে দিয়েছে। কি অদ্ভুত ভাবে হরর ফিল্মগুলি তৈরি করা যাচ্ছে ভাবাই যায় না। অর্থাৎ কল্পবিজ্ঞান আজ সহজেই চিত্রায়িত করা সম্ভব এই মালটিমিডিয়ার সাহায্যে।
কল্পবিজ্ঞানে সাহিত্যিকের ভূমিকা (role of a story creator in science fiction):
এতক্ষণ যে আলোচনা হল তাতে এটা নিশ্চয় বোঝান গেছে কল্পবিজ্ঞানে বিজ্ঞানের প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত এক বা একাধিক সূত্রের কিছু আপাত-অলীক কল্পনার বিস্তারণ থাকবে। তবে কল্পবিজ্ঞান কিন্তু বিজ্ঞানের কোনও প্রবন্ধ নয়। আর সাহিত্য ও বিজ্ঞানের সুসংযুক্ত এই ধারার শ্রষ্টা অবশ্যই একজন সাহিত্যিক হবেন নাহলে আর থাকবে কেন সাহিত্যের রস আর মাধুর্য?
তবে তাঁর অবশ্যই থাকবে কিছু বিজ্ঞান ভাবনাও। তাই কল্পবিজ্ঞান হল বিজ্ঞান আর সাহিত্যের এক অপূর্ব সংযোগ সেতু। রসাস্বাদনে সাহিত্য হিসেবে যেমন অনুপম তেমনি এতে থাকবে ভাবী বিজ্ঞানীদের জন্যে কিছু আবিষ্কারের চমৎকার রসদও। আজ বিজ্ঞান যেখানে এসে থেমে আছে সে হয়ত এগিয়ে যাবার আরও কিছু দিশা পাবে কল্পবিজ্ঞানের কল্পনার দৌলতে।
ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়: বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনের (গল্প ও উপন্যাস) লেখক ও গ্রন্থকার।