Free ArticlesPhysics-পদার্থবিজ্ঞান

পদার্থের পঞ্চম অবস্থা: বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট

bose einstein condensate

আমরা যে টেবিলে বসে লেখাপড়া করি তা কঠিন পদার্থ, যে জল আমরা পান করি তা তরল এবং আমরা যে বাতাসে নি:শ্বাস প্রশ্বাস চালাই তা গ্যাসীয় পদার্থ। পদার্থের এই তিনটি অবস্থা আমাদের সুপরিচিত : কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থা। পদার্থের চতুর্থ অবস্থা প্লাজমা, সহজ করে বললে, উচ্চ তাপমাত্রায় পদার্থের গ্যাসীয় অবস্থা। অগ্নিশিখার উপরের গ্যাসীয় পদার্থ হল প্লাজমা, যার পরমাণু থেকে এক বা একাধিক ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সূর্য থেকে ধেয়ে আসা কণিকা প্রবাহ আসলে প্লাজমা প্রবাহ। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বত্র রয়েছে প্লাজমা।

পদার্থের এক সম্পূর্ণ নতুন অবস্থা বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট। অদ্ভুত এর বৈশিষ্ট, এর ধর্ম ; এটি কঠিন পদার্থও নয়, তরল পদার্থও নয়, গ্যাসীয় বা প্লাজমা ও নয়, একেবারে আলাদা। বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোথাও বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট এর অস্তিত্ব নেই, পৃথিবীতে মানুষের তৈরি গবেষণাগার ছাড়া। কারণ তার জন্য প্রয়োজন অকল্পনীয় শৈত্য তথা নিম্ন তাপমাত্রা। একশো সত্তর (১৭০) ন্যানো-কেলভিন তাপমাত্রা তথা এক কেলভিন (সহজ করে বললে এক সেন্টিগ্রেড) তাপমাত্রার একশো কোটি ভাগের একশো সত্তর ভাগ। একই সঙ্গে পৃথিবীর সমুদ্রতলের বাতাসের চাইতে এক লক্ষগুণ পাতলা আবদ্ধ গ্যাস।

বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেটের সূচনা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তার রূপায়নের মধ্য দিয়ে। মূল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির প্রবক্তা সত্যেন্দ্রনাথ বসু যিনি বিকিরণ সম্পর্কে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে নতুন ভাবে নতুন পদ্ধতিতে গণনা করে একই ফলাফলে উপনীত হয়েছিলেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। আলোকরশ্মি ফোটন দিয়ে গঠিত, ফোটনরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভরহীন এক একটি শক্তিকণিকা, তাদের নিজেদের মধ্যে নেই কোনো আকর্ষণ বা কোনো বিকর্ষণ। সমস্ত ফোটন কণিকা একই রকম ধরে নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর যে গাণিতিক ফলাফলে উপনীত হয়েছিলেন, তা এখন বসু-সংখ্যায়ন (বোস-স্ট্যাটিটিকস) নামে বিখ্যাত, গাণিতিক সুষমা ও সৌন্দর্যে যা অতুলনীয়।

বসু সংখ্যায়ন মেনে চলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে সমস্ত কণিকা, তাদেরকে পরবর্তীকালে নাম দেওয়া হয়েছে বোসন। তাদের প্রত্যেকের স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা (সহজ কথায় স্পিন) এক একটি পূর্ণসংখ্যা বা শূন্য; যথা ০, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬,…. ইত্যাদি। আবার বসু সংখায়ন অনুসরণ করে পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত ফের্মি-ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলে যে সমস্ত পদার্থ কণিকা তাদের বলা হয়েছে ফের্মিয়ন; তাদের স্পিন এক একটি অযুগ্ম পূর্ণসংখ্যার অর্ধেক; যথা ১/২, ৩/২, ৫/২, ৭/২,…. ইত্যদি। সত্যেন্দ্রনাথের গনণায় ব্যবহৃত ফোটন কণিকারা বোসন শ্রেণীর কণিকা।

সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর গবেষণাপত্রটি ১৯২৪ সালের ৪ঠা জুন আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এই অনুরোধ সহ যে, তিনি যদি এটিকে উপযুক্ত বিবেচনা করেন, তাহলে কোনো উপযুক্ত বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ক পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। তার কারণও ছিল, সত্যেন্দ্রনাথ প্রথমে গবেষণাপত্রটি পাঠিয়েছিলেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে, যেখানে ইতিপূর্বে তাঁর দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এবার পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে এটি প্রকাশের পক্ষে অনুপযুক্ত বলে মনে হওয়ায় তাঁরা গবেষণাপত্রটি ছাপাননি। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন গবেষণাপত্রটির অভিনবত্ব এবং সম্ভাবনা উপলব্ধি করে সঙ্গে সঙ্গে নিজে জার্মাণ ভাষায় অনুবাদ করে বিখ্যাত জার্মাণ বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা জেইটসক্রিফট ফ্যুর ফিজিক পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন এবং সেইমতো তা ১৯২৪ সালেই খুব দ্রুত প্রকাশিত হয়। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ১৯২৪ সালে একটি এবং ১৯২৫ সালে আর একটি গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন গ্যাসের একশ্রেণীর পরমাণুদের ক্ষেত্রেও এই তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করেন। ফোটনের ভর নেই, পরমাণুর ভর আছে। আইনস্টাইন গণনার যে ফলাফলে উপনীত হন তা বসু-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন (বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস) নামে বিখ্যাত।

আইনস্টাইন দেখান যে, অতি নিম্ন তাপমাত্রাতে গ্যাসের পরমাণুগুলি তাদের সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে (ভূমিস্তরে) একত্রিত হবে, যেন গ্যাসের পরমাণুগুলি সবাই জোড় বেঁধে একটি জায়গাতেই থাকতে চায় এবং তখন পদার্থের এক নতুন অবস্থা সৃষ্টি হবে। অতি নিম্ন তাপমাত্রায়, শূন্য কেলভিন তাপমাত্রার খুব কাছাকাছি, অণু-পরমাণুদের ছোটাছুটি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তাদের শক্তি ক্রমাগত কমতে কমতে প্রায় শূন্যে পৌঁছায়। ফলে এইসব অণু-পরমাণুদের সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে নেমে আসা ছাড়া অন্য কোথাও থাকবার জায়গা থাকে না। এই অবস্থাই পদার্থের বসু-আইনস্টাইন ঘনীভুত অবস্থা (বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট)। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মূল গবেষণাপত্রে অবশ্য এই বিষয়টি ছিল না।

১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আবিস্কারের পর ১৯২৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের হাতে তা পূর্ণতা পেয়ে তাত্ত্বিকভাবে বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেট জন্ম নিল। তারপর বহু বিজ্ঞানী বহু পরীক্ষানিরীক্ষা করেও এটি তৈরি করতে সক্ষম হননি। অপেক্ষা করতে হল সত্তর বছর। ১৯৯৫ সালে এরিক কর্ণওয়েল এবং কার্ল ওয়াইমানের নেতৃত্বে একদল গবেষক রুবিডিয়াম-৮৭ পরমাণুর অতি লঘু গ্যাসকে একশো সত্তর ন্যানো কেলভিন তাপমাত্রায় শীতল করে প্রথম বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেট তৈরি করতে সফল হয়েছেন। এর চারমাসের মধ্যে ওলফগ্যাং কেটারলি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সোডিয়াম-২৩ পরমাণুর গ্যাসের বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেট (বিইসি) তৈরি করে তার উপর বিস্তারিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন। এই তিনজনই ২০০১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেছেন।

১৯৯৫ সালের পর পৃথিবী জুড়ে উন্নত গবেষণাগারগুলিতে বলতে গেলে, বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেট গবেষণার জোয়ার এসেছে। অচিন্ত্যনীয় কিছু আবিষ্কারও হয়েছে। কেটারলির নেতৃত্বে এক গবেষকদল ১৯৯৭ সালে পরমাণুর লেসার (অ্যাটম লেসার) প্রস্তুত করেছেন, যা সূক্ষ্ম ছিদ্রপথে একটি একটি করে পরমাণু নীচের দিকে ফেলতে পারে, যেন ছিদ্রপথে বার হচ্ছে এক একটি জলের ফোটা।

বিইসি ব্যবহার করে ১৯৯৯ সালে নোবেল পুরষ্কারজয়ী উইলিয়াম ফিলিপসের নেতৃত্বে তৈরী হয়েছে এক যন্ত্র যা ডাইনে বামে উপর দিকে নীচের দিকে বা ইচ্ছামত যেকোনো দিকে পরমাণুর স্রোতকে নিক্ষেপ করতে পারে। এটির সাহায্যে হয়ত ভবিষ্যতে কম্পিউটারের উন্নততর চিপ তৈরী বা ন্যানো ডিভাইস তৈরী করা যাবে।

একই রকম আশ্চর্য এক অবিষ্কার করেছেন লেনে ভেস্টারগার্ড হাউ-এর নেতৃত্বে একদল গবেষক ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তাঁরা বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেটের ভিতর দিয়ে আলোকের গতিবেগকে সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে সেকেন্ডে মাত্র সতেরো মিটারে নামিয়ে আনতে পেরেছেন। আলোক কোনো ঘন মাধ্যম দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় তার গতিবেগ কমে যায়, লৌহখণ্ডের মতো ঘন বস্তুর উপর আপতিত হলে তা থেমে যায় এবং দিক পরিবর্তন করে অন্য পথ ধরে, তা আমরা জানি। কিন্তু বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেটের এর মতো অতি লঘু মাধ্যমে তা একেবারেই হওয়ার কথা নয়, আলোকরশ্মি একেবারে প্রায় বিনা বাধায় ভেদ করে যাওয়ার কথা। ২০০১ সালে হাউ-এর নেতৃত্বে গবেষকদল বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেটের উপর লেসার রশ্মি ফেলে তার ভিতর দিয়ে পাঠানো আলোক রশ্মিকে সম্পূর্ণভাবে থামিয়ে দিতে পেরেছেন। এভাবে বন্দী আলোক রশ্মিকে আবার সম্পুর্ণ অপরিবর্তিত অবস্থায় ছেড়ে দিতে বা দ্বিতীয় আর একটি বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেটের ভিতরে পাঠিয়ে দিতে পেরেছেন, যেখানে ঐ আলোক রশ্মি আগের মতোই সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত থাকে। ভবিষ্যতে একদিন এর সাহায্যে হয়ত অনেক বেশি তথ্য অনেক নিরাপদে সঞ্চয় করে রাখা যাবে বা টেলি যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে।

২০০১ সালে কর্ণওয়েল এবং ওয়াইমানের নেতৃত্বে একদল গবেষক এমন এক বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেট তৈরি করেছেন যা সঙ্কুচিত হয়ে যেতে যেতে সহসা এক ছোট্ট বিস্ফেরণের মাধ্যমে তার প্রায় অর্ধেক পরমাণুকে হারায়। এই বিস্ফোরণের সঙ্গে মহাকাশে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মিল রয়েছে বলে পারমাণবিক স্তরে এই বিস্ফোরণের নাম দেওয়া হয়েছে “বসুনোভা“ (বোসোনোভা) ।

বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেটের ধর্ম ও আচরণ অনুধাবন করাটাকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে যে, মহাকাশেও এর আচার-আচরণ পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে এই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে (ইন্টারন্যাশন্যাল স্পেস স্টেশন) রুবিডিয়াম পরমাণুকে পরম শূন্য তাপমাত্রার একেবারে কাছাকাছি, এক কেলভিনের প্রায় এক কোটি ভাগের কয়েকভাগ তাপমাত্রায় বসু-আইনস্টাইন কনডেনসেট তৈরি করা হয়েছে।


তপন কুমার বিশ্বাস: ফ্রি-ল্যান্স বিজ্ঞান লেখক