Free ArticlesLife Science-জীববিজ্ঞান

হারিয়ে যাচ্ছে ‘চিতা’

Cheetah

বাঘের মাসী বিড়াল। তাহলে সিংহ বা জ়াগুয়ারের সংগে বিড়ালের সম্পর্ক কী? হ্যাঁ, সম্পর্ক একটা আছে। এরা একই শ্রেণীভুক্ত। বিজ্ঞানের ভাষায় সিংহ, বাঘ, জাগুয়ার, চিতা, পুমা, চিতাবাঘ, বিড়াল ইত্যাদি (37 ধরনের প্রাণী) বিড়াল গোষ্ঠী (Felidae) পরিবারভুক্ত প্রাণী। তবে বাঘ ছাড়া আর কারো সঙ্গে বিড়ালের মাসী-পিসি সম্পর্ক আছে কিনা জানা নেই। যাইহোক, আপাতত সম্পর্কের কথা সরিয়ে রেখে এই প্রবন্ধের নায়কের কথায় আসি।

এই প্রবন্ধের নায়ক চিতার তেজোদীপ্ত দৌড় দেখলে উত্তেজনার আবেশে মন ভরে যায়। যেমন তার ভঙ্গিমা তেমন তার ক্ষিপ্রগতি। স্থলজীবি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এত জোরে আর কেউ দৌড়াতে পারে না। সৌন্দর্যের বিচারেও চিতা প্রথম সারিতে থাকবে। ক্ষীণকটি, হাল্কা-পাতলা চেহারা, মেদবর্জিত লম্বা দেহ, গভীর বক্ষপিঞ্জর, নমনীয় শি্রদাঁড়া, লম্বা লেজ, গভীর নাসারন্ধ্র, তেজিয়ান চেহারা প্রাণীটিকে করে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন।

চিতা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘চিত্রক’ থেকে। চিত্রকের সমার্থক শব্দ ‘দ্বীপী’, যার অর্থ হল হলুদের উপর কালো ছোপ। তবে দুঃখের বিষয় হল, যে ভূখন্ড থেকে চিতা নামের উৎপত্তি সেই ভূখন্ডেই আজ আর চিতা নেই। 1952 সালে সরকারিভাবে ঘোষিত হয়েছে যে ভারত চিতা শূন্য। কেন এমনটা হল? এরজন্য দায়ী এদেশের রাজা-মহারাজাদের চিতা শিকারের লালসা। শোনাযায়, আকবর বাদশার সংগ্রহশালায় এক হাজার চিতা ছিল। শুধু তাই নয়, অনেকে আবার চিতাকে পোষ মানিয়ে শিকারের কাজে ব্যবহার করতেন। বর্তমানে চিতার প্রধান আবাসস্থল আফ্রিকা। এই মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল ছাড়া আর যেখানে চিতার দেখা পাওয়া যায় তা হল মধ্যপ্রাচ্যের ইরাণ। যদিও সেখানে চিতার সংখ্যা খুবই কম। ইরানিয়ান চিতা সোসাইটির হিসেব অনুযায়ী প্রাণীটির সংখ্যা এখন 40-এর কিছু বেশি। ইরান ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও এখন আর এশিয়াটিক চিতা দেখতে পাওয়া যায়না। তাই একে অনেক সময় ইরানিয়ান চিতাও বলা হয়ে থাকে। অথচ এক সময় ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং আরবের দেশগুলি ছিল এশিয়াটিক চিতার বিচরণ ক্ষেত্র। 1947 সালে ভারতে শেষ চিতার সন্ধান মিলেছিল। ভারতে আবার চিতার আবাসস্থল গড়ে তোলা যায় কিনা সে ব্যাপারে ভারত সরকার 1970 সালে একবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যেহেতু এসিয়াটিক চিতার বাস তখন শুধুই ইরানে ছিল তাই সে দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা প্রস্তাব নাকচ করে দেন যেহেতু সেখানেও এই প্রাণীটি বিলুপ্তপ্রায়। এরপরে ঠিক হয় আফ্রিকান চিতা এনে পরিকল্পনা সার্থক করা হবে। তখন জানা ছিল যে এশিয়াটিক চিতার উদ্ভব আফ্রিকান চিতা থেকে। যদিও সন্দেহ ছিল যে এদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে আফ্রিকান চিতা মানিয়ে নিতে পারবে কিনা। বিশেষ করে তাদের খাদ্যাভ্যাস পাল্টাতে হবে। কারণ আফ্রিকান অ্যান্টিলোপ ভারতে পাওয়া যায় না। যাইহোক পরিকল্পনা এখনও সার্থকরূপ পায় নি।

অনেকে চিতাবাঘের সঙ্গে চিতাকে গুলিয়ে ফেলেন। দেখতে অনেকটা কাছাকাছি হলেও ফারাক আছে অনেক। চিতার তামাটে হলুদ গায়ের রঙের উপর গোলাকার জমাটবাঁধা কালোছোপ থাকে, চিতাবাঘের থাকে গাঢ় হলুদের উপর চক্রাকার কালোছোপ। চিতার দু’চোখের পাস দিয়ে নেমে আসা কালোদাগ (tear-stripe) চিতাবাঘের থাকে না। চিতা যতটা ক্ষীণকটি, চিতাবাগ ততটা নয়। বাঘের সঙ্গে চিতাবাঘের আত্মীয়তা চিতার তুলনায় বেশি। চিতার উৎপত্তিগত মিল বিড়াল পরিবারের শিকারি পুমা বিড়ালের সঙ্গে বেশি। চিতা ঘাসজমিতে থাকতে পছন্দ করে বেশি, চিতাবাঘ জঙ্গলে। চিতা গাছে চড়তে পারেনা, চিতাবাঘ পারে।

চিতার মুখগহ্বর ছোট শ্ব বা ছেদক দাঁতের (canine teeth) ব্যাপ্তি ও শক্তি সিকারের কন্ঠনালী ছেদ লরার মত যথেষ্ট নয়। তাই ক্ষিপ্রগতি হওতা সত্বেও চিতা বিড়াল পরিবারভুক্ত অন্যান্য শিকারি প্রাণীদের তুলনায় কিছুটা কমজোরি। সাধারনত 40-50 কেজি-র বেশি ওজনের প্রাণীদের এরা শিকার করে না। গ্যাজেল (Gazelle), ইমপালা (Impala), অ্যান্টিলোপ (Antilope) এদের বেশি পছন্দের শিকার। বাচ্চা চিতা খরগোশ, বুনোমুরগী ইত্যাদির মত ছোট প্রাণী ধরে শিকারের তালিম নেয়। চিতা রাতে বা প্রখর রোদে শিকার ধরতে বের হয় না। এদের শিকার ধরার সময় সাধারনত সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত। যেহেতু এরা শিকারের কন্ঠনালী ছেদ করতে পারে না তাই দাঁতের চাপে শ্বাসরোধ করে শিকারকে হত্যা করে। অনেকসময় সিংহ বা হায়নার দল ওৎপেতে বসে থাকে। চিতা শিকার ধরলেই তারা এগিয়ে এসে ছিনিয়ে নেয়। এদের সঙ্গে মারামারি করে শিকার নিজের দখলে রাখার সাহস চিতার হয় না। তখন দূর থেকে অসহায়ভাবে দেখা ছারা তাদের আর কিছুই করার থাকেনা। শকুনের ঝাঁক এলেও এরা শিকার ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাই শিকার ধরেই এরা খেতে শুরু করেনা। প্রথমে মৃত শিকারকে টেনেহিঁচড়ে ঝোপঝাড় বা বড় ঘাসের আড়ালে নিয়ে যায় তারপর খাওয়া শুরু করে।

চিতা, বাঘ বা চিতাবাঘের মত একলা থাকেতেই ভালবাসে। শিশুসন্তান লালন পালনের জন্য স্ত্রী-চিতা কিছুদিন সন্তানদের নিয়ে ঘর বাঁধে। বাচ্চারা বড় হলেই যে যার নিজের পথে হাঁটা দেয়। একটি পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী-চিতা একবারে 2-6 টি শাবকের জন্ম দিতে পারে। তিন থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত চিতাশাবকরা অসহায় অবস্থায় থাকে। এই সময় বহু শাবক সিংহ, হায়না, ঈগল প্রভৃতি প্রাণীদের আক্রমণে মারা যায়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা চিতা-শিশুমৃত্যুর হার কখনো কখনো 90 শতাংশও হয়ে থাকে। 16-18 মাস পর্যন্ত চিতাশাবকেরা মা-এর সঙ্গেই থাকে। স্তন্যপান বন্ধ হলে শিকার ধরা শেখে। দু’বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। তখন এরা আলাদা হয়ে যায়। চিতার নির্দিষ্ট কোনো প্রজননকাল নেই। সারা বছরই এরা প্রজননক্ষম থাকে। তাই প্রকৃতির নিয়মেই ভারসাম্য রক্ষার জন্য এদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি।

চোরাশিকারীদের হাতেও অনেক চিতা মারা যায়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পিছনে আরও একটি কারণ আছে। সেটা হল জেনেটিক (genetic) ত্রুটি। চিতার পাঁচ-ছয়টি উপ-প্রজাতির মধ্যে কয়েকটি আজ বিলুপ্ত। সিংহ তথা অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীদের সঙ্গে শক্তিতে পেরে না ওঠায় এদের বিচরণ ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। ফলে এদের মধ্যে অর্ন্তজনন (inbreeding)-এর হার খুব বেশি। প্রায় দশহাজার বছর ধরে চলা এই প্রজননগত ত্রুটির জন্য এদের মধ্যে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। চিতার শিশুমৃত্যুর হার বেশি হওয়ার এটাও একটি কারণ। তাই এত দ্রুত সংখ্যাহ্রাস। একসময় আফ্রিকা-এশিয়া মিলিয়ে 45 টি দেশে চিতা ছিল। বর্তমানে এশিয়ার একমাত্র ইরাণে (মাত্র কয়েকটি) এবং আফ্রিকার 18-20 টি দেশে হাজার দশেক চিতা আছে বলে শোনা যায়। সবচেয়ে বেশি চিতার দেখা পাওয়া যায় দক্ষিণ আফ্রিকার নাম্‌বিয়ায়। সেখানে হাজার আড়াই চিতা আছে।

ক্ষিপ্রতার প্রতিমূর্তি চিতাকে যদি কোনো মানুষের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেওয়া যায় তাহলে কে জিতবে? স্বাভাভিকভাবেই মনে হবে চিতা। কারণ স্থলজীবি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে চিতাই সবচেয়ে জোড়ে দৌড়ায়-এটাই আমাদের জানা। 100 মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় জামাইকার দৌড়বীর উসেন বোল্টের (Usain Bolt) অলিম্পিক রেকর্ড 9.58 সেকেন্ড। 2012 সালের 3 আগস্ট এই দূরত্ব অতিক্রম করতে একটি মেয়ে চিতা সময় নিয়েছিল মাত্র 5.95 সেকেন্ড। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে উসেন বোল্ট মেয়ে চিতাটির কাছে বারবার হেরে যাবে। মূলতঃ তিনটি কারণের জন্য চিতা এত দ্রুত ছুটতে পারে-

  • চিতার সামনের (বুকের) পা-দুটি অপেক্ষাকৃত লম্বা,
  • শরীরের সঙ্গেযুক্ত চারটি পা সংলগ্ন মাংসপেশী অত্যন্ত নমনীয় (flexible) এবং চিতার লম্বা ও
  • নমনীয় মেরুদন্ড স্প্রিং-এর মত কাজ করে

ফলে এরা পূর্ণ শক্তি দিয়ে লাফাতে পারে। এক একটি লাফে এরা প্রায় 6.7 মিটার (22 ফুট) দূরত্ব অতিক্রম করে।

উত্তর একটাই-চিতা জিতবে। বিজ্ঞানীরা কিন্তু তা বলছেন না। তাঁরা বলছেন, এটা নির্ভর করবে কত দূরত্বের দৌড় প্রতিযোগিতা তার উপরে। 100 মিটারের মত 400 মিটারেও সে (চিতা) উসেন বোল্টকে খুব সহজে হারিয়ে দেবে। 400 মিটার দৌড়ের রেকর্ড রয়েছে আমেরিকার মাইকেল জনসনের হাতে। 1999 সালে 43.18 সেকেন্ডে ঐ দূরত্ব অতিক্রম করে তিনি রেকর্ড করেছিলেন। সেই সময় পাশের ট্রাকে একটি চিতাকে যদি নামিয়ে দেওয়া হত তাহলে গোল্ড মেডেল্টা জনসনের হাতছাড়া হত। ওটা ঝুলতো চিতার গলায়। কারণ ঐ দূরত্ব অতিক্রম করতে প্রাণীটির সময় লাগত মাত্র 16 সেকেন্ড। চিতার গতিবেগ একই ধরে নিলে 800 মিটার দৌড়ে সে সময় নেবে 32 সেকেন্ড। 2010 সালে কেনিয়ার ডেভিড রুডিশা (David Rudisha) 1 মি. 41.01 সে.-ঈই দূরত্ব দৌড়ে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন।

অঙ্কের হিসেবে রুডিশাকে চিতা খুব সহজেই হারিয়ে দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা হবে ন্না। চিতা ব্রোঞ্জ পদকও পাবেনা। সবার শেষে দৌড় শেষ করবে। অবাক হওয়ার মত কথা, তাই না?

চিতার শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা 102°F, আর মানুষের শরীরে ঐ তাপমাত্রা 98.6°F। দৌড়ানোর সময় চিতা এবং মানুষ উভয়ের শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে চিতার গতিবেগ ঘন্টায় 16 কিলোমিটারের বেশি হলেই এই অতিরিক্ত তাপের মাত্র 10 শতাংশ শরীর থেকে বেরিয়ে আসে। বাকি 90 শতাংশ শরীরে জমে থাকে। এরফলে দৌড়ানোর সময় চিতার শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে বাড়তে শেষে এমন একটা পর্যায় পৌঁছায় যখন এই অতিরিক্ত তাপ চিতার মস্তিষ্কে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে প্রাণীটি অচেতন হয়ে পড়ে। মানুষের ক্ষেত্রে এটা হয় না। প্রকৃতির নিয়মে এই অতিরিক্ত তাপ মানুষের শরীরের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। তাই 500 থেকে 550 মিটার দৌড়ানোর পর শরীর ঠান্ডা করার জন্য চিতাকে 15-20 মিনিট বিশ্রাম নিতে হয়।

শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে সে আবার পূর্ণ শক্তিতে দৌড়াতে পারে।চিতা যে সময় ধরে বিশ্রাম নেবে সেই সময়ের মধ্যে যে প্রতিযোগী সবার শেষে দৌড়াচ্ছিল সেও তাকে অতিক্রম করে প্রতিযোগিতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাবে। চিতা পৌঁছাবে সবার শেষে। তাই বলা যায় উসেন বোল্ডকে হারাতে পারলেও ডেভিড রুডিশাকে চিতা হারাতে পারবে না। এই শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যর জন্য চিতা যখন শিকার ধরে তখন অতি সন্তর্পনে শিকারের কাছাকাছি এসে ঝাপিয়ে পড়ে। সবসময় চেষ্টা করে তাকে যেন খুব বেশি দৌড়াতে না হয়। এতৎ সত্বেও আফ্রিকার ইম্‌পালা এবং গ্যাজেল অ্যান্টিলোপেরা চিতার থাবা এড়িয়ে অনেক সময়েই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরা আঁকাবাঁকা পথে দৌড়ে চিতাকে অনেক্ষণদৌড়াতে বাধ্য করে। তাড়া করার পর যদি সে 500-550 মিটারের মধ্যে শিকার ধরতে পারে তবে সেদিনের ভোজটা তার ভালই হয়, না হলে সারাদিন উপোস।

ছোটোবেলা খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্প বইয়ে পড়েছিলাম। সেখানেও দ্রুতগামী হয়েও খরগোশ হেরেছিল। গল্পের শেষে উপদেশে যাই বলা হোক না কেন এর পিছনেও কি একই বৈজ্ঞানিক কারণ?

চিতা ঘন্টায় 70-100 কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে। চোখের পলকে এরা শূন্য থেকে 75-80 কিলোমিটার গতিবেগ (ঘন্টায়) আয়ত্ব করতে পারে। মুহূর্তে এত গতিবেগ তোলা কোনো স্পোর্টস কার (sports car)-এর পক্ষেও সম্ভব নয়, অন্য স্থলজীবি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে তো নয়ই। পূর্ণ শক্তিতে যখন চিতা ছোটে তখন মনে হয় হলুদ রঙের একটি আলোর রেখা যেন ছুটে যাচ্ছে। দুরন্ত গতিতে ছোটার সময় গতিবেগ একটুও না কমিয়ে চিতা দিক পরিবর্তন করতে পারে। শরীরের তুলনায় লম্বা লেজ ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।

বিড়ালগোষ্ঠীর শিকারি প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র চিতাই পোষ মানে। আগেকার দিনের রাজা-মহারাজাদের মধ্যে চিতা পোষার শখ ছিল। পোষা চিতা নিয়ে তাঁরা শিকারে যেতেন। শিকারের পিছনে আলোক গতিতে চিতার দৌড় এবং শিকার ধরা তাঁদের আনন্দ দিত। আগেই বলেছি মুঘল সম্রাট আকবরের এক হাজার পোষা চিতা ছিল। এদের দেখভাল ও প্রশিক্ষণের জন্য একশ প্রশিক্ষক ছিল। দেশ স্বাধীন হবার সময় হায়দ্রাবাদের নিজামের এক ডজন পোষা চিতা ছিল। গ্যাজেল, ব্ল্যাকবাক, অ্যান্টিলোপ-এর মত প্রাণী শিকারের জন্য সৌরাষ্ট্রের অনেকেই সে সময় চিতা পুষতেন। শিকারে যাবার সময় চিতার গলায় বেল্ট বেঁধে দেওয়া হত এবং ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত আলখাল্লার মত পোষাক পরিয়ে দেওয়া হত।

বনের এই প্রাণীটিকে পোষ মানানোর জন্য কয়েক মাস ধরে প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করতে হত। এ ব্যাপারে সৌরাষ্ট্রের প্রশিক্ষকদের সে সময় যথেষ্ট নামডাক ছিল। প্রশিক্ষণ হত চার পর্যায়।

প্রথমে জঙ্গল থেকে সুস্থ, সবল, অল্পবয়সের চিতা ধরে এনে একটি ছোট কাঠের খাঁচায় কয়েকদিনের জন্য আটকে রাখা হত। খাঁচাটার এক দিকে লোহার গরাদ থাকত। ছাঁদ এবং বাকি তিন দিক কাঠের পাটাতন দিয়ে আটকে দেওয়া হত। সেই সময় প্রশিক্ষক তার পরিবার নিয়ে খাঁচার পাশে তাঁবু খাটিয়ে থাকত। মানুষের আনাগোনার ফলে চিতার ঘুমের ব্যাঘাত হত। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে থাকার ফলে চিতা ক্লান্ত হয়ে পড়ত এবং আক্রমণপ্রবণ মনোভাব অনেকটা কমে আসত। ধীরে ধীরে প্রাণীটির মানুষের সংস্পর্সে থাকা অভ্যাস হয়ে যেত। কিছুদিন পরে, চিতা কিছুটা বাধ্য হলে খাঁচার কাঠের পাটাতনের গায়ে হাত ঢোকে এরকম একটা ছোট গর্ত করা হত। সেই গর্ত দিয়ে হাত ঢুকিয়ে চিতার গলায় একটা চামড়ার বেল্ট পরিয়ে দেওয়া হত। চিতা গলার বেল্ট যাতে কোনোমতেই খুলে ফেলতে না পারে সে জন্য পিছনের দিকে আরও একটি বেল্ট পরিয়ে দেওয়া হত এবং সেটা গলার বেল্টের সঙ্গে আটকে দেওয়া হত। উদ্দেশ্য অস্বস্তিকর পরিবেশে দিনের পর দিন রেখে চিতার মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং প্রশিক্ষকের কথা শুনতে বাধ্য করা।

এরপর শুরু হ্ত দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণ। একটি স্বল্প উচ্চতার টেবিলে মাংসের কয়েকটি টুকরো রেখে খাঁচার সামনে রাখা হত। খাবার দেখে প্রলুব্ধ হয়ে খাঁচার বাইরে বেরিয়ে এলেই একটি কম্বল দিয়ে চিতার সর্বাঙ্গ ঢেকে মাথায় ও পায়ে দড়ির ফাঁস পরিয়ে দেওয়া হত। প্রাণীটির যখন আর নড়াচড়া করার ক্ষমতা থাকত না তখন তাকে কোনো জনাকীর্ণ রাস্তার ধারে নিয়ে যাওয়া হত এবং সেখানে কোনো মোটা গাছ বা থামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হত। মাঝে মাঝে মাথা ও চোখের সামনে থেকে কম্বল সরিয়ে রাস্তার লোক দেখানো হত যাতে ভবিষ্যতে মানুষের ভিড় দেখে প্রাণীটি বিরক্ত না হয়। কম্বল দিয়ে মাথা, চোখ ঢাকা থাকার সময় চিতার সামনে গিয়ে জোরে জোরে খাঁকারি বা কাশির শব্দ করে তাকে ভয় দেখানো হত। এই কাজের জন্য লোক আগে থেকেই ঠিক করা থাকত। শব্দের উৎস দেখতে না পাওয়ায় চিতার মনে হত তাকে কেউ আক্রমণ করতে আসছে। ভয় পেয়ে বাঁধন ছিড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করত। শত চেষ্টা করেও যখন মুক্ত হতে পারত না তখন তার ধারণা হত যে মানুষ তার চেয়েও শক্তিধর। এই প্রশিক্ষণ চলত কয়েক সপ্তাহ ধরে। প্রথম প্রথম মানুষ দেখলে চিতার মেজাজ যতটা বিগড়ে যেত এরপর থেকে আর ততটা হত না।

তৃতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য থাকত মানুষের প্রতি চিতার রাগ প্রশমিত করা। চিতার জন্য তৈরি করা হত এক বিশেষ ধরনের গাড়ি। খাঁচা থেকে বের করে চিতাকে ঐ গাড়িতে তোলা হত। এই সময় চিতার চোখ বাধা থাকত এবং তিন-চারজন প্রশিক্ষিত মানুষ তাকে ধরে রাখত। গাড়ি সমেত চিতাকে শহরের ধারে কোনো ফাঁকা জয়গায় নিয়ে যাওয়া হত। সেখানে গাড়ি থেকে 100-125 গজ দূরে কম্বল মুড়ি দিয়ে একজন দাঁড়িয়ে থাকত। এরপর চিতার চোখের বাধন খুলে ছেড়ে দেওয়া হত। কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হত বলে কম্বল দেখলেই চিতা রেগে যেত। তাই ছাড়া পেয়ে দূরে কম্বল দেখে সেদিকে ছুটে যেত। চিতাকে ছুটে আসতে দেখে কম্বল মুড়ি দেওয়া লোকটা কম্বল ফেলে দিয়ে পালিয়ে যেত। চিতার যত রাগ কম্বলের উপর। তাই সেটাকে কামড়ে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত। এইভাবে কিছুদিন প্রশিক্ষণ দেবার পর চিতা কম্বল আর মানুষের পার্থক্য বুঝতে শিখত। ধীরে ধীরে সে মানুষকে আর তার শত্রু বলে মনে করত না।

এরপরে শুরু হত চতুর্থ অর্থাৎ শেষ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ। এই পর্যায় প্রথমেই চিতাকে শেখানো হোত নিজে নিজে গাড়ীতে (cart) ওঠা এবং নেমে আসা। এটা শিখে গেলে চিতাকে আর খাঁচায় রাখা হত না। এরপর প্রশিক্ষকের কাজ ছিল শিকারের জন্য চিতাকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া। সেসময় ভারতে প্রচুর ব্ল্যাকবাক পাওয়া যেত। জানা যায়, সারা ভারতে তখন চল্লিশ লক্ষেরও বেশি ব্ল্যাকবাক ছিল।

পুরুষ ব্ল্যাকবাক-এর পিঠের দিকটা সাধারনত কালো রঙের হয় এবং পেটের দিকটা থাকে সাদা রঙের। স্ত্রী এবং শিশু ব্ল্যাকবাক-এর গায়ের রঙ হালকা হলুদ-বাদামী হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণের সময় চিতাকে মূলতঃ ব্ল্যাকবাক শিকার করতে দেওয়া হত। শিকারে নিয়ে যাবার আগে প্রাণীটিকে চব্বিশ ঘন্টা কিছু খেতে দেওয়া হত না। নিঃশব্দে শিকারের কাছাকাছি পৌঁছে চিতার মাথা এবং চোখের বাধন খুলে দেওয়া হত। ক্ষুধার্ত চিতা সামনে শিকার দেখেই সেদিকে ছুট লাগাত। পিছন পিছন প্রশিক্ষক এবং তার সহকারীরাও দৌড়াত।

শিকার ধরার পরেই চিতা যাতে জঙ্গলে ঢুকে না যায় তাই তাকে ধরে গাড়িতে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন হত। কারণ একবার জঙ্গলে ঢুকলে সে আবার বুনো হয়ে যেত। এইভাবে কিছুদিন শিকারের প্রশিক্ষণ পাবার পর চিতার স্বভাব হয়ে যেত পোষা কুকুরের মত। সাত-আট মাসের প্রশিক্ষণ শেষ। রাজা-মহারাজাদের শিকারের সফর সঙ্গী হতে তখন চিতা তৈরি।

রাজা-মহারাজাদের কাছে শিকার ছিল এক ধরনের ক্রীড়াকৌতুক। তাঁদের এই বিনোদনের জন্য সেদিন যেমন হাজার হাজার ব্ল্যাকবাক, গ্যাজেল, অ্যান্টিলোপদের প্রাণ দিতে হয়েছিল, তেমন ভারতের মাটিতেও আজ আর চিতা খুঁজে পাওয়া যায়না।


কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়: জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখালেখি।