স্থাপত্য শিল্পে বাবুই বনাম নালসো
স্থাপত্য শিল্পে বাবুই পাখির নামডাক আছে। ঘাসের শিস, ধান, তাল, খেজুর সুপারী, বাজরা, আম, নারকেল প্রভৃতি গাছের কঁচি পাতা দিয়ে যে বাসা এরা তৈরি করে তা অন্যান্য পাখির বাসা থেকে একেবারে আলাদা। ঠিক যেন সাপুড়েদের বাঁশি অথবা উলটোনো বোতলের মতো। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয় পাখিটির শিল্পবোধ দেখে। বুননের শৈলীর জন্য তাঁতি পাখি নামেও সে আমাদের কাছে পরিচিত। তবে বাসা বানানোর ক্ষেত্রে শুধু বাবুই পাখি নয়, জীবজগতে আরও অনেকের মধ্যে শিল্প নৈপুন্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে কীট-পতঙ্গ জগতে নালসো পিঁপড়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এদের বাসা বানানোর কায়দাটি অভিনব।
নিয়মানুবর্তিতা-র কথা বলতে গিয়ে আমরা উদাহরণ স্বরূপ প্রায়শই পিঁপড়ের কথা উল্লেখ করি। দলবদ্ধ এবং উন্নত জীবন যাপনেও এরা অভ্যস্ত। পিঁপড়েদের মধ্যে অনেক প্রজাতি আছে। প্রত্যেক প্রজাতির পিঁপড়ে তাদের নিজস্ব সামাজিক বিধি মেনে চলে। মৌমাছির মতো এরাও পুরুষ, রানী ও শ্রমিক এই তিন ভাগে বিভক্ত।
বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়ের বাসা বানানোর ধরণ বিভিন্ন। এদের মধ্যে নালসো পিঁপড়েদের বাসা খুবই আকর্ষণীয়। গাছের পাতার মধ্যে এই বাসাগুলি এমনভাবে লুকোনো থাকে যে গাছের ডালে পিঁপড়ের সারি দেখা গেলেও এদের বাসাগুলি চট্ করে দেখা যায় না। সেদিক থেকে বাবুই পাখির প্রকৃতি অন্য ধরনের। এদের ঘন জঙ্গল অপছন্দ। তাই এরা উন্মুক্ত স্থানে অথবা স্যাঁতসেঁতে জলাজমির কাছে তাল, বাবলা, মহুয়া, সুপারি, খেজুর ইত্যাদি গাছে বাসা বানায়। কখনও কখনও বাড়ির বারান্দা অথবা খোলার চালের কোণেও এদের বাসা বানাতে দেখা যায়। পছন্দ মতো জায়গা পাবার পর কেবল পুরুষ বাবুই বাসাগুলি তৈরি করে। নালসো পিঁপড়েদের ক্ষেত্রে হাজার হাজার শ্রমিক পিঁপড়ে বাসা বানাতে অংশ গ্রহণ করে। পুরুষ পিঁপড়েদের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। পরিশ্রম লাঘবের জন্য অনেক সময় পুরুষ বাবুইকে পুরোনো বাসার নীচে আরেকটি নতুন বাসা বানাতে দেখা যায়। নালসো পিঁপড়ের বাসা সেরকম হয় না।
বাসা বানানোর জন্য নালসো পিঁপড়ে সাধারণত সোজা ও লম্বা পাতার ফলক পছন্দ করে। আমাদের দ্দেশে আম গাছের পাতা এই ধরনের হয় বলে এই গাছই এদের বেশি পছন্দ। বাসা বানানোর সময় হাজার হাজার শ্রমিক পিঁপড়ে এক সঙ্গে কাজ করে। প্রথমে এরা পাশাপাশি দুটি পাতার প্রান্তভাগ (একটিকে মুখ দিয়ে কামড়ে এবং অন্যটিকে পা দিয়ে আঁকড়ে) টেনে ধরে। তখন আরেকটি দল পাতার উলটো দিকে গিয়ে পাতা দুটি জুড়তে থাকে। এই জোড়ার কাজটা বেশ অভিনব। পাতার পিছন দিকে যারা যায় তাদের প্রত্যেকের মুখে থাকে একটি করে তাদেরই শূককীট বা লার্ভা। শক্ত চোয়াল দিয়ে শ্রমিক পিঁপড়েরা যখন এই শূককীটগুলির দেহে চাপ দেয় তখন এদের মুখ দিয়ে রেশম সুতোর মতো এক ধরনের আঠালো সুতো বেরিয়ে আসে। টেনে ধরা পাশাপাশি দুটো পাতার প্রান্তভাগে তখন এরা শূককীটগুলির মুখ একবার এ পাতায় আরেকবার ও পাতায় ঠেকিয়ে ওই আঠালো সুতোর বুনোট দিতে থাকে। এইভাবে তারা একটার পর একটা পাতা জুড়ে একটা গোলাকার বাসা তৈরি করে। গাছের ডালে অগ্রভাগে যেখানে পাতা বেশ ঘন থাকে সেখানে এরা এই বাসাগুলি বানায়। তাই সাধারণত ডালের অগ্রভাগে এদের বাসাগুলি ঝুলতে দেখা যায়। বাবুই-এর বাসায় যেমন নীচের দিকে দরজা থাকে এদের বাসাতেও তেমনই নীচের দিকে একটি গোলাকার দরজা থাকে।
বাসা বানানোর পর বাবুই খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখে নেয় যে বাসাটির কোনো অংশ দুর্বল আছে কি না। সেরকম কোনো অংশ চোখে পড়লে তারা সেই জায়গায় কাদা বা গোবরের প্রলেপ লাগিয়ে শক্তপোক্ত করে নেয়। বাসা বানানোর পর নালসো পিঁপড়েরাও বাসাটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। কোথাও কোনো খুঁত বা ফুটো থাকলে শূককীটের মুখ থেকে বের হওয়া আঠালো সুতো সেখানে বারবার লাগিয়ে খুঁত সারিয়ে দেয় বা ফুটো বন্ধ করে দেয়। বাসাগুলি এত মজবুত হয় যে ঝড় জলেও সহজে নষ্ট হয় না। এমনকী বাসার ভিতরে এক ফোঁটাও জল ঢোকে না।
নালসো পিঁপড়েরা বাবুই পাখির মতো দোতলা, তিনতলা বাসা না বানালেও প্রয়োজনে এরা বেশ বড় আকারের বাসা তৈরি করে। বড় বাসা তৈরি করতে গেলে এদের নীচের ডালের পাতা দরকার হয়। দুটি ডালের পাতা জোড়ার সময় এরা অভিনব কৌশল প্রয়োগ করে। প্রথমে অসংখ্য পিঁপড়ে নির্মিয়মান বাসার নীচে এসে জড়ো হয়। তারপর একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে শিকলের মতো নীচে ঝুলে পড়ে। শিকলটি ক্রমশ বড় হতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত নীচের ডালের প্রয়োজনীয় পাতাটির নাগাল না পায়। নাগাল পাওয়া মাত্রই সেটাকে কামড়ে ধরে। এরপর শিকল ছোট করার পালা। উপর
থেকে পিঁপড়েরা শিকল ক্রমশ ছোট করতে করতে পাতাটাকে টেনে নির্মিয়মান বাসার কাছে নিয়ে আসে। এরপর আগের পদ্ধতিতে পাতাটাকে বাসার অন্য পাতার সঙ্গে জুড়ে দেয়। এইভাবে নীচের ডাল থেকে একের পর এক পাতা টেনে এনে নির্মিয়মান বাসার অন্য পাতার সঙ্গে জুড়ে বাসাটাকে বড় করে ফেলে।
নালসো পিঁপড়ে সাধারণত গাছের ডালে ডালেই ঘুরে বেড়ায়। তাই এদের গেছো পিঁপড়েও বলা হয়। লাল রঙের এই পিঁপড়ের চোয়াল খুব শক্ত হয়। এদের কামড়ে প্রচন্ড জ্বালা করে এবং কামড়ানো জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে ওঠে। এদের খাদ্য মূলত পিঁপড়ের ডিম, উইপোকা, মরা কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি। ক্ষুদ্র এই প্রাণীটির স্থাপত্য শিল্প দেখার মতো।
সায়েন্টিফিলিয়া ওয়েবজিনে(জানুয়ারি,২০১৬) প্রকাশিত।
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়: জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখালেখি।