স্লাইম মোল্ড-এর মস্তিষ্কবিহীন “স্মৃতি”
বহুকোষী ইউক্যারিওটিক জীবের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মস্তিষ্কের উপস্থিতি যা স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়। স্নায়ুতন্ত্রের অন্তর্গত এই মস্তিষ্কই জীবের সমস্ত শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে; পাশাপাশি কিছু ঘটনাকে চিহ্নিত করে সঞ্চয় করে রাখে, যাকে বলা হয় স্মৃতি। এই স্মৃতি সমগ্র বহুকোষী জীবের অস্তিত্ব রক্ষার এক উত্তম সহায়ক। খাদ্যের সন্ধান এবং ক্ষতিকারক যে কোনো বস্তু বা জীবের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই স্মৃতিই প্রধান ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি একটি এককোষী জীবের মস্তিষ্কবিহীন স্মৃতি বিজ্ঞানীমহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। এর ফলে জটিল স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন কার্যাবলীর উপর এক নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। সেই আশ্চর্য জীবটি হল- স্লাইম মোল্ড।
কি এই স্লাইম মোল্ড?
স্লাইম মোল্ড, বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম- Physarum polychephalum, হল উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের অ্যামিবা প্রজাতির এক বিশেষপ্রকার এককোষী জীব যার সমগ্র দেহ অন্তর্বর্তী নালিকা দ্বারা গঠিত। অ্যামিবার মতই, এরা দেহের সংকোচন ও প্রসারণ ঘটিয়ে খাদ্যগ্রহণ ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করে। এই সংকোচন-প্রসারণ কয়েক সেন্টিমিটার থেকে কয়েক মিটার পর্যন্ত হয়। Guinness Book of World Records এ বিশ্বের বৃহত্তম এককোষী জীবের তকমা পেয়েছে এই স্লাইম মোল্ড। এককোষী হওয়ার কারণে এই জীবের দেহে কোনও মস্তিষ্ক বা স্নায়ুতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু অত্যন্ত সচল এই জীবের, চারপাশের পরিবেশের তথ্য সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে তার ব্যবহার করার অভুতপূর্ব ক্ষমতা অবাক করে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের। অন্যান্য এককোষী অ্যামিবা প্রজাতির সদস্য জীবদের মধ্যে কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য এখনও অবধি পাওয়া যায়নি; স্লাইম মোল্ড নিঃসন্দেহে এক জ্বলন্ত ব্যতিক্রম।
কীভাবে মস্তিষ্ক ছাড়াই স্মৃতিচারণা করে এই জীব?
স্লাইম মোল্ড সাধারণতঃ নিজের জালের ন্যায় নালিকার সাহায্যে খাদ্যগ্রহণ ও নিজের যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করে এবং পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়ে জীবনধারণ করে। Max-Planck Institute for Dynamics and self-organisation এবং Technical University of Munich এর গবেষকরা স্লাইম মোল্ডের এই বিশেষ প্রক্রিয়ার উপর বিশদে জানতে এক পরীক্ষা করে। সেই পরীক্ষাতেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বিজ্ঞানীরা একটি পেট্রিডিশে একটি স্লাইম মোল্ড নেন ও তাতে একটি ভুল্ভুলাইয়ার ন্যায় ধাঁধাঁর আকারে বিভিন্ন জায়গায় খাদ্য দেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল স্লাইম মোল্ডের খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতির পর্যবেক্ষণ। সেই পরীক্ষায় তাঁরা লক্ষ্য করেন- স্লাইম মোল্ড যখনই খাদ্যের সন্ধান পায় তাদের দেহের আকৃতির বদল ঘটতে থাকে। খাদ্যের একেবারে সামনে যে অংশ থাকে, সেখান থেকে এক বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরিত হয় যা সেই স্থানের নালিগাত্রকে নরম করে দেয় এবং মোল্ডকে খাদ্যের দিকে এগোতে সাহায্য করে। ধীরে-ধীরে সেই অংশটি স্থূল হয় এবং দূরবর্তী অংশটি ক্রমশঃ পাতলা হয় ও এগিয়ে আসে। এইভাবে নিজের নালিময় দেহের বিভিন্ন অংশকে ক্রমাগত সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে বেশ দ্রুত গতিতে মোল্ড এগোতে থাকে খাদ্যের দিকে। খাদ্যগ্রহণ করার সময়ও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে।
এইভাবে নালির ব্যাসার্ধের ক্রমাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শুধু খাদ্যগ্রহণই করেনা; এই পদ্ধতি মোল্ডের নালিকার অন্তর্বর্তী গঠনের মধ্যে স্মৃতি হিসাবে সঞ্চিত হয়ে যায়। এরপর পূর্ববর্তী খাদ্যের জায়গায় আবারও আসলে, মোল্ড ঐ একই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকে যা মোল্ডের স্মৃতিচারণার এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। এই ঘটনা পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে, মস্তিষ্ক না থাকলেও মোল্ডের মধ্যে স্মৃতির একদম প্রাথমিক রূপ বর্তমান; সে পূর্ববর্তী খাদ্যের অবস্থান চিহ্নিতকরণে সক্ষম।
এই ঘটনা রীতিমত চমকিত করে বিজ্ঞানীদের এবং তাঁরা স্লাইম মোল্ডকে “বুদ্ধিমান” জীবের আখ্যা দেন। Proceedings of the National Academy of Sciences পত্রিকায় এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় এবং বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে- মস্তিষ্ক ছাড়াই স্লাইম মোল্ড পরিবেশের সকল তথ্যকে চিহ্নিতকরণ করতে পারে তার অনুসন্ধিৎসু নালির ব্যাসের দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
এই পরীক্ষা থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য পাওয়া যায়- নালিকা গঠন স্বতন্ত্রভাবে স্মৃতি সঞ্চয় করতে পারে এবং এই তথ্য এতদিনের স্নায়ুতন্ত্র ও স্মৃতিসঞ্চয়ের সম্পর্কে ধারনা সম্পূর্ণ বদলে দিল।
বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী Karen Alim এর মতে এই পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্মার্ট রোবট তৈরিতে কাজে লাগবে যা যেকোনো অজ্ঞাত ও জটিল পরিস্থিতিতেও কাজ করতে সক্ষম হবে।
তথ্যসূত্রঃ-
ঐন্দ্রিলা সাউ: পেশাদার বিজ্ঞান বিষয়ক কন্টেন্ট রাইটার। Amul কোম্পানি থেকে “বিদ্যাশ্রী” পদকপ্রাপ্ত।