সরীসৃপ সংবাদ – ১
মোসাস্যর – আশ্চর্য দংশন কৌশলবিশিষ্ট প্রাচীন সামুদ্রিক সরীসৃপ
মোসাস্যর-এর অদ্ভুত দাঁত ব্যবহৃত হত বৃহদাকার প্রাণী শিকারের সময়
বর্তমানে যেখানে উত্তর আফ্রিকার স্থলভূমি, সেখানেই ডাইনোসরদের সময় ছিল উষ্ণ জলের সমুদ্র। পৃথিবীতে বিশালকায় ডাইনোসরদের বিলুপ্তির আগে ব্যারাকুডা-র মতো সরীসৃপ গোত্রীয় তীক্ষ্ণদন্তী এক মাংসাশী প্রাণী এই উষ্ণ সমুদ্রগুলিতে টহল দিত।
সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত এই সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম থেকে উন্মোচিত হয়েছে এক অদ্ভুত তথ্য – এর দংশন প্রকৃতি জলে বা স্থলভাগে বসবাসকারী সমগোত্রীয় প্রাণীদের থেকে একেবারে আলাদা।
কোথায় আবিষ্কৃত হয় এই প্রাণীর জীবাশ্ম?
মরক্কোর ফসফেট খননকারীরা এই কৌতূহলোদ্দীপক জীবাশ্মটি প্রথম আবিষ্কার করেন – সাজানো দাঁতসহ উপরের পাটির কিছু অংশ। জীবাশ্মটি ক্রিটেশিয়াস যুগের একেবারে শেষদিকে বসবাসকারী বর্তমানে বিলুপ্ত সামুদ্রিক সরীসৃপ মোসাস্যর-এর (mosasaur)।
মোসাস্যর প্রজাতির এহেন নামকরনের উদ্দেশ্য
ইংল্যাণ্ডের বাথ্ বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Bath in England) জীবাশ্ম-বিশেষজ্ঞ নিক্ লংরিচ (Nick Longrich) এবং তাঁর সহকর্মীরা এই মোসাস্যর প্রজাতির নামকরণ করেন – ‘জেনোডেনস্ কামিন্কেরি’ (Xenodens calminechari)। ‘জেনোডেন’ কথার অর্থ হল ‘অদ্ভুত দাঁত’ আর ‘কামিন্কেরি’ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হল ‘করাতের মতো’।
সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত মোসাস্যর-এর দাঁতের বৈশিষ্ট্য
মোসাস্যর প্রজাতির প্রাণীরা সাপ এবং বিশালাকার মনিটর গিরগিটির স্বগোত্রীয়। এই মোসাস্যরদের দুই প্রকারের দাঁত দেখা যায় – প্রথমটি ছেদনকারী কৌণিক দাঁত যা পিচ্ছিল শিকার ধরতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়টি চ্যাপ্টা পেষক দাঁত যা শক্ত-খোলসযুক্ত প্রাণী শিকারে কাজে লাগে।
কিন্তু এই নতুন প্রজাতির মোসাস্যর-এর দাঁত একটু আলাদা ধরণের। এর দাঁত ছোটো, খাঁজযুক্ত, সমচতুর্ভুজাকার এবং ক্রমান্বয়ে ঘনবিন্যস্ত হয়ে ছুরির ধারালো ফলার মত আকার ধারণ করেছে। এমন ক্ষুরের মত ধারালো দাঁত মোসাস্যর প্রজাতির মধ্যে একেবারে নতুন এবং চতুষ্পদের বিবর্তনের ধারাক্রমে এই বৈশিষ্ট্য একেবারে স্বতন্ত্র।
কিছু কিছু মোসাস্যর প্রজাতি ছিল দক্ষ ও বিশালাকার শিকারী, এমনকি অনেক মোসাস্যরের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় একটি প্রমানাকারের স্কুল-বাসের সমান। তবে লংরিচ এবং তাঁর সহকর্মীরা জানিয়েছেন এই জীবাশ্মটির দৈর্ঘ্য ১ মিটারের কিছু বেশী।
মোসাস্যর প্রজাতির প্রাণীরা কিভাবে এই দাঁত ব্যবহার করত?
লংরিচ জানিয়েছেন যে এই এক্স.কামিনকেরি (X. calminechari’s) মোসাস্যরের দাঁত আসলে আধুনিক কালের ডগফিশ হাঙরের দাঁতের মতো যা কিনা বড় আকারের মাংসখণ্ডকেও নিমেষে কেটে বার করে ফেলতে পারে।
এই দাঁতের সাহায্যেই সে মাছ থেকে সি-অ্যানিমোন পর্যন্ত সবকিছুই খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতে পারত। ফলে এদের খাদ্যের ভাব হত না। আকৃতি ছোটো হলেও, এদের থেকে বড় প্রাণীদের শিকার করা কিংবা তাদের অবশিষ্টাংশ উদরস্থ করাতে অসুবিধা হত না কারণ এরা বড় মাছ, সেফালোপড (cephalopods) এবং দীর্ঘ গ্রীবাযুক্ত বিশালাকার প্লেজিওস্যরদের (orca-sized, long-necked plesiosaurs) সঙ্গে নিজের জলজ বাসা ভাগাভাগি করে থাকত।
নতুন প্রজাতির মোসাস্যর-এর আবিষ্কারের ফলাফল
এক্স.কামিনকেরির (X. calminechari’s) আবিষ্কারের ফলে ক্রিটেশিয়াস যুগে (Cretaceous period) মহাসাগরের বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ সম্পর্কে আলোকপাত করা সম্ভব হতে পারে। লংরিচ-এর মতে ডাইনোসরের যুগ শেষ হয়ে যাওয়া বা সেই বিশালাকায় উল্কাপিণ্ড পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার আগে পর্যন্ত এই মোসাস্যরদের শারীরিক গঠন, জীবনধারণ এবং খাদ্য গ্রহণের পদ্ধতি বারংবার পরিবর্তিত হয়েছে।
এই ক্ষিপ্র ব্যারাকুডার মতো সামুদ্রিক প্রাণীটির উপর করা গবেষণার ফলাফল থেকে সেই সময়কার বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যেতে পারে। কিন্তু সেই তথ্যাদি পেতে গেলে আরো কিছু জীবাশ্ম আবিষ্কারের প্রয়োজন যা অল্পবিস্তর সময়সাপেক্ষ।
সীমন রায়: জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখালেখি।