গোরিলারাও দায়িত্ব নেয় মা-হারা শাবকদের – অরণ্যের এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত
বছর কয়েক আগে, চারটি পাহাড়ি মাদী গোরিলা তাদের অসুস্থ আলফা-সিলভারব্যাক সঙ্গীটিকে ছেড়ে রেখে পালিয়ে যায়। সেই সঙ্গে ফেলে রেখে যায় তাদের ছোটো সন্তানদেরও। সেই গোরিলা শিশুদের নিজে নিজে খাওয়ার ক্ষমতাও তখন হয়নি। হয়তো সেই মাদী গোরিলাগুলি ভেবেছিল যে নতুন দলে গিয়ে তার বাচ্চাগুলো ঐ দলের পুরুষ গোরিলাগুলির রোষের শিকার হতে পারে, এমনকি তাদের হাতে বাচ্চাগুলির মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই সেই বাচ্চাগুলি তাদের অসুস্থ বাবার কাছেই নিরাপদে থাকবে মনে করে ফেলে যায় মাদী গোরিলারা।
বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী যাদের মায়েরা তাদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, তাদের খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবার সম্ভাবনা থাকে । ফলে স্বভাবতই ঐ গোরিলা-শিশুগুলির জন্য যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন গবেষকরা।
গরিলা ‘কুবাহা’র এই যে পালক পিতা হওয়ার ইচ্ছা
তবে চিন্তা দূর হল অচিরেই, এমনকি আশাতীত ঘটনাই ঘটলো বলা চলে। সেই বাচ্চাগুলির পিতৃস্থানীয় আরেক পুরুষ গোরিলা ‘কুবাহা’ বাচ্চাগুলির দেখাশোনা করা শুরু করে। নিজের বাসায় কুবাহা তাদের ঘুমোতে দিতো। ২৩তার পুরো শরীরটা জুড়ে বাচ্চাগুলি খেলে বেড়াতো। এমন অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য নজরবন্দি করেছেন ডিয়ান ফসি গোরিলা ফাণ্ডের (Dian Fossey Gorilla Fund) মুখ্য বিজ্ঞানী স্তন্যপায়ী বিশেষজ্ঞ তারা স্টয়ইন্সকি (Tara Stoinski)।
কুবাহার এই যে পালক পিতা হওয়ার ইচ্ছা এ কিন্তু অদ্ভুতভাবে অন্যান্য পাহাড়ি গোরিলাদের মধ্যেও দেখা গেছে সাম্প্রতিক গবেষণায়। রোয়্যাণ্ডায় গোরিলা ফাণ্ডের ‘কারিসোকে গবেষণা কেন্দ্র’-এ (Gorilla Fund’s Karisoke Research Center in Rwanda) পার্বত্য গোরিলাদের উপর ৫৩ বছর ধরে সমীক্ষা চালিয়ে জানা গেছে যে, ছোটো পার্বত্য গোরিলারা যখন তাদের মাকে হারায়, কোনো কোনো সময় বাবাকেও হারায় – তাদের মারা যাবার তেমন কোনো গুরুতর সম্ভাবনা যেমন থাকে না, তেমনি সমাজে তাদের অবস্থান-অস্তিত্ব একই থাকে, দলের বাকি সমস্ত সদস্যেরা তখন সেই অনাথ গোরিলা-শিশুগুলির পাশে এসে দাঁড়ায়।
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহারিক পরিবেশবিদ ম্যাথিউ জিপ্ল (behavioral ecologist Matthew Zipple of Duke University) এই গবেষণায় সরাসরি অংশ না নিলেও জানিয়েছেন যে, যেহেতু আমরা জানতাম যে সমাজবদ্ধ স্তন্যপায়ীদের মধ্যে ছোটো বয়সে মাকে হারানো খুবই খারাপ ঘটনা, এমতাবস্থায় এমন অভূতপূর্ব গবেষণা সত্যই বিস্ময়কর।
জিপ্ল এবং আরো দশজন স্তন্যপায়ী বিশেষজ্ঞ গতবছর এক গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন শিশু শিম্পাঞ্জি, বেবুন, গোরিলারা মাতৃদুগ্ধ পান করা বন্ধ করার পরেও মায়েদের প্রতি বিশ্বস্ত হয়, নির্ভরশীল হয় এবং ছোটো বয়সে মাকে হারালে তাদের মধ্যে কম বয়সেই মারা যাবার প্রবণতা দেখা যায়। এর কারণ আসলে তাদের মায়েরা ঐ শিশুদের একইসঙ্গে যেমন খাওয়াতো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতো তেমনিই সামাজিক নিরাপত্তা-অবলম্বন, শিকারি এবং অন্য পুরুষদের থেকে আত্মরক্ষার আড়াল সবই তারা মায়েদের থেকেই পেতো।
যদিও বা মাতৃহারা এই প্রানী বড়ো হয়, সামাজিকভাবে তাদের অবস্থান উচ্চে পৌঁছায় না এবং তাদের খুব বেশি সন্তানাদিও হয় না। অন্য আরেকটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে তিমি, হাতি এবং হায়েনার মতো অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীগোষ্ঠীকেও মা হারানোর এই সমস্ত বিপদগুলির সম্মুখীন হতে হয়।
কিন্তু পাহাড়ি গোরিলাদের মধ্যে মাতৃহারা হওয়ার কষ্ট কিংবা জটিলতা খুব একটা দেখা যায় না। স্টইন্সকি এবং পোস্ট-ডক্টরেট রবিন মরিসন সহ তার গোরিলা ফাণ্ডের সহকর্মীরা দাবি করেছেন, গোরিলাদের মতো স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে যেখানে প্রায়শই শিশুর বড় হবার আগেই মায়েদের ছেড়ে চলে যাবার মতো ঘটনা দেখা যায়, সেই সামাজিকভাবে এই জীবগোষ্ঠীটি অনাথ শিশুদের নিরাপত্তা দিতে এবং মা হারানোর ক্ষতিকর দিকগুলি থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য কালের নিয়মে বিবর্তিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় ২ বছর থেকে ৮ বছর বয়সী ৫৯টি শিশু গোরিলা যারা খুব অল্প বয়সে তাদের মাকে হারিয়েছে তাদের উপর এই প্রকল্পটি তারা পরীক্ষা করেন। তারপরে তারা এই অনাথ শিশু গোরিলাদের জীবনচক্রের সঙ্গে আরো ১৩৯টি স্বাভাবিক সমাজবদ্ধ গোরিলা-শিশুর জীবনচক্রের তুলনা করেন। প্রজননিক সাফল্য এবং বড়ো হবার পরে তাদের সামাজিক অবস্থানেরও তুলনা করেন তারা এবং শনাক্ত করেন যে কার সঙ্গে তারা জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিল।
অনাথ কিংবা মাতৃহারা শিশু গোরিলাদের ক্ষেত্রে শুধু যে মৃত্যুর কোনো বড়ো ঝুঁকি দেখা যায় না তা নয়, তাদের প্রজনন ক্ষমতার উপরও দীর্ঘস্থায়ী কোনো কু-প্রভাব পড়ে না, তাদের সামাজিক অবস্থানও বিঘ্নিত হয় না বলেই ই-লাইফ-এ জানিয়েছেন সেই গবেষক দল। এমনকি কোনো কোনো মা-হারা পুরুষ গোরিলা তাদের দলের সবথেকে বেশি প্রভাবশালী সিলভারব্যাকে পরিণত হয়েছে।
স্তন্যপায়ী বিশেষজ্ঞ অ্যানে পুসি (Duke primatologist Anne Pusey) এই কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না হলেও জানিয়েছেন এই গবেষণা সত্যই ভয়ঙ্কর। দীর্ঘসময় ধরে এই স্তন্যপায়ীদের উপর চলা ক্ষেত্র-সমীক্ষা থেকে তিনি লক্ষ্য করেছেন যে অনাথ গোরিলা-শিশুদের সংখ্যা এতই বেশি যে তা ছোটো শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে সহজেই তুলনীয়। সেই তথ্য থেকে পাওয়া যাচ্ছে, যে শিম্পাঞ্জিরা অনেক কম বয়সে মারা যাচ্ছে কিংবা অন্য কোনো কু-প্রভাবে ভুগছে তারা আসলে মা-হারা কারণ স্ত্রী শিম্পাঞ্জিরা অহরহ দল বদলায় না এবং গোরিলাদের থেকে অনেক বেশিদিন পর্যন্ত এই শিম্পাঞ্জি শিশুরা মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে।
এখন জিপ্ল বলছেন, গবেষকরা কিছু দশক ধরে বনোবো এবং অন্যান্য প্রজাতিদের উপর পরীক্ষা চালিয়ে সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে চাইছেন যে এরাও অনাথ শিশুদের দেখভাল করে কিনা। গত সপ্তাহে একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ পেয়েছে যে দুটি স্ত্রী বনোবো অন্য সামাজিক গোষ্ঠীর শিশুদের লালন পালন করছে বলে দেখা গেছে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে।
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহারিক পরিবেশবিদ সুসান অ্যালবার্টস (Duke behavioral ecologist Susan Alberts) দেখেছেন মানুষের মধ্যেও এই পরোপকারী মনোভাব লক্ষ করা যায় এবং পিতৃস্থানীয়রা ছোট্টো স্তন্যপায়ীগুলির দেখাশোনায় গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা নেয়। তিনি বলেন, ‘মানুষ বাদে অন্য স্তন্যপায়ীরা প্রায়ই খুব যত্নবান পিতার দায়িত্ব পালন করে থাকে এবং এটাই প্রমাণ করে যে স্তন্যপায়ীদের মধ্যে পিতার যত্ন-আত্তির একটি সুগভীর ধারাক্রম রয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ theconversation.com
সীমন রায়: জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখালেখি।