অথ প্রজাপতি কথা
যোগ্যতমের উদ্বর্তন (survival of the fittest)!
প্রাকৃতিক নির্বাচন ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার যে লড়াই’-এর তত্বের কথা ডারউইন সাহেব বলে গেছেন বাস্তবে সেই লড়াই ই তো জারি আছে প্রতি মুহূর্তে সমগ্র উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতে, উন্নততম জীব মানুষ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম কীটপতঙ্গের মধ্যেও। অবশ্যই এই লড়াই বা পরিবেশের সঙগে মানিয়ে নেওয়ার মাত্রা ও ধরন ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। তবে একথা তো অনস্বীকার্য যে এই লড়াই ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াই হল অস্তিত্ব রক্ষা ও টিঁকে থাকার একমাত্র শর্ত। সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে এই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের অজস্র অভিনব উপায় ও পদ্ধতি সমূহ লক্ষ্য করলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়।
ভাবা যাক নয়নভোলানো রংবেরং’-এর আহ্লাদি ডানা মেলে ওড়া প্রজাপতির কথা। সারা পৃথিবীতে এই যাবত প্রায় 18000 রকমের বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি প্রাণী বিজ্ঞানীরা সনাক্ত করেছেন। আর দুই মেরু অঞ্চল ছাড়া বিশ্বের প্রায় সমস্ত অঞ্চলেই নানা প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মেলে। এখন পর্যন্ত 56 কোটি বছরের পুরোনো প্রজাপতির জীবাশ্ম ও পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে যে এই প্রজাপতিকুল সেই সুদূর প্যালিওসিন যুগ (Paleocene age) থেকে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। অতি ক্ষুদ্র ডিম থেকে লারভা/শুঁয়োপোকা, তারপর দীর্ঘ সময় ক্রিসালিসে আবদ্ধ থাকা। অবশেষে ক্রিসালিসের আবরণ ভেদ করে উজ্জ্বল সুন্দর ও দীর্ঘ ডানা মেলে বেরিয়ে আসা। তিতলি’র জীবনচক্রের এই তত্ব কমবেশী আমাদের সকলেরই জানা। তবে এই ডানা মেলা প্রসঙ্গে বোধ হয় অনেকেই অবহিত নন যে সারা বিশ্বে সমগ্র পতঙ্গকুলের মধ্যে প্রজাপতিকুল যে বিষয়ে প্রথম স্থানাধিকারী তা হলঃ ”শরীরের আয়তনের তুলনায় দীর্ঘতম ডানার অধিকারী এই প্রজাপতিকুল।”
‘ক্রিসালিস’এর আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসার পর একটি পূর্ণ বয়স্ক প্রজাপতির আয়ুস্কাল কিন্তু খুবই কম। বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির মধ্যে এই স্বল্প আয়ুষ্কাল এর ব্যাপ্তি (range) মাত্র এক সপ্তাহ থেকে এক মাস। ফিমেল প্রজাপতিরা তাদের এই স্বল্প আয়ুষ্কালের একটা বড় অংশে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রাখে প্রজনন প্রক্রিয়ায়।এভাবেই তারা প্রতিরূপ নির্মাণের মধ্য দিয়ে উত্তরপুরুষকে প্রকৃতিতে স্থিত করে বিবর্তনের ধারাকে অব্যাহত রাখে। চার্লস ডারউইন তো এমন কথাই বলেছিলেন তাঁর বিবর্তনবাদ তত্ত্বে। নিবিড় পর্যবেক্ষণে’ও এমনটাই লক্ষিত হয়েছে যে ফিমেল প্রজাপতিরাই প্রধানত উদ্যোগী হয় পুরুষ প্রজাপতিকে আকৃষ্ট করতে ও মিলনে লিপ্ত হতে। পরবর্তী পর্যায়ে ফিমেল প্রজাপতি একটি সুনির্বাচিত গাছের পাতার ওপর ডিম পাড়ে। নির্বাচিত গাছটি এমন হয় যে সেই গাছের পাতা ডিম ফুটে বেরোনর পরে লারভা/শূককীট কে যথেষ্ট পরিমাণে উপযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করে পুষ্টি ও শক্তি দিতে পারে। এই লব্ধ পুষ্টি ও শক্তির দ্বারাই লারভা পরিনত হয় ডানামেলা গতিশীল প্রজাপতিতে। আর এভাবেই প্রকৃতির বুকে আবার একদল নতুন প্রজন্মের তিতলীর আগমন সূচিত হয়।
মিলন ও প্রজননের পাশাপাশি ফিমেল ও পুরুষ প্রজাপতি উভয়ই কিন্তু আরও এক লড়াই চালিয়ে যায়। সেটা হল অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী শিকারী (predators) পতঙ্গকুলের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার লড়াই। সুদীর্ঘ পর্যবেক্ষণ পর্বে প্রাণী বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন আত্মরক্ষার জন্য বেশীরভাগ প্রজাতির প্রজাপতিই প্রধানত দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করে। তাঁরা সেই দুটি পদ্ধতির নামকরণ করেছেন যথাক্রমে: Müllerian mimicry & Batesian mimicry.
Müllerian mimicry
Müllerian mimicry হল কোন কোন প্রজাতি আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে ছদ্মবেশ ধারন করে অন্য এক প্রজাতির যারা খাদ্য হিসাবে বিষাক্ত অথবা খারাপ স্বাদের জন্য প্রিডেটরের কাছে খাদ্য হিসেবে ব্রাত্য। এখানে উল্লেখ্য যে বিষাক্ত প্রজাতির প্রজাপতিরা সাধারণত হয় অতিরিক্ত উজ্জ্বল ও সুন্দর আকর্ষণীয় ডানার অধিকারী। আর এরা খুব নিশ্চিন্ত ভঙ্গীতে (carefree style) নির্ভয়ে উড়ে বেরায়। শিকারী পতঙ্গরা এদের সহজেই সনাক্ত করতে পারে এবং এড়িয়ে চলে।
Batesian mimicry
Batesian mimicry হল কোন কোন প্রজাতির প্রজাপতি নির্বাচিত কিছু কিছু গাছ থেকে টকসিন (toxin) সংগ্রহ করে তাদের দেহের কলায় (tissue) সংরক্ষিত করে রাখে। আর এই টকসিনের উপস্থিতি এদেরকে খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত বিস্বাদ ও অযোগ্য করে তোলে। অতএব শিকারী পতঙ্গকুল এদের এড়িয়ে চলে।
অপার রহস্যময় বিপুলা এই প্রকৃতির বুকে এভাবেই বোধ হয় প্রকৃতিরই গড়ে দেওয়া নিয়মে লক্ষ্য কোটি বছর ধরে বহু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীও তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সামিল হয়ে চলেছে।
ড. অঞ্জনা ঘোষ: বিজ্ঞান লেখিকা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অজৈব রসায়নে পিএইচডি | বর্তমানে অশোক হল বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সিনিয়র বিভাগ)-এর শিক্ষিকা।