ইমিউনিটি বা শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা
ভাইরাস ভাইরাস ভাইরাস!
চারিদিকে শুধু ভাইরাসের কথা। কারণ ভাইরাস নামের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বাভাবিক চোখে না দেখতে পাওয়া জিনিস আমাদের জীবনে এনে দেয় এক চরম সংকট। একটি ভাইরাসের গড় ব্যাস ২০ থেকে ৪০০ ন্যানো মিটার। এক ন্যানো মিটার হল এক মিটারের একশ কোটি ভাগের এক ভাগ (10^-9)। তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে কি বিশাল রকমের ছোট এগুলো। আমাদের বাতাসে তাই কোটি কোটি বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বাতাসে, কখনও জলে, কখনও কোনও বস্তুতে আবার কখনও কোনও প্রাণীর দেহে।
কিন্তু এত যে সব প্রচন্ড শক্তিশালী ভাইরাস তাদের আক্রমণের ফলে তো আমাদের শেষ হয়ে যাবার কথা। এমন কি অবলুপ্তি ঘটার কথা অন্য অনেক প্রাণীরও, কারণ ভাইরাস তো শুধু মানুষকেই আক্রমণ করে তা নয়, পশুপাখী, কীটপতঙ্গ এমন কি গাছেদেরও। কই তা তো হচ্ছে না। কেন?
একটা উদাহরণ দিই খুব সহজ করে:-
ধরুণ এক জায়গায় গোলাগুলি চলল। গোলা মানে কামানের গোলা নয় কারণ তাতে তো সব উড়ে যাবে। ধরুণ বন্দুকের গুলি চলল। দশজন লোক ছিল তারা সব মরে গেল। কিন্তু একজন পড়ে গিয়েও হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। কারণ সে মারা যায় নি।
লোকটা কি কোনও অলৌকিক বলে বলীয়ান? ভূত-প্রেত বা দৈব শক্তি?
একটু পরেই জানা গেল আসল ব্যাপারটা। শার্টের বোতাম খুলে সে দেখাল সেখানে রয়েছে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। এই বুলেট প্রুফ জ্যাকেট হল মানুষের ইমিউনিটি।
সমস্ত মানুষ এক হয় না। তেমনি ইমিউনিটিও সব মানুষের এক হয় না। কারোর হয় কম বা কারোর হয় বেশি। যাদের কম হয় ভাইরাস তাদের ঘায়েল করে ভূপতিত করে বন্দুকের গুলির মত। আর যাদের বেশি তাদের রক্ষা করে বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের মত।
ইমিউনিটি কী?
ইমিউনিটি হল শরীরের এক স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা যা ভাইরাসের হাত থেকে তাকে রক্ষা করে। শুধু ভাইরাস নয়, ব্যাকটিরিয়ার আক্রমণও প্রতিহত করতে পারে।
আমাদের শরীরের শ্বেতরক্তকণিকা আমাদের এই প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটির জন্যে দায়ী।রক্তকণিকার মধ্যে উপস্থিত লিম্ফোসাইটের এই ভাইরাস গিলে ফেলার ক্ষমতা আছে।একে বলে ফ্যাগোসাইটোসিস (phagocytosis)।
লাল রক্তকণিকা
লাল রক্তকণিকা এবং প্ল্যাটেলেটের কোনও নিউক্লিয়াস না থাকলেও শ্বেত রক্তণিকার একাধিক নিউক্লিয়াস থাকে। নিউক্লিয়াস হল কোনও কোষের কেন্দ্রে অবস্থিত মুখ্য এক অংশ যেটা তার প্রাণশক্তি যোগায়। আর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত করে।
শ্বেতকণিকা
শ্বেতকণিকার মধ্যে আছে নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল, ব্যাসোফিল, লিম্ফোসাইট এবং মনোসাইট। এদের প্রত্যেকের নিজ নিজ কাজ আর দায়িত্ব আছে। এত গভীরতা বা বিস্তারে না গিয়ে আমরা খুব সাধারণভাবেই ইমিউনিটির বিষয়ে অবগত থাকার চেষ্টা করব।
ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া যখন আক্রমণ করে তখন কি হয়?
ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়াগুলি প্রধানত শরীরের দুর্বল, স্পর্শকাতর আর সহজ প্রবেশ্য জায়গাগুলি বেছে নেয় শরীরে প্রবেশ করার জন্যে। এই জায়গাগুলি হল অন্ত্র বা ইন্টেস্টাইন, মূত্রযন্ত্র বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট, শ্বাসযন্ত্র বা রেসপিরেটরি অর্গান, চামড়া বা স্কিন ইত্যাদি।
ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া যখন আক্রমণ করে তখন রক্তের শ্বেতকণিকায় উপস্থিত এই লিম্ফোসাইট শরীরে এন্টিবডি তৈরি করে যারা ভাইরাসের কণাগুলির (এন্টিজেন) সঙ্গে লড়াই করতে পারে আর করে। তাই এত ভাইরাস উপস্থিত থাকা সত্বেও আমরা সর্বদা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হই না।
তবে যদি ভাইরাস খুব শক্তিশালী হয় বা আমাদের শারীরিক প্রতিরোধ যদি কম হয় তবে ব্যাকটিরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয় বা হতে পারে। সেক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক অথবা ভ্যাকসিন যার যেমন দরকার দিতে হয়। সেগুলি চিকিৎসা আর চিকিৎসকের ব্যাপার।
একের প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যের থেকে আলাদা কেন?
যেহেতু মানুষের শরীর একজনের থেকে আর এক জনের আলাদা তাই একের প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যের থেকে আলাদা। অর্থাৎ কারোর কম বা কারোর বেশি।
আবার কেউ যদি দীর্ঘকাল বিভিন্ন অসুখে ভোগে তবে তাদের ইমিউনিটি কমে যেতেও পারে। ইমিউনিটি কম থাকলে বা কম হয়ে গেলে মানুষের বিভিন্ন রোগে ভোগা বিশেষ ভাবে ইনফেকশন জনিত রোগে ভোগা বেড়ে যেতে পারে। এটিকে বলা হয় সাসসেপ্টিবিলিটি (susceptibility)বারোগপ্রবণতা। যেমন চট করে সর্দিকাশি লেগে যেতে পারে। জ্বর, পেট খারাপ ইত্যাদি। মূত্রযন্ত্রে হলে মূত্রজনিত সমস্যা, চামড়ায় হলে বিভিন্ন প্রকারের চর্মরোগ ইত্যাদি। তাছাড়া কৃমির সংক্রমণ তো আছেই।
বোঝার জন্যে কোনও দেশের সৈন্যবাহিনীর কথা ভাবুন। যখন বিদেশী আক্রমণ হয় তখন বিদেশের সৈন্যদল বাছবে সেই দুর্বল স্থানগুলি যেগুলিতে তারা সহজে প্রবেশ করতে পারে আর যেগুলিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত কম জোরাল।
বিদেশী সৈন্যদলের জায়গায় ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়াকে বসিয়ে দিন আর স্বদেশের জায়গায় নিজের শরীরকে। তাহলেই জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে আসবে। বাইরের সেনা যখনই আক্রমণ করে তখন সেই খবর পেয়ে আমাদের আভ্যন্তরীন সৈন্যদল সেখানে ছুটে আসে আর শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে এই বহিরাক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে। শরীরের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। রক্তের শ্বেতকণিকা মুহূর্তে বুঝে যায় কি ধরণের আর কতটা বেশি সংক্রমণ হয়েছে। সেইমত শ্বেতকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি উৎপাদনের জন্যে।
রক্ত হল কানেক্টিভ টিসু আর তাই সমস্ত শরীরে তার অবাধ যাতায়াত। সব কোষের সঙ্গে তার যোগাযোগ। সেইজন্যে প্রকৃতি ইমিউনিটিকে জুড়ে দিয়েছে রক্তকণিকার সঙ্গে। প্রতিটি দেশ যেমন চায় দেশ সুরক্ষিত থাকুক তেমনি শরীর চায় সে যেন সুরক্ষিত রাখতে পারে নিজেকে আর তাই এই সমস্ত স্বনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা।
আশা করা যায় ইমিউনিটি সম্পর্কে কিছু ধারণা স্পষ্ট ভাবে দেওয়া গেছে। মূল কথাটা হল শরীর রক্ষার জন্যে ইমিউনিটি বজায় রাখতে হয়। নানা কারণে মানুষের ইমিনিটি কমতে পারে। যেগুলোতে সরাসরি মানুষের কোনও হাত নেই। তবে মানুষ বিশেষ কিছু চেষ্টায় তার ইমিউনিটি বজায় রাখতে পারে বা কিছু বাড়াতে পারে। এগুলি হলঃ
- নিয়মিত শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করা
- ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ
- অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বর্জন
- গ্রীন-টি পান
- পান বা ধূমপান বর্জন করা বা কমান
- কৃত্রিম রঙ বা গন্ধযুক্ত খাদ্য বর্জন করা বা যথাসম্ভব কমান
- সুস্বাস্থ্য সচেতনা
- যথেষ্ট পরিমাণ ঘুম
- প্রাণ খুলে হাসা
- টাটকা সবুজ শাকসব্জি গ্রহণ।
এখন ধীরে ধীরে এই তথ্যগুলিকে বিস্তারিত করা দরকার
১। নিয়মিত শরীর চর্চা বা ব্যায়ামঃ
ব্যায়ামে শরীরের রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়ে আর অতিরিক্ত অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করে। এই অক্সিজেন খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে। শ্বাসযন্ত্রগুলিও পরিপুষ্ট থাকে। রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পেলে অক্সিজেনের গ্রহণ আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বর্জন দ্রুত হয়। শরীরে পুষ্টি বাড়ে আর ইমিউনিটি বৃদ্ধি পায়।
যোগাভ্যাস হল অতি উৎকৃষ্ট অভ্যাস। এতে শরীরের মধ্যে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় ও কোষগুলিতে অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। অক্সিজেনের বৃদ্ধি মেটাবলিজমে (metabolism) সহায়তা করে।
২) ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণঃ
ভিটামিন ডি (Vitamin D) হাড়ের যেমন পুষ্টি ঘটায় তেমনি শ্বাসযন্ত্রের ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে পারে। সূর্যালোক বা রোদে শরীর কিছুক্ষণ মানে অন্তত চার থেকে বেশ কয়েক ঘন্টা উন্মুক্ত রাখতে পারলে চামড়ার মধ্যে সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি পড়ে চামড়ার প্রো-ভিটামিন ডি থেকে ভিটামিন ডি তৈরি করে নিতে পারে।
তবে আমাদের দেশে বিশেষভাবে মহিলাদের পক্ষে এটি খুব অসুবিধাজনক। কারণ আমাদের মত দেশের অনেক বেশি অঞ্চলেই আব্রু রক্ষার্থে বেশির ভাগ মহিলার শরীরের অধিক অংশ আবৃত রাখেন। তা ছাড়াও মহিলারা ত্বকের উজ্জ্বলতা বা বর্ণের পরিবর্তনের ব্যাপারে বেশ সচেতন আর সংবেদনশীল। সেজন্যে বেশি সূর্যালোক চামড়ায় প্রবেশ করতে দিতে চান না।
এছাড়াও তাঁরা চামড়ায় নানা রকম মলম ব্যবহার করেন যেগুলি সূর্যরশ্মি প্রতিরোধক। এমন কি চোখেও রোদচশমা বা সানগ্লাস ব্যবহারে অভ্যস্ত। ফলে ভিটামিন ডি সংশ্লেষণ তাদের একটু কম হওয়াই স্বাভাবিক।
এখানেও অবশ্য কিছু মাত্রাভেদ আছে। পেশা হিসেবে যে সব মহিলা শ্রমজীবী বা নিম্নবিত্তের তাঁরা বিভিন্ন কারণে এত সংবেদনশীল আর সচেতন থাকতে পারেন না। তাঁদের শরীরে তাই সূর্যরশ্মি অনেক বেশি পরিমাণে পড়ে আর প্রতিরোধ ক্ষমতা উচ্চবিত্তদের থেকে একটু বেশি। অবশ্য শুধু এই কারণেই নয়, আরও অনেক কারণ আছে তবে সেগুলি অবশ্যই প্রসঙ্গান্তর।
এখানে কিন্তু গড় হিসেবের কথাই বলা হচ্ছে ব্যতিক্রম নয়। আরও একটি বিষয়ে উচ্চবিত্ত ও অভিজাত মহিলারা সূর্যালোক এড়িয়ে চলতে চান তা হল সূর্যরশ্মি মেলানিন নামক পদার্থটি উৎপাদনে ভীষণ ভাবে সহায়ক। অর্থাৎ বেশি রোদে ঘুরলে চামড়ায় বেশি মেলানিন জমা হওয়ার কারণে চামড়া বেশি বাদামী হয়ে যেতে পারে।
মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত মেলানোসাইট স্টিমুলেটিং হরমোন লিভারকে উত্তেজিত করে এই বাদামী পদার্থটিকে উৎপন্ন করে। এটি যার যত বেশি উৎপাদিত ও চামড়ায় বিন্যস্ত হবে তার রঙ তত বেশি বাদামী হওয়ার দিকে যাবে।
এইজন্যে আমাদের শরীরের ঢাকা অংশগুলি অন্যান্য অনাবৃত অংশের তুলনায় বেশি ফর্সা বলে মনে হয়। উপকুল অঞ্চলে বিশেষ ভাবে সমুদ্রের কাছাকাছি মানুষ যাদের শরীরে বেশি আর সরাসরি সূর্যালোক পড়ার সম্ভাবনা তাঁদের রঙ ময়লা, তামাটে বা কালো হতে পারে। আবার ঠিক একই কারণে পার্বত্য মানুষের রঙ কিন্তু উজ্জ্বল আর সাদা।
খুব ভোরে সূর্যরশ্মিতে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি বেশি পরিমাণে থাকে। যাদের ভোরে ওঠা অভ্যাস তারা এই সুবিধে কিছু বেশি পেতে পারে। তাছাড়া ভোরের বাতাসে ওজনের অর্থাৎ ওজন গ্যাসের পরিমাণ বেশি থাকে।
একটি ওজনের অণুতে তিনটি অক্সিজেনের পরমাণু থাকে বা দুইটি ওজনের অণুতে তিনটি অক্সিজেনের অণু থাকে। যাদের শ্বাসযন্ত্র, হৃৎপিন্ড ইত্যাদির সমস্যায় ভুগছেন তাদের ভোরে উঠলে শরীরের পক্ষে সুবিধাজনক। কারণ তাঁরা এই অতিরিক্ত অক্সিজেন পেতে পারেন। কিন্তু বেলায় সূর্যের প্রখর তাপে ওজন ভেঙ্গে অক্সিজেনে পরিণত হয়ে যায়।
৩) অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বর্জনঃ
আমাদের অনেকেরই স্বভাব আছে অকারণে অথবা সামান্য কারণে অতিরিক্ত ওষুধ সেবন অথবা ভুল ওষুধ সেবন। অকারণে ওষুধ সেবন করলে বা ভুল ওষুধ গ্রহণ করলে সেটিকে শরীর পরিত্যাগের বিষয়ে প্রচেষ্ট হয়।
শরীর কোনও বাইরের অপ্রয়োজনীয় জিনিসকেই নিজের অভ্যন্তরে রাখতে নারাজ। এমন কি একটা কাঁটা ফুটলেও সেখানে পুঁজ হয়ে শরীর তাকে বার করে দিতে চায়। অতিরিক্ত আর অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ক্ষেত্রেও তাই। শরীর এগুলিকে রাখতে চায় না। নাহলে এই রাসায়নিকগুলি শরীরের কোষগুলিকে বিভিন্ন ভাবে বিপন্ন করতে পারে। অর্থাৎ এটিও এক রকম ইনফেকশন।
তবে ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া নাহলেও শরীর-নারাজ পদার্থের তো বটেই। তাই এগুলি শরীর থেকে বার করে দেবার জন্যে যে শারীর বৃত্তীয় কার্যকলাপ অনুসরণ করতে হয় তাতে স্বাভাবিক ভাবেই অকারণ শারীরিক শক্তি ব্যায়িত হয়। এবং তা প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্তত সাময়িক ভাবে কমাতেও সাহায্য করে।
সেইজন্যে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন অপকারী। একটি ওষুধের ডোজ কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়েই নির্ধারিত হয়। ওষুধ কোম্পানীগুলি নিজেদের খেয়াল খুশি মত কিন্তু ডোজ নির্ধারণ করতে পারে না।
৪) গ্রীন-টি পানঃ
গ্রীন-টি বা সবুজ চা এক বিশেষ ধরণের চা যার উপাদানের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট বিদ্যমান। স্নেহ জাতীয় পদার্থ অর্থাৎ ফ্যাট, শর্করা জাতীয় পদার্থ অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেট কিছুই নেই এই পানীয়ে। রয়েছে খুব সামান্য পরিমাণ প্রোটিন (দশমিক দুই শতাংশ)। আর আছে বেশ কিছু ভিটামিন জাতীয় পদার্থ। যেমন থায়ামিন (ভিটামিন বি-১), রাইবোফ্লেভিন (ভিটামিন বি-২), নিয়াসিন (ভিটামিন-বি-৩), ভিটামিন বি-৬ এবং ভিটামিন সি।
ভিটামিন জাতীয় পদার্থগুলি আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলির দ্রুত হজমে সাহায্য করে আর তাই তা ইমিউনিটিতে সহায়ক হয়। আমরা জানি ভিটামিন সি-এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতার কথা। আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি শাস্ত্রে আমলার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
খনিজ পদার্থ হিসেবে ক্যালসিয়াম কিছু না থাকলেও সামান্য পরিমাণ আয়রন, আর ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি দেহে খনিজ পদার্থের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হয়। আছে প্রচুর পরিমাণ সোডিয়াম (১০০ গ্রামে ১ মিলিগ্রাম), পটাশিয়াম (১০০ গ্রামে ৮ মিলিগ্রাম), ম্যাগনেশিয়াম (১০০ গ্রামে ১ মিলিগ্রাম)। সোডিয়াম ও পটাশিয়াম পদার্থগুলি শরীরের তরল যেমন রক্ত, রস, স্পাইনাল ফ্লুইড ইত্যাদির সাম্য নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এবং সেই কারণে রক্তের জমাট বাঁধা আটকায়। তাই হার্টের পক্ষেও এটি উপকারী।
সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের যৌগগুলি তীব্র ইলেক্ট্রোলাইট হওয়ায় এবং আমাদের স্নায়ুমন্ডলী মৃদু তড়িৎ প্রবাহ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কারণে স্নায়ুতন্ত্র জনিত দুর্বলতা অর্থাৎ পেশীর টান ইত্যাদি প্রতিরোধে সক্ষম। এ ছাড়াও যে জিনিসটি প্রচুর পরিমাণে থাকে তা হল ক্যাফিন। এই পদার্থটি স্নায়ুমন্ডলীর দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে। কফির মধ্যে ক্যাফিন থাকে প্রচুর পরিমাণে আর সেই জন্যে সে স্নায়ুমন্ডলীকে উত্তেজিত করে ঘুম হ্রাস করে। কিন্তু গ্রীন টি তা নয়। সে স্নায়ুকে মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত করে না। কিন্তু স্নায়ুর দুর্বলতা রোধে সক্ষম।
সারার্থ হল এটা মস্তিষ্কের কাজে সহায়তা করে, হার্ট ডিজিজের বিপদ থেকে রক্ষা করে আর শরীরে অপ্রয়োজনীয় ফ্যাটের হ্রাসে সহায়তা করে।
৫) পান বা ধূমপান বর্জন করা বা কমানঃ
পানঃ পান অর্থাৎ অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ গ্রহণ। এই পদার্থটি শরীরে খুব দ্রুত ও সহজে চলে যায়। আমরা যে খাবার খাই তা কিন্তু সহজে হজম হয় না। পাচনের বিভিন্ন ধাপ অগ্রসর হয়ে তবে পাচন হয় আর সব শেষে আমাদের কোষে প্রবেশ করে মেটাবলিজমের মাধ্যমে কোষ ও শরীরে শক্তি উৎপাদন করে।
অ্যালকোহল খুব সহজে হজম হওয়ার কারণে পাচক রসগুলি নিঃসৃত হয় কিন্তু অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে আর তাদের এই অকারণ উৎপাদন নানা রকম কুকর্ম ঘটায়। এজন্যে পাকস্থলী, যকৃৎ, প্যাংক্রিয়াস, ইনটেস্টিন দুর্বল হয়ে যায়। স্টম্যাক থেকে অতিরিক্ত এসিড নিঃসরণ আনে অতিরিক্ত অম্লত্ব।
পিত্তরসের আধিক্য হেতু জন্ডিস, হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস ইত্যাদি বিভিন্ন ভোগান্তি থাকে। অর্থাৎ যারা পানাসক্ত তাদের হজম যন্ত্র দুর্বল থাকে আর হজমের ঘাটতি অবশ্যই ইমিউনিটি হ্রাসের সহায়ক। কারণ তা পুষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায়।
ধূমপানঃ শরীরে এই জিনিসটির বিষময় প্রতিক্রিয়ার ফল আজ সারা জগৎ জ্ঞাত। তামাকের মধ্যে আসল যে রাসায়নিকটি রয়েছে তা হল নিকোটিন। এই রাসায়নিকের উপস্থিতির ফলে তা স্নায়ুমন্ডলীকে উত্তেজিত করে আর ঘুম কমায়। ফলে হজমের ব্যাঘাত ঘটায়। এটি হল দীর্ঘ ধূমপান করার ফল।
স্নায়ুমন্ডলী ক্রমাগত উত্তেজিত হতে থাকায় এগুলি তার সহনশীলতার মাত্রায় পৌছে যায়। যেমন একটি রবারের গার্ডারকে বারবার প্রসারিত ও সংকুচিত করতে থাকলে সেটি আর নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পারে না তেমনি হয়। ধূমপান মূলত করা হয় মুখ দিয়ে।
গলা ও শ্বাসনালী দিয়ে নিকোটিন সমৃদ্ধ সেই ধোঁয়া ফুসফুসে বারবার যাওয়ায় ফলে শ্বাসনালীর স্বাভাবিক সংকোচন ও প্রসারণ হবার কাজ ব্যাহত হয়। ফুসফুস আক্রান্ত হয়। দীর্ঘ উত্তেজনার ফলে সংশ্লিষ্ট কোষগুলি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। নানা রোগ যেমন দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসনালি ও যন্ত্রগুলির রুদ্ধতা জনিত সংকটজনক ব্যাধি অর্থাৎ chronic obstructive pulmonary disease(COPD), শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
যেহেতু শ্বাসকার্যে অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করে তাই কোষগুলিতে অক্সিজেনের স্বাভাবিক সরবরাহ কমে যাওয়ায় রক্ত প্রবাহ ঠিক রাখার জন্যে হার্টকে বেশি কাজ করতে হয় তাই হার্ট দুর্বল হয়। যে পদার্থ শরীরে নানা রোগ আনে সেগুলি অবশ্যই প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেবে এটা সহজেই অনুমেয়। তাই পান ও ধূমপান পরিত্যাগ করাই ভাল। অন্তত কমান তো অবশ্যই প্রয়োজন।
৬) কৃত্রিম রঙ বা গন্ধযুক্ত খাদ্য বর্জনঃ
এই ধরণের খাদ্যে খুব উগ্র রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। ফলে তা স্বাভাবিক পাচন ক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটায়। শুধু তাই নয় এই সমস্ত রাসায়নিকগুলি শরীরে বিষময় ফল উৎপাদন করে নানা গুরুত্বপূর্ণ রোগ যেমন অ্যালার্জি, কিডনির অসুখ, জিভ ও মুখগহ্বরের অসুখ।
এই পদার্থগুলি শরীরের কোনও কাজে তো লাগেই না বরং পুষ্টি নাশ করে। কোনও দেশের সৈন্যবাহিনীকে যেমন সঠিক মাত্রায় পুষ্ট করলে তারা দেশকে রক্ষা করতে পারে তেমনি কোষগুলি সঠিক ভাবে পুষ্ট থাকলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বজায় থাকে। অন্যদিকে পুষ্টি হ্রাস ইমিউনিটি কমিয়ে দিতে পারে।
৭) সুস্বাস্থ্য সচেতনাঃ
এ বিষয়টি নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই কারণ এটি প্রত্যেকটি মানুষের উপলব্ধির ব্যাপার। সুস্বাস্থ্য সচেতনতা না থাকলে আর সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে কি করে? তাই ইমিউনিটিকে ধরে রাখতে গেলে এই চেতনা আবশ্যিক।
৮) যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমঃ
ঘুমের সময় মানুষ চিন্তামুক্ত থাকে আর মস্তিষ্ক জরুরি কাজ ছাড়া আর কিছু করে না। অর্থাৎ প্রায় পরিপূর্ণ বিশ্রাম। তাই শরীরের পুষ্টি বৃদ্ধি হয় আর ইমিউনিটি রক্ষিত বা পুনরায় অর্জিত হয় (restoration)। তবে অসময়ে বা অকারণে অথবা দীর্ঘ ক্লান্তিজনিত ঘুম কিন্তু শারীরিক দুর্বলতা ও এক বা একাধিক রোগের উপস্থিতির কারণেও হতে পারে। কিন্তু ইমিউনিটিকে বজায় রাখতে যথেষ্ট ঘুম দরকার।
৯) প্রাণ খুলে হাসাঃ
মানুষ তখনই হাসে যখন তার শরীর ও মন চিন্তামুক্ত থাকে। মনের পরিচ্ছন্নতা আর শরীরের রোগহীনতার লক্ষণ হল একটি হাস্যোজ্জ্বল মুখ। রোগজীর্ণ মানুষ হাসলেও প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। হাসিতে মানুষের মনে গভীর চিন্তা রেখাপাত করতে পারে না। সশব্দ হাসিতে শরীরে অতিরিক্ত অক্সিজেন প্রবেশ করে কোষগুলিকে পুষ্ট করে। মনই তো শরীরকে চালায়। তাই মন চিন্তামুক্ত থাকলে শরীর ভাল থাকে আর প্রতিরোধ ক্ষমতারও উন্নতি হতে পারে।
১০) টাটকা সবুজ শাকসব্জি গ্রহণঃ
এটাতেও বিশেষ বলার কিছু নেই। টাটকা শাকসব্জি ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ হয়। জলের পরিমাণও এতে অধিক পরিমাণে থাকে। ফল ও সবজি যত বাসি হয় অর্থাৎ শুকোতে থাকে ততই তার মধ্যে জলের পরিমাণ যেমন কমে তেমনি ভিটামিনগুলিও ভেঙ্গে যায়। শুধু তাই নয় অধিক কাল থাকার কারণে বাতাসের ধুলো ময়লা বা ক্ষতিকারক পদার্থ, রোগ জীবাণু ইত্যাদি তার ওপর জমতে থাকে। সেগুলি টাটকা জিনিসের মত পুষ্টি যেমন দিতে পারে না বরং নানা রোগ সৃষ্টি করতে পারে। আর রোগ এবং রোগ প্রতিরোধ কিন্তু একে অন্যের বিপরীত। একটি বাড়লে অন্যটি কমতে বাধ্য।
আমরা সবাই বিজ্ঞানী নই। আমরা সবাই চিকিৎসক নই। কিন্তু রোগ হলে চিকিৎসকের কাছে যাব আর সারিয়ে নেব এই সরলীকরণের মধ্যে দিয়ে শরীর কিন্তু চলে না। শরীর অত্যন্ত জটিল এক জিনিস। শরীরের স্বাভাবিক কার্যপ্রণালী কিন্তু শরীরকে রক্ষা করার পক্ষে যথেষ্ট।
তবে আমাদের দেখতে হবে আমাদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কোনওভাবে সেই কার্যপ্রণালী বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা। আমাদের কাজ হল শরীর যাতে তার স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মগুলি বজায় রাখতে পারছে তা দেখা। সেই জন্যেই এত স্বাস্থ্যসচেতন হওয়া আর সুস্বাস্থ্যের নিয়ম পালন করা।
ইমিউনিটির ব্যাপারে ওপরের বিষয়গুলি কেউ কিন্তু একক ভাবে দায়ী নয়। এরা দায়ী সংঘবদ্ধ ভাবে। অর্থাৎ যে কোনও একটি বিষয় পালন করলেই যে আপনার ইমিউনিটি বজায় থাকবে তা কিন্তু নয়। সমস্ত বিষয়গুলি যতটা সম্ভব দেখা দরকার পালন করা যায় কিনা।
তবে জানবেন সচেতনতা যেমন ভাল তেমনি খারাপ হল ভীতি। রোগের ভীতি শরীরকে দুর্বল করে। কোষগুলিও দুর্বল হয়। আর এই অকারণ ভীতি ইমিউনিটিকে কমিয়ে দিতে পারে। তাই আমরা স্বাস্থ্যের বিষয়ে এত কিছু জানার চেষ্টা করি। কারণ অজ্ঞানতা ভীতি বাড়ায় আর প্রতিরোধ কমায়। রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা আর রোগ প্রবণতা কিন্তু ব্যাস্তানুপাতিক অর্থাৎ একটি কমলে আর একটি বেড়ে যায়।
তাই কিছু না জেনে অযথা ভীত হয়ে নিজের ইমিউনিটিকে কমিয়ে না দিয়ে কিছু জেনে নিয়ে সেইমত চলার চেষ্টা করে নিজের ইমিউনিটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাই সঠিক কাজ।
ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়: বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনের (গল্প ও উপন্যাস) লেখক ও গ্রন্থকার।