অধিক তাপমাত্রায় প্লাস্টিকের পানীয় জলের পাইপ থেকেও নির্গত হতে পারে ক্ষতিকর রাসায়নিক
ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল এর পরে জলাশয়ে বেঞ্জিনের আধিক্য: গবেষণাগারে পরীক্ষাই দিতে পারে তার ব্যাখ্যা
২০২০ সালের আগস্ট মাসে ক্যালিফোর্নিয়ায় স্যান্টাক্রুজের উত্তরে সান লোরেঞ্জো উপত্যকায় এক বিরাট দাবানল দেখা দেয়। প্রায় দেড় হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস প্রাপ্ত হয় আর বহু ঘর-বাড়ি দাবানলের মারাত্মক তাপের সংস্পর্শে আসে। আগুন নেভার আগে গবেষণাগারে পরীক্ষায় জানা যায় যে, স্থানীয় জলাশয়গুলোতে বেঞ্জিনের মাত্রা অত্যন্ত বেশি প্রায় ৯.১ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) যা কিনা ওই রাজ্যের সর্বোচ্চ নিরাপদ সীমার থেকেও প্রায় ৯ গুণ বেশি। ঐ অঞ্চলের পানীয় জলে পাওয়া একটি কারসিনোজেন (ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী উপাদান) বেঞ্জিনের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় প্রায় ৮০ গুণ বেশি।
দূষণের এক আশ্চর্য উৎস
কারসিনোজেন-সৃষ্টিকারী এই দাবানল প্রথমবার নয়, আগেও ঘটেছে আর প্রতিবার দাবানলের পরে পানীয় জলে দূষণের অতিরিক্ত মাত্রাবৃদ্ধি আমেরিকার প্রশাসন মহলকে বিস্মিত করেছে। ২০১৭ সালেই প্রথম এটি সকলের চোখে পড়ে।
টাব্স ও ক্যাম্প ফায়ার দাবানল
২০১৭ সালে আমেরিকার সান্টা রোজায় ‘টাব্স দাবানল’ এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে প্যারাডাইসে ‘ক্যাম্প ফায়ার’-এর ফলে ক্যালিফোর্নিয়ার জল ব্যবস্থাপকেরা পানীয় জলে উচ্চমাত্রায় বেঞ্জিন এবং অন্যান্য উদ্বায়ী জৈব যৌগগুলির উপস্থিতি লক্ষ্য করন।
ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থের সমান এই সমস্ত রাসায়নিকগুলি এই সব এলাকার ভূগর্ভস্ত জলবন্টন ব্যবস্থাতেও খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে শুধুমাত্র জল শোধনাগার কিংবা পানীয় জলের উৎসতেই নয়, পানীয় জলের দূষণ দেখা গেছে জল সরবরাহকারী বাড়ির প্লাস্টিকের নলগুলিতেও।
বিজ্ঞানীরা প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন যে অধিক তাপমাত্রার সংস্পর্শে এসে প্লাস্টিকের পানীয় জলের পাইপ থেকেই এই রাসায়নিকগুলি নির্গত হচ্ছে। এখন গবেষণাগারের পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেল যে এই সম্ভাবনা সত্য হতে পারে।
জলে রাসায়নিক
জলে রাসায়নিক দূষণের উপর গবেষণাগারের পরীক্ষার ফলাফল
ইন্ডিয়ানার পশ্চিম ল্যাফায়েতে পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ প্রকৌশলী অ্যান্ড্রু হোয়েলটন এবং তাঁর সহকর্মীরা নিরীক্ষণ করে দেখেছেন যে ২০০ ডিগ্রি থেকে ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় সাধারণমানের বাজারচলতি জলের পাইপগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় না। হোয়েলটনের মতে এই পরিমাণ তাপমাত্রা তৈরি হতে পারে আশেপাশে লাগা আগুনের শিখার বিকিরণ থেকে।
গবেষকরা যখন সেই উত্তপ্ত পাইপগুলিকে জলে ডুবিয়ে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেন, প্রায় ১০-১১ রকমের পাইপ থেকে জলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ বেঞ্জিন, উদ্বায়ী জৈব যৌগ এবং আরো শতাধিক রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হতে দেখেন। ১৪ ডিসেম্বর ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স : ওয়াটার রিসার্চ অ্যাণ্ড টেকনোলজি’ জার্নালে এই পরীক্ষার ফলাফল সেই গবেষক দল প্রকাশ করেন।
২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত এই ফলাফল প্রমাণ করে যে কত সহজেই দাবানলের কারণে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পানীয় জলের দূষণ ঘটতে পারে। তাঁরা এও বলেন যে কোনো বাড়ির একাংশ যখন অগ্নিদগ্ধ হয় তাহলেও বাড়িটির অন্যান্য অবিকৃত অংশে পানীয় জলের উপর এইরকম মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
হোয়েলটন জানাচ্ছেন, ‘আগে এমনই কিছু ক্ষেত্রে দাবানলের কারণে তাপে বিনষ্ট প্লাস্টিকের সংস্পর্শে এসেই জলদূষণ ঘটেছিল ’। তিনি বলেন, জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে থেকে দূষণের প্রকৃত উৎস সন্ধান করা একেবারেই অসম্ভব, তার বদলে দাবানলে পুড়ে যাওপাইপগুলি পরীক্ষা করে অনুমান করা যেতে পারে কত উচ্চ তাপমাত্রা সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হল কেন এই ঘটনা ঘটে? প্লাস্টিকের পাইপগুলিতে এমন কী থাকে যা উচ্চ তাপে বেঞ্জিন তৈরি করে? সবরকম প্লাস্টিকই কি বেঞ্জিন তৈরি করে?
পানীয় জলের ব্যবস্থায় প্লাস্টিকের পাইপই সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। ধাতব পাইপের তুলনায় এই পাইপগুলি অনেক কম খরচে বাড়িতে ব্যবহার করা যায় যা কিনা উচ্চতাপ সহনক্ষম কিন্তু ক্ষয় সংবেদী।
আজকাল রাস্তার নিচ দিয়ে বিস্তৃত জলের পাইপগুলি যে ক্রেতাদের জলের মিটারে জল পৌঁছে দিচ্ছে তাতে প্লাস্টিক ব্যবহার ক্রমশ বেড়ে চলেছে । ঐ জলের মিটার থেকে যে পাইপের মধ্য দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে জল পৌঁছায় তাও প্লাস্টিকের। জলের মিটারগুলিতেও অনেকসময় প্লাস্টিক থাকে। বাড়িতে নিজস্ব কুয়োতেও প্লাস্টিকের বেড় ব্যবহৃত হচ্ছে, এমনকি কুয়ো থেকে আভ্যন্তরীণ প্লাস্টিকের পাইপেই রিজার্ভার ট্যাঙ্কে জল যাচ্ছে।
বাড়ির ভিতরকার ঠাণ্ডা-গরম জলের কল, কলের সংযোজক পাইপ, জল গরম করার হিটারের মধ্যেকার পাইপ, এমনকি ফ্রিজ আর বরফ তৈরির পাইপ সবই প্লাস্টিকের তৈরি হতে পারে।
দাবানলের প্রভাবে প্লাস্টিক পাইপগুলিই পানীয় জল দূষণের কারণ হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য পরীক্ষকেরা সাধারণ মানের বাজারচলতি প্লাস্টিক পাইপকে তাপের সংস্পর্শে রাখেন। দাবানলের যতটা বিকিরিত তাপ আশেপাশের বাড়িতে পৌঁছায়, এখানেও সেই একই তাপমাত্রা তৈরি করা হলেও, পাইপে আগুন ধরানোর জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।
বহু প্রচলিত প্লাস্টিকের পানীয় জলের পাইপ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। এদের মধ্যে উচ্চঘনত্বের পলিথিলিন (HDPE), ক্রসলিঙ্কড পলিথিলিন (PEX), পলিভিনাইল ক্লোরাইড (PVC) এবং ক্লোরিনেটেড পলিভিনাইলক্লোরাইড (CPVC) পাইপ-ও ছিল।
PVC – যতদিন অক্ষত থাকে, সমস্তপ্রকার প্লাস্টিকের থেকে বেশিমাত্রায় পরিবেশের ক্ষতি করে
এই PVC’র উৎপাদন, ব্যবহার এবং বর্জন – সব ক্ষেত্রেই বিষাক্ত ক্লোরিনযুক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়। এই বিষাক্ত রাসায়নিকগুলি জলে, বাতাসে এবং খাদ্যের মধ্যে জমতে থাকে যার ফলে ক্যান্সার, ক্ষতিগ্রস্ত অনাক্রম্যতা, হরমোন মাত্রার অসাম্যের মতো নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। দূষণ থেকে কেউই মুক্তি পায় না, যে যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের শরীরে বাসা বাঁধে সীমিত মাত্রার ক্লোরিনেটেড বিষ।
আগুনে পুড়ে যাওয়া PVC পাইপের মাত্রাগত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে তাতে 2-butoxyethanol, 2-ethyl-1-hexanol, এবং diethyl phthalate –এর উপস্থিতির গড় স্তর যথাক্রমে পাইপের উপাদানের ২.৭, ১৪.০, এবং ৩.১ মাইক্রোগ্রাম প্রতি গ্রামে (μg/g)। এই পরীক্ষা থেকেই বোঝা যায় যে ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের ফলে পুড়ে যাওয়া প্লাস্টিক পলিমার পাইপ থেকে বেঞ্জিন-দূষণ পানীয় জলে কেন ছড়িয়ে পড়ে।
পানীয় জলে কারসিনোজেনর মাত্রা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা
বেঞ্জিনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এলে ত্বক ও গলার প্রদাহ, ঝিমুনিভাবের মতো তাৎক্ষণিক কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে আর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব হিসেবে লিউকোমিয়া দেখা দিতে পারে।
গবেষক দল পরামর্শ দিয়েছেন যদি কারো এলাকায় কোনো বাড়িতে বা কারখানায় আগুন লাগে, ঘটনার পরে অবশ্যই সেখানকার পানীয় জলের পরীক্ষা করা উচিত এবং নিরাপত্তার নিরিখে বাড়ির প্লাস্টিকের পাইপগুলি বদলে তাপ-নিরোধক ধাতব পাইপ ব্যবহার করা উচিত।
দূষণ প্রতিরোধে কী করণীয়?
গবেষকরা বিবিধ পরীক্ষার মাধ্যমে আগেই আবিষ্কার করেছেন আগে যে উচ্চ তাপে প্লাস্টিক থেকে বেঞ্জিন এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে নির্গত হয়। নতুন একটি পরীক্ষায় তাঁরা দেখেছেন যে তাপে ক্ষতিগ্রস্ত প্লাস্টিক থেকেও জলের মধ্যে সরাসরি প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়।
জল দূষণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে যে কোনো মানবগোষ্ঠী নিচের পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করতে পারে :
ক্ষতিগ্রস্ত পাইপগুলিকে সত্ত্বর সরিয়ে ফেলা: পাইপগুলি সম্পূর্ণভাবে না সরিয়ে ফেললে ঐ অংশের দূষিত জল পাইপবাহিত হয়ে শহরের অন্যত্র বা বাড়ির অন্যত্র থাকা জলের ভাণ্ডারকেও দূষিত করবে।
তাপে ক্ষতিগ্রস্ত পাইপ পরিষ্কার করার পরিবর্তে বদলে ফেলা : পাইপ জলে ধুয়ে পরিষ্কার করলেই সবসময় জল দূষণমুক্ত হয় না। এমন কিছু প্লাস্টিকের পাইপ আছে যা ১০০ দিন ধরে জল প্রবাহের মাধ্যমে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করার পরেই নিরাপদে ব্যবহার করা যায়।
পৃথকীকরণ ভাল্ভ লাগানো : জল পরিষেবক সংস্থাগুলি এই প্রকারের পৃথকীকরণ ভাল্ভ (isolation valve) এবং পশ্চাদগমন নিরোধক যন্ত্র (backflow prevention devices) লাগাতে পারে যাতে দূষিত জল কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি থেকে ব্যবহারযোগ্য পাইপের ভিতর ঢুকে না পড়ে।
বাড়ির মালিকদের ধাতব পাইপ ব্যবহারে উৎসাহিত করা : বাড়ির বিমা সংস্থাগুলি এমন কিছু প্যাকেজ আনতে পারে যা বাড়ির মালিকদের প্লাস্টিকের পাইপের বদলে অগ্নি-নিরোধক ধাতব পাইপ ব্যবহারে উৎসাহিত করবে।
আমরা জলবায়ু ও মাটির দূষণ, এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক থেকে বিভিন্ন ধরণের রোগব্যাধি ও বহুসংখ্যক মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে থাকি যা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও প্রভাবিত করে চলেছে। কার্যকরী, উৎসাহব্যঞ্জক এবং আধুনিক আইন-প্রণয়নের মাধ্যমে রাসায়নিক এবং বর্জ্যপদার্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উপর জোর দেওয়া আজকের যুগে খুবই প্রয়োজনীয়।
সীমন রায়: জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখালেখি।