২০২১-এ ‘হুইটলি পুরস্কার’ পেলেন নাগাল্যাণ্ডের সংরক্ষণবাদী নুক্লু ফোম
‘হুইটলি পুরস্কার’ কী?
প্রতি বছর গ্লোবাল সাউথের ইউরোপ-ভিত্তিক দ্য হুইটলি ফাণ্ড ফর নেচার (WFN)-এর অর্থানুকুল্যে হুইটলি পুরস্কার দেওয়া হয় পরিবেশ সংরক্ষণের কোনো বিশেষ কৃতিত্বের জন্য। নাগাল্যাণ্ডের বিশিষ্ট সংরক্ষণবাদী ও পরিবেশবিদ নুক্লু ফোম (Nuklu Phom) পেলেন ‘হুইটলি পুরস্কার ২০২১’ (Whitley Awards) যাকে গ্রিন অস্কার (Green Oscar) বলা হয়ে থাকে। ১২ মে, ২০২১ মাভা ফাউণ্ডেশনের অর্থানুকুল্যে নাগাল্যাণ্ডে একটি ‘বাস্তুতান্ত্রিক শান্তিনীড়’ (Biodiversity Peace Corridor) গড়ে তোলার জন্যে এই পুরস্কারে সম্মানিত হলেন ফোম। যদিও তিনি একা নন, সারা বিশ্বে তাঁর পাশাপাশি আরো পাঁচজনের নাম ঘোষিত হয়েছে এই পুরস্কারের জন্য। নুকলু ফোম তাঁদের মধ্যে একমাত্র ভারতীয় ব্যক্তি। দীর্ঘ তিন বছর পর কোনো ভারতীয় এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হলেন। পুরস্কারমূল্য স্বরূপ নুকলু ফোমকে ৪০,০০০ পাউণ্ড দেওয়া হয় যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪ লক্ষ টাকা। এই টাকা তিনি তাঁর সংরক্ষণের প্রকল্পের উন্নতিকল্পে কাজে লাগাবেন বলে জানিয়েছেন ফোম।
আমুর ফ্যালকন -এর ‘বাস্তুতান্ত্রিক শান্তিনীড়’
প্রতি বছর নাগাল্যাণ্ডে আশ্রয় নিতে আসা হাজার হাজার আমুর ফ্যালকনকে স্থানীয় শিকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে কঠোর পরিশ্রমে একটি ‘বাস্তুতান্ত্রিক শান্তিনীড়’ গড়ে তুলেছেন নুকলু ফোম। এই আমুর ফ্যালকন হল বিশেষ এক প্রজাতির বাজপাখি যাদেরকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র নিয়ন্ত্রক হিসাবে মনে করা হয়। এর কারণ জমিতে উৎপাদিত শস্যে উই ধরা থেকে এরা রক্ষা করে।
নাগাল্যাণ্ডের একটি গ্রামে সম্প্রতি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এক বছরে প্রায় ১৪,০০০ পরিযায়ী ফ্যালকন মেরে ফেলেছে এখানকার স্থানীয় শিকারিরা। পরিবেশবিদ ফোম এবং তাঁর দল এই যথেচ্ছ পাখিশিকার রোধ করতে অগ্রণী হয়েছেন এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে এই পাখির সংরক্ষণে উৎসাহিত ও নিয়োজিত করেছেন। এই প্রকল্প শুরু হয় ২০০৭ সালে এবং বর্তমানে নাগাল্যাণ্ডে তিনটি বাস্তুতান্ত্রিক সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করেছেন ফোম। পরিযায়ী ফ্যালকনের আসার সংখ্যাও আশ্চর্যরকমভাবে বেড়ে গেছে। ২০১০ সালে প্রায় ৫০,০০০ আমুর ফ্যালকন এই রিসার্ভগুলিতে এসেছিল। আর ফোমের উদ্যোগে ২০১৯ সালে পাখির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ।
সাধারণত এই আমুর ফ্যালকনগুলি বহু দূর পথের পরিযায়ী পাখি। সাধারণত পূর্ব-মধ্য রাশিয়া এবং উত্তর চিনে এরা জন্মালেও পশ্চিম দিকে পরিযায়ী হয়। আরব সাগর পেরিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে এরা চলে যায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্রতি বছর এরা প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার পথ পরিভ্রমণ করে শুধুমাত্র জন্মস্থান থেকে শীতকালীন স্থান পর্যন্ত। অক্টোবর মাস নাগাদ দক্ষিণ আফ্রিকা, সোমালিয়া, কেনিয়ায় যাওয়ার জন্য নাগাল্যাণ্ডের পাঙ্গতিতে এসে আশ্রয় নেয় এবং তখনই শিকারিদের কবলে পড়ে এই ফ্যালকনগুলি। ১৯৭২ সালের ভারতীয় বন্যপ্রাণী সুরক্ষাবিধি দ্বারা আমুর ফ্যালকনের সুরক্ষা আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। তবু যথেচ্ছাচারে ফ্যালকন হত্যা চিন্তার ভাঁজ ফেলে মুখ্য পরিবেশবিদ, সংরক্ষণবাদীদের কপালে।
এক সাক্ষাৎকারে নুকলু ফোম জানাচ্ছেন, ‘পূর্ব নাগাল্যাণ্ডের এক ছোট্ট গ্রামে আমি জন্মেছি। আমাদের এলাকার মানুষজন বেঁচে থাকার জন্য জঙ্গলের উপর একান্তই নির্ভরশীল আর তাই প্রকৃতির সঙ্গে সমান তালে তারা বড়ো হয়ে ওঠে। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার ঠাকুরদাদা বলেছিলেন মানুষের এত অত্যাচারে প্রকৃতি বিনষ্ট হচ্ছে। আর এটা যদি চলতে থাকে পরবর্তী প্রজন্মের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সমস্যার হয়ে দাঁড়াবে। এখন বুঝি তিনি ঠিকই বলতেন।’
Video Source: Whitley Awards
নাগাল্যাণ্ডের উপমুখ্যমন্ত্রী ইয়ানথুঙ্গো পাট্টন টুইটের মাধ্যমে নুকলু ফোমকে অভিবাদন জানিয়েছেন। এমনকী নাগাল্যান্ডের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী এস. পাঙ্গনু ফোম নুকলু ফোমের হুইটলি পুরস্কার প্রাপ্তিতে তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছেন। একটি টুইটের মাধ্যমে তিনি বাস্তুতান্ত্রিক শান্তিনীড় গড়ে তোলার পিছনে ফোমের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। ফোম জানান তিনি আসলে চেয়েছিলেন বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়, নীতি নির্ধারক আর বিজ্ঞানীদের একত্রিত করে প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজ করতে। আর সেই থেকেই বাস্তুতান্ত্রিক শান্তিনীড় তৈরির প্রয়াস শুরু। বর্তমানে ফোম চান আরো ৪টি জেলার ১৬টি গ্রামকে একত্রিত করে একটি সম্প্রদায়গত সংযোগসূত্র স্থাপন করবেন এবং সেই গ্রামগুলিকে পাখি সংরক্ষণের কাজে লাগাতে ঐ বাস্তুতান্ত্রিক শান্তিনীড়ের অন্তর্ভুক্ত করবেন। এছাড়াও তাঁর আরো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে।
ফোম আর তার দল ঠিক করেছেন ঐ সমস্ত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের জীবন-যাপন একত্রে গড়ে উঠবে। এর ফলে তাঁরা মনে করেন ভারতের কিছু অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়কে একত্রিত করা যেতে পারে। নুকলু এবং তাঁর দল এর পাশাপাশি আদিবাসী জনজাতিদের শিক্ষাদান নিয়েও ভাবছেন এবং তাঁরা এমন পরিকাঠামো সেখানে তৈরি করতে চান যেখানে বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষেরা তাঁদের উত্তর প্রজন্মকে ঐতিহ্যবাহী সংস্কার, প্রাচীন বিশ্বাস, প্রাচীন জ্ঞান ও মূল্যবোধের পাঠ দেবেন। এর ফলে বাস্তুতান্ত্রিক শান্তি নীড় আরো ২০০ বর্গকিমি এলাকায় বিস্তৃত হবে। অরণ্যে অযাচিত শিকার, মাছ ধরা, ঝুম চাষ ইত্যাদি বন্ধ করে তাঁরা চান পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতিতে অরণ্য সংরক্ষণ করতে। ফোম গ্রামবাসীদের শেখাতে চান কীভাবে আদা চাষ, ফল চাষ এবং শূকর খামার গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দীর্ঘস্থায়ীভাবে মাটিক্ষয় রোধ করা যায় এবং মাটিকে ব্যবহারও করা যায় পরিবেশ-বান্ধব প্রক্রিয়ায়।
এক দশক আগে নুকলু ফোম যখন প্রথম এই সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন, তখন একটি দল তৈরি করেছিলেন তিনি যার নাম দেন ‘লেমসাচেনলক’। এটি আসলে একটি সম্প্রদায়-উন্নয়ন সমিতির মতো ছিল। সাধারণত নাগাল্যাণ্ডের মানুষরা পাহাড়ের ধাপ কেটে সেখানে গাছ কেটে ও পুড়িয়ে ঝুম চাষ করে থাকেন। এই কারণে জীবকুল ও উদ্ভিদ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ফোম ও তাঁর দলের কঠোর প্রচেষ্টায় সেই জায়গায় যে সংরক্ষিত এলাকা গড়ে উঠেছে তার ফলে পরিযায়ী আমুর ফ্যালকনের সংখ্যা আগের থেকে বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে।
উপসংহার
২০১৫ সালে ‘লেমসাচেনলক’ দল ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামে আমুর ফ্যালকন সংরক্ষণের জন্য প্রভূত কৃতিত্বের স্বীকৃতি পায়। পরে ২০১৮ সালে ইণ্ডিয়া বায়োডাইভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে ফোমের দল এবং সর্বোপরি ২০২১ সালে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে একটি স্বর্ণপদক লাভ করে। আমুর ফ্যালকনের সংরক্ষণের কাজে নুকলু ফোম এভাবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
সায়ন্তনী ব্যানার্জী: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি। বিজ্ঞাপন ও ডিজিটাল মার্কেটিং পেশায় যুক্ত। কন্টেন্ট রাইটার ও গ্রাফিক ডিজাইনার। পরিবেশ নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।