Engineering & Technology-প্রজুক্তি ও প্রকৌশল

অক্সিজেন সেন্সর

অক্সিজেন সেন্সর অর্থাৎ অক্সিজেন সংবেদী যন্ত্র। গাড়িতে থাকে, আমরা জানি। কিন্তু শুধু গাড়িতেই নয়, বহু জায়গায় থাকে অক্সিজেন সেন্সর আছে। এমনকী আমাদের শরীরেও। গাড়ির অক্সিজেন সেন্সর দিয়ে শুরু করা যাক।

গাড়িতে অক্সিজেন সেন্সর কী করে? অক্সিজেনের পরিমাণ জানান দেয়। কোনো তরল দ্রবণে বা গ্যাসের মিশ্রণে অক্সিজেনের উপস্থিতি মাপতে পারে এই যন্ত্রটি।

কী ধরনের যন্ত্র অক্সিজেন সেন্সর? বিদ্যুৎ চালিত, দেখতে ছোটখাট এক যন্ত্র। তৈরি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। চীনামাটির উপর জারকোনিয়া এবং প্ল্যাটিনামের আবরণ (প্লেট) বসিয়ে তৈরি হয়েছিল জিনিষটি। আবিষ্কর্তা জার্মান বিজ্ঞানী গুন্টার বম্যান (Dr. Gunter Bauman) ছিলেন রবার্ট বশ জিএমবিএইচ কোম্পানির (Robert Bosch GmbH company) বিজ্ঞানী।

বম্যানের আবিষ্কার পরবর্তীকালে আরও উন্নত রূপ পেল। তৈরি হল অত্যাধুনিক অক্সিজেন সেন্সর। প্রতিযোগিতার বাজারে আমেরিকার এনটিকে (NTK) কোম্পানি ১৯৯০ সালে তৈরি করে ফেলল আরও উঁচু মানের অক্সিজেন সেন্সর। হণ্ডা সিভিক এবং অ্যাকর্ড গাড়িতে ব্যবহার হতে লাগল এই সেন্সরগুলো।

একটি অক্সিজেন সেন্সর যন্ত্র . Image source: Google
নতুন এক ধরনের সিরামিক টেপ [Cofired Ceramic (HTCC) green tape] আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তারা গাড়ির জগতে বড় একটা পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলল।

গাড়ির ইঞ্জিনে কোন ত্রুটি দেখা দিলে অক্সিজেন সেন্সর জানান দেয়। অক্সিজেন স্বল্পতাও জানিয়ে দেয়। গাড়ি থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হলে জানতে পারা যায় অক্সিজেন সেন্সরের ক্রিয়ায়।

কী ভাবে কাজ করে অক্সিজেন সেন্সর? গাড়িতে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয় পেট্রল বা গ্যাসোলিন। দুটো জ্বালানিই রাসায়নিক বিচারে একই জিনিস। জ্বালানি দহনের জন্য দরকার হয় অক্সিজেন। বাতাসও বলা যায়। তবে নির্দিষ্ট করে বললে অক্সিজেন।

বায়ুমণ্ডলের বাতাসে অক্সিজেন থাকে কুড়ি শতাংশ। ইঞ্জিনে অক্সিজেনের উপস্থিতি এবং পরিমাণ নির্ভর করে অনেকগুলো শর্তের উপর। তাপমাত্রা, জায়গার উচ্চতা, বাতাসের চাপ (Barometric pressure) ইত্যাদি। ইঞ্জিনে জ্বালানি (পেট্রোলিয়াম বা গ্যাসোলিন) এবং অক্সিজেনের একটা নির্দিষ্ট অনুপাত থাকা দরকার।

অতিরক্ত অক্সিজেন এবং কম পরিমাণ জ্বালানি কিংবা কম জ্বালানির সঙ্গে বেশি মাত্রার অক্সিজেন কোনটাই বাঞ্ছনীয় নয়। গাড়ির ইঞ্জিনে জ্বালানী ও অক্সিজেনের সঠিক মাত্রা বজায় থাকা উচিৎ। অক্সিজেন এবং জ্বালানির আদর্শ অনুপাত, ১৪.৭ : ১। অর্থাৎ ১৪.৭ মিলিলিটার অক্সিজেনে ১ মিলিলিটার জ্বালানি থাকতে হবে। এর তারতম্য ঘটলেই বিপদ।

যেমন অক্সিজেন কম থাকলে সম্পূর্ণ জ্বালানি ব্যবহার হবে না। কিছু পরিমাণ জ্বালানি উদ্বৃত্ত থাকবে। এ রকম মিশ্রণকে বলা হয় রিচ মিক্সচার। আর উল্টো রকম হলে?

যখন অক্সিজেন বেশি, জ্বালানি কম? সে রকম মিশ্রণের নাম লিন মিক্সচার। রিচ মিক্সচার কিংবা লিন মিক্সচার, গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে কোনটাই কাম্য নয়। এই ধরনের মিশ্রণ গাড়ির ইঞ্জিনের পক্ষে ক্ষতিকর এবং পরিবেশের পক্ষেও। যেমন রিচ মিশ্রনের ক্ষেত্রে তরল জ্বালানির পরিমাণ বেশি, অক্সিজেন কম।

এই ক্ষেত্রে জ্বালানির সম্পূর্ণ অংশের দহন হয় না। তাই পরিবেশে অতিরিক্ত জ্বালানি মুক্ত হয়ে বায়ু দূষণ ঘটায়। আর লিন মিশ্রনের ক্ষেত্রে তরল জ্বালানির পরিমাণ কম, অক্সিজেন বেশি। সে ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দহনের ফলে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর পরিবেশে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড মুক্ত হয়ে বড় রকম দূষণ ঘটায়।

গাড়িতে কোথায় লাগানো থাকে অক্সিজেন সেন্সর? গ্যাস নির্গমনের জায়গায় (Exhaust) লাগানো থাকে। সেখানে পেট্রল দহনের কারণে নির্গত হয় অনেক রকম গ্যাস। সেই গ্যাসগুলির মধ্যে অক্সিজেন কতটা আছে জানিয়ে দেয় অক্সিজেন সেন্সর। অক্সিজেন সেন্সর যন্ত্রটি চিহ্নিত (Detect) করতে পারে গ্যাস মিশ্রনের চরিত্র।

নির্গত গ্যাসটি লিন মিক্সচার না রিচ মিক্সচার। উন্নত মডেলের গাড়িগুলোতে একটি নয়, অনেকগুলো সেন্সর লাগানো থাকে। আধুনিক মডেলের গাড়িতে, ইঞ্জিনের ক্ষমতা অনুযায়ী চারটি অবধি অক্সিজেন সেন্সর লাগানো থাকে।

দুটো ইলেকট্রোডের সাহায্যে অক্সিজেন সেন্সর তৈরি করে ভোল্টেজ গ্র্যাডিয়েন্ট। অক্সিজেন সেন্সর বা জারকোনিয়া সেন্সর কিংবা ল্যামডা সেন্সর আদতে তড়িৎ রাসায়নিক কোষ (Electrochemical cell)। দুটো ইলেক্ট্রোড থাকে এর মধ্যে। বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে তুলনা করে কী পরিমাণ ভোল্টেজ পাওয়া যাচ্ছে (output voltage) তা জানান দেয়।

লব্ধ ভোল্টেজ ২০০ মিলিভোল্ট হলে বোঝায় জ্বালানি ঠিক ঠাক নেই। অর্থাৎ ‘লিন মিক্সচার’। আবার লব্ধ ভোল্টেজ ৮০০ মিলিভোল্ট হলে বুঝতে হবে ইঞ্জিনের জ্বালানি রিচ মিক্সচার। গাড়ির পক্ষে বা ইজিনের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

অক্সিজেন সেন্সর কত রকমের হয়? গাড়ির প্রধান অংশ ইঞ্জিন। জ্বালানি দহন করে গাড়িকে সচল রাখে। ইঞ্জিনের স্বাস্থ্ রক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় অক্সিজেন সেন্সর। তবে শুধু গাড়িতে নয়, বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয় অক্সিজেন সেন্সর। অক্সিজেন সেন্সর অনেক রকমের হয় যেমন,

  • অপটিক্যাল অক্সিজেন সেন্সর – চোখের বিভিন্ন রোগ সনাক্ত করতে ব্যবহার করা হয়।
  • ইনফ্রারেড অক্সিজেন সেন্সর – শরীরের বিভিন্ন স্থানে অক্সিজেন পরিমাপ করে।
  • আলট্রাসোনিক অক্সিজেন সেন্সর – চিকিৎসা শাস্ত্রের বহু কাজে ব্যবহার করা হয়। ইদানীং পালস অক্সিমিটার যন্ত্র প্রায় ঘরে ঘরে। এর কাজ রক্তে অক্সিজেন পরিমাপ করা।

অক্সিজেনের অভাব ঘটলে কি হতে পারে? অক্সিজেনের উপস্থিতি প্রায় সর্বত্র। জীবন ধারণের অন্যতম শর্ত অক্সিজেন। বাতাসে মিশে থেকে অক্সিজেন তৈরি করেছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যার কুড়ি শতাংশই অক্সিজেন।

জীবন ধারণের জন্য বড়ই প্রয়োজনীয় মৌল। সাধারণ তাপমাত্রায় গ্যাস, তাপমাত্রা খুব কমিয়ে দিলে (-183°C) তরল। অক্সিজেন যদি না থাকে বাতাসে? আগুনই জ্বলবে না। রন্ধন ক্রিয়া বন্ধ। শ্বাস ক্রিয়া বন্ধ, হেতু ভয়ংকর পরিণাম। ঘটবে মৃত্যু।

কারণ বিনা অক্সিজেনে বেঁচে থাকা অসম্ভব। মানুষ এবং প্রায় সমস্ত প্রাণীর (কয়েক ধরনের ব্যক্টেরিয়া বাদে) জীবন ধারনের অপরিহার্য উপাদান অক্সিজেন হল দ্বি-পারমাণবিক একটি গ্যাস। তিন দিন জল ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব। খাদ্যবিহীন অবস্থায় তিন সপ্তাহ। আর অক্সিজেন বিনা? তিন মিনিটও মানুষ বাঁচতে পারবে না।

অক্সিজেনের মাত্রা খানিক হ্রাস পেলে, জীব দেহের যন্ত্র সেটা বুঝে নিয়ে অন্য ভাবে বেঁচে থকার চেষ্টা করে (Adaptation)। দীর্ঘ কালের বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রাণী দেহে এমন কৌশল তৈরি হয়েছে।

ঘাড়ের পাশে থাকে ক্যারোটিড বডি। ক্যারোটিড বডির অনেক কোষ বুঝতে পারে রক্তের মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা (Partial pressure of oxygen) কমে গেল কিনা। অক্সিজেনের ঘাটতি হলে বিকল্প প্রক্রিয়ায় জীবদেহ টিকে থাকতে চেষ্টা করে। আমেরিকার এক বৈজ্ঞানিক করোনিল হেইম্যান (Corneille Heymans) এই তত্ত্ব আবিষ্কার করে ( “for the discovery of the role played by the sinus and aortic mechanisms in the regulation of respiration.”) ১৯৩৮ সালে নোবেল সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।

অক্সিজেনের অভাব ঘটলে প্রাণ ধারণের প্রয়জনীয় শক্তিই তৈরি হবে না। শক্তি তৈরি হয় প্রাণীদেহের কোষের মধ্যে।মাইটোকন্ড্রিয়া নামের এক যন্ত্র অক্সিজেনকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য থেকে তৈরি করে শক্তি [গ্লুকোজ, অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেট (ATP)]।

প্রাণ ধারণ প্রক্রিয়ায় অন্যতম শর্ত হল শক্তি উৎপাদন। এর জন্য দরকার প্রাণী দেহের প্রতিটি কোষে যথেষ্ট মাত্রার অক্সিজেনের উপস্থিতি। প্রসঙ্গক্রমে বলে নেওয়া উচিৎ, ক্যানসার কোষে অক্সিজেনের মাত্রা খুব কমে যায়। তবুও, টিকে থাকার প্রয়োজনে স্বল্প অক্সিজেন মাত্রায় বিশেষ উপায়ে ক্যানসার কোষ তৈরি করে নিতে পারে শক্তি (গ্লুকোজ)। কীভাবে করে? এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন জার্মান বৈজ্ঞানিক অটো ওয়ারবার্গ (Otto Heinrich Warburg) এবং তাঁর কাজের স্বীকৃতিতে ১৯৩১ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

অক্সিজেন ঘাটতি (Hypoxia) কম মাত্রার হলে কোষ সেটাকে মানিয়ে নিতে পারে। মানিয়ে নেবার যান্ত্রিক কৌশল বলবৎ থাকে কোষের অভ্যন্তরে। কিন্তু প্রশ্ন, অক্সিজেন-ঘাটতি জানা যাবে কেমন করে? কোন্ কোষে কখন কম পড়ছে অক্সিজেন? জানবার পর কে সরবরাহ করবে অক্সিজেন? কী ভাবে?

বড় জটিল কিন্তু স্বাভাবিক সব প্রশ্ন। এই সব প্রশ্নের উত্তর ইদানীংকালে আমরা জানতে পেরেছি। কয়েক দশকের গবেষণার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে উত্তর। জানতে পেরেছি যে প্রতিটি কোষেরই প্রয়োজন হয় অক্সিজেন। কোষের মধ্যে আছে অক্সিজেন সেন্সর। কোষের ভিতর ঘটে চলা অত্যন্ত সূক্ষ্ম জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ সব কাজের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় অক্সিজেন সেন্সরের কাজ। যেমন অক্সিজেন কমে গেলেই কোষের মধ্যে বেড়ে যায় এক ধরনের হরমোনের মাত্রা। হরমোনটির নাম ইরিথ্রোপয়েটিন (Erythropoietin)। সংক্ষেপে EPO।

কী এই ইরিথ্রোপয়েটিন? এক ধরনের এনজাইম। এর ক্রিয়াতেই লোহিত রক্ত কণার জন্ম হয়। তদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ইরিথ্রোপয়েসিস নামের এই প্রক্রিয়ায় (গ্রিক শব্দ, ইরিথ্রো মানে লাল, আর পয়েসিস-এর অর্থ তৈরি হওয়া) হাড়ের মজ্জার (bone marrow) ভিতর তৈরি হয় ইরিথ্রোসাইট বা লোহিত রক্ত কণিকা।

উৎপন্ন লোহিত কণিকা রক্ত নালীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দেহের সর্বত্র টিসু এবং কোষে পৌঁছে দেয় অক্সিজেন। রক্ত নালীতে অক্সিজেনের ঘাটতি হলেই কিডনি সেটা বুঝে নিয়ে রক্ত তৈরির উপাদান ইরিথ্রোপয়েটিন হরমোন তৈরি (Secrete) করে। কিন্তু কী ভাবে বুঝতে পারে, কেমন করে এবং কার নির্দেশেই বা তৈরি করে এই হরমোন সেটা জানা ছিল না এত দিন।

লোহিত রক্ত কণা (RBC) তৈরিতে EPO-র যে ভূমিকা আছে বিংশ শতাব্দীতেই জানা গিয়েছিল এই তথ্য। কিন্তু কী ভাবে EPO কাজটি করে তার উত্তর জানা ছিল না। দীর্ঘ কালের অজানা প্রশ্নের উত্তর জানা সম্ভব হয়েছে একবিংশ শতাব্দীতে। কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের দীর্ঘকালীন এবং অক্লান্ত গবেষণায় উঠে এসেছে বহু অজানা তথ্য।

এই বিষয়ে কাজ করে ২০১৯ সালে নোবেল সম্মানে ভূষিত হন তাঁরা – উইলিয়াম কেলিন (William G. Kaelin Jr), পিটার র‍্যাডক্লিফ (Sir Peter J. Ratcliffe) এবং গ্রেগ সেমেঞ্জা (Gregg L. Semenza)।


ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী: পূর্বতন বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্, চিত্তরঞ্জন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা সংস্থান, কলকাতা।