Chemistry-রসায়নEngineering & Technology-প্রজুক্তি ও প্রকৌশলFree ArticlesScience News-বিজ্ঞানের টুকরো খবর

মুঠোফোন ও বিপন্ন ইনডিয়াম মৌল

indium in mobile screen

আজ যে মুঠোফোন (mobile/cellphone) আপনার আমার প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী… জানেন কি সেই মুঠোফোনটির সঙ্গে আপনি কতগুলো মৌলিক পদার্থকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন? আজ্ঞে হাঁ। পর্যায়সারণি’র 118টা মৌলের মধ্যেকার 30টা মৌলই আপনার পকেটে/হাত ব্যাগে আপনার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এই 30 টি মৌল সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। আসলে যে মুঠোফোনটি আপনি ব্যবহার করছেন সেটির বিভিন্ন অংশ নির্মিত হয়েছে ঐ 30 টি মৌল অথবা তাদের কোন যৌগ দ্বারা। আর তাই এই 30 টি মৌলের অধিকাংশই বর্তমানে তাদের অস্তিত্বের বিপন্নতার (in the List of Endangered Elements) সম্মুখীন হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কিন্তু আপনি, আমি, আমরা সকলে। খুব কি অবাক হচ্ছেন? আসুন দেখি প্রকৃত বাস্তব অবস্থাটা কি।

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় যৌগিক পদার্থের সৃষ্টি 90 টি (118টির মধ্যে) স্থায়ী (stable) মৌলের নানাবিধ সমন্বয়/রাসায়নিক মিলনের ফলে। বর্তমানে পর্যায়সারণি’র 118টি মৌলের মধ্যে 44 টি মৌল চিহ্নিত হয়েছে বিপন্ন মৌল (Endangered Elements, EE) হিসেবে। এই 44 টি মৌলকে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে ACS-GCS (American Chemical Society আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির অন্তরভুক্ত Green Chemistry গ্রীণ কেমিস্ট্রি) পর্যায়সারণি’র একটি বিশেষ চিত্র (নীচে দ্রষ্টব্য) প্রকাশ করেছে। এই চিত্র অনুযায়ী 44 টির মধ্যে 9টি মৌল চিহ্নিত হয়েছে(গাঢ় লাল রঙ) অত্যন্ত বিপন্ন (serious threat to their supply) হিসেবে। এই মৌলটির যোগান কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে আগামী 100 বছরে। আর সাতটি মৌল(কমলা রঙ) ক্রমবর্ধমান বিপন্নতার তালিকায়। অবশিষ্ট 28 টি মৌলের (হলুদ রঙ) যোগান ও ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে চলেছে অর্থাৎ অস্তিত্বের বিপন্নতার দিকে এগিয়ে চলেছে।

পর্যায়সারনী। ছবিঃ গুগুল
বিপন্ন মৌলের তালিকা। ছবিঃ গুগুল

এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বেশ কিছু মৌলের এই বিপন্নতার কারণ কি? কারণ হল আধুনিক টেকনোলজিতে এই মৌলগুলির প্রভূত ব্যবহার…বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল স্মার্টফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার এবং আরও কিছু কিছু ইলেকট্রনিক যন্ত্রে এই মৌলগুলির আবশ্যিক ব্যবহার।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে… শুধুমাত্র EU এর অন্তর্গত 28 টি রাজ্যেই প্রতি মাসে প্রায় 10 মিলিয়ন স্মার্ট ফোন বাতিল হয়। কাজেই একথা সহজেই অনুমেয় যে সারা বিশ্বে কি বিপুল পরিমাণ স্মার্টফোন প্রতি দিন/ মাস/বছরে বাতিল হয় এবং তার ফলে কি বিশাল পরিমাণে চাহিদা হয় নতুন ফোনের। আর বাতিল ফোনগুলির সঙ্গে লুপ্ত হয়ে যায় অনেকগুলি অমূল্য মৌলিক পদার্থ ।

এখন প্রশ্ন হল এই স্মার্টফোনের সঙ্গে মৌলের বিপন্নতার কি সম্পর্ক?… নিবিড় সম্পর্ক। আসলে স্মার্টফোনের বিভিন্ন অংশ মূলত তৈরি হয় 30টি মৌলের সরাসরি ব্যবহারে অথবা তাদের কোন যৌগ দ্বারা। অর্থাৎ স্মার্টফোনের নির্মাণের পিছনে আছে 30 টি মৌলিক পদার্থের উল্লেখযোগ্য অবদান।

আসুন… সংক্ষেপে একটু দেখে নেওয়া যাক কোন মৌলগুলি ব্যবহৃত হয় স্মার্ট ফোনের বিভিন্ন অংশ নির্মাণে।

তামা, সোনা ও রুপা ব্যবহৃত হয় বিদ্যুত পরিবাহী হিসেবে। স্মার্ট ফোনের ব্যাটারিতে থাকে লিথিয়াম ও কোবালট ধাতু। এই ফোনের প্রসেসর নির্মাণে লাগে সিলিকন, অক্সিজেন, ফসফরাস, অ্যান্টিমনি, আরসেনিক, বোরন, ইনডিয়াম ও গ্যালিয়াম ধাতু। সিলিকন চিপ (প্রসেসর) তৈরি হয় বিশুদ্ধ সিলিকন দ্বারা। এরপরে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এর উপরিতলে (Surface) সিলিকন ডাইঅক্সাইড’এর একটা খুব পাতলা স্তর (thin film) নির্মাণ করা হয়।

বিশুদ্ধ সিলিকন semi conductor… তাই সাধারণ তাপমাত্রায় এর বিদ্যুত পরিবহনের ক্ষমতা খুব কম। তাই সিলিকনের বিদ্যুত পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় প্রয়োজনীয় পরিমান ফসফরাস/আরসেনিক/অ্যান্টিমনি (n-type semi conductor) অথবা বোরন/ইনডিয়াম/গ্যালিয়াম (p type semiconductor) মিশ্রিত করে। এই মিশ্রণ পদ্ধতিকে বলা হয় Doping. খেলোয়াড়েরা যেমন Doping করে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে ঠিক তেমনই এই Doping এর সাহায্যে সিলিকনের বিদ্যুত পরিবহন ক্ষমতা প্রয়োজনমত বৃদ্ধি করা যায়।

এরপরে আসি স্মার্ট ফোনের টাচস্ক্রিন-এ…যা ইনডিয়াম ও টিন অক্সাইড যৌগের একটি অতি পাতলা স্বচ্ছ পরদা এবং উচ্চমাত্রার তড়িত সুপরিবাহী। বর্তমানে ইনডিয়াম মৌলটির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে কারন এটিও বিপন্ন মৌল (Endangered Elements, EE) হিসেবে পরিচিত।

resistive-touch-screens-using-indium-tin-oxide
একটি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের উপর যা থাকে। ছবিঃ গুগুল
একটি মোবাইল ফোন প্রস্তুত করতে লাগে এতগুলি মৌল। ছবিঃ গুগুল

স্মার্ট ফোনের মাইক্রোফোন ও স্পিকারে থাকে শক্তিশালী চুম্বক। এই চুম্বকের উপাদান হল নিয়োডাইমিয়াম, লোহা ও বোরনের একটি শঙ্কর ধাতু (alloy)। এছাড়া ফোনের vibration unit এ ও ব্যবহৃত হয় ডাইসপ্রোসিয়াম ও প্রমিথিয়ামের একটি শঙ্কর ধাতু। আমি আর অতিরিক্ত বিশদে গিয়ে পাঠকের ধৈর্য চ্যুতি ঘটালাম না।

অতএব একথা সহজেই অনুমেয় যে সারা পৃথিবী জুড়ে স্মার্ট ফোনের অবাধ ব্যবহার কি বিপুল পরিমাণে বেশ কিছু মৌলিক পদার্থকে গ্রাস করে চলেছে। তাছাড়া শুধু তো স্মার্ট ফোনই নয়। আধুনিক টেকনোলজির দুনিয়ায় যে কোন ইলেকট্রনিক আইটেম নির্মাণেই উপরোক্ত মৌলগুলির এক বা একাধিক ব্যবহৃত হয়… বিশেষ করে গ্যালিয়াম, সিলভার, জারমানিয়াম ও আরসেনিক এই চারটি মৌলের ব্যবহার সর্বাধিক। আর এই সমস্ত ইলেকট্রনিক আইটেম আজ আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার যে প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে… একথা বলাই বাহুল্য।

আসলে আজ আমরা আধুনিক পৃথিবীর বাসিন্দারা এমন এক টেকনোলজি নির্ভর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি… যেখানে স্মার্ট ফোন বা অন্যান্য বেশ কিছু নিত্য ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক আইটেম ত্যাগ করা কার্যত প্রায় অসম্ভব। তবে একথা ও ঠিক যে সজাগ হওয়ার সময় হয়েছে।

প্রকৃত বাস্তব পরিস্থিতি হল… যে বিপুল হারে স্মার্ট ফোন উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে রিসাইক্লিং এর সমানুপাতিক ব্যবস্থা কিন্তু চালু নেই। যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য। আর তারই ফল স্বরূপ বেশ কিছু মৌলিক পদার্থ আজ “List of Endangered Elements” এর অন্তর্গত হয়েছে অথবা তালিকাভুক্ত হওয়ার পথে দ্রুত বেগে ধাবমান। এই পরিস্থিতির সামাল দিতে শুধুমাত্র সরকারি পদক্ষেপ বা বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। আমাদের সাধারণ মানুষের ও কিছু দায়িত্ব বর্তায়। অবশ্যই আম জনতার সজাগ থাকাটা জরুরী। মুঠোফোনের সীমিত ব্যবহার, ঘনঘন ফোন পরিবর্তন না করা ইত্যাদি অভ্যাসগুলিকে রপ্ত করা একান্ত প্রয়োজন। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে এই বিশ্বের মাত্র 118 টি মৌলের মধ্যে 44টি মৌল যদি অস্তিত্বের বিপন্নতার সম্মুখীন হয় তাহলে সেই সংকটের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সবরকমের ফলভোগের শাস্তি কিন্তু ভোগ করব আমরাই…এই গ্রহের অধিবাসীরাই।


ড.  অঞ্জনা ঘোষ: বিজ্ঞান লেখিকা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অজৈব রসায়নে পিএইচডি | বর্তমানে অশোক হল বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সিনিয়র বিভাগ)-এর শিক্ষিকা।

Anjana Ghosh

বিজ্ঞান লেখিকা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অজৈব রসায়নে পিএইচডি | বর্তমানে অশোক হল বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সিনিয়র বিভাগ)-এর শিক্ষিকা।