Biography-জীবনীFree Articles

‘কোয়ান্টাম ইন্ডিয়ান’ সত্যেন্দ্রনাথ বসু

টেবিলের উপর একতাড়া চিঠি। আইনস্টাইন তার ভিতর থেকে একটা চিঠি তুলে নিলেন। চিঠিটির প্রেরকের নাম দেখলেন। না, চেনা কেউ নয়। বিজ্ঞানী মহলে এমন নাম শুনেছেন বলে মনে করতে পারছেন না। উৎসাহী হয়ে চিঠিটা খুললেন। একটি গবেষণাপত্র। পাঠিয়েছেন ভারতবর্ষ থেকে এক তরুণ বিজ্ঞানী। সঙ্গে একটি চিঠি। তাতে তিনি আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেছিলেন এ সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানাতে।

গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘প্ল্যাঙ্কস ল এ্যান্ড হাইপোথেসিস অফ লাইট কোয়ান্টা’ (Planck’s Law and Hypothesis of Light Quanta)। এটি পড়ে আইনস্টাইন-এর এতটাই ভালো লেগেছিল যে তিনি তরুণ বিজ্ঞানীর অনুরোধ রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, গবেষণার সারবত্তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজেই সেটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে সে সময়ের বিখ্যাত জার্নাল ‘সাইটস্ক্রিফট ফ্যুর ফিজিক্’ (Zeitschrift fur Physik)-এ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। পাদটীকায় লিখেছিলেন, বোস যেভাবে প্ল্যাঙ্কের সূত্র উপস্থাপিত করেছেন তা আমার মতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

চার পৃষ্ঠার গবেষণা পত্রটির সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ বসু যে চিঠিটি আইনস্টাইনকে লিখেছিলেন সেটা ছিল এই রকমঃ

Physics Department
Dacca University
4th June, 1924

Respected Sir,

I have ventured to send to you the accompanying article for your perusal and opinion. I am anxious to know what you think of it. You will see that I have tried to deduce the coefficient 8π ν2/c3 in Planck’s Law independent of classical electrodynamics, only assuming that the ultimate elementary region in the phase-space has the content h3. I do not know sufficient German to translate the paper. If you think the paper worth publication I shall be grateful if you arrange for its publication in Zeitschrift für Physik. Though a complete stranger to you, I do not feel any hesitation in making such a request. Because we are all your pupils though profiting only by your teachings through your writings. I do not know whether you still remember that somebody from Calcutta asked your permission to translate your papers on Relativity in English. You acceded to the request. The book has since been published. I was the one who translated your paper on Generalised Relativity.

Yours faithfully,
S.N.Bose

‘কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক’-এর জন্ম হয় ‘বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স’ থেকে যথাসময়ে গবেষণাপত্রটি ওই জার্নালে ছাপা হয়েছিল। আর এরই সূত্র ধরে জন্ম নিয়েছিল ‘বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিক্স’। আর সেখান থেকে বোসন কণার অস্তিত্বের থিয়োরি। জন্ম হল পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন শাখার— ‘কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক’।

এর আগে তরুণ বিজ্ঞানী তাঁর এই গবেষণাপত্রটি ব্রিটেনের বিশিষ্ট বিজ্ঞান পত্রিকা ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক পত্রিকার কর্তৃপক্ষ সেটা প্রকাশে দেরী করছিলেন।

এবারে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে আমি কোন বিজ্ঞানীর কথা বলতে চাইছি? হ্যাঁ, আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু যিনি বিদেশে এস এন বোস নামে বেশি পরিচিত।

উত্তর কলকাতার গোয়াবাগান অঞ্চলে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের কাছে ২২, ঈশ্বর মিল লেনে ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু রেল কোম্পানীতে হিসাব রক্ষকের পদে কর্মরত ছিলেন। মাতা আমোদিনী দেবী ছিলেন আলিপুরের লব্ধ-প্রতিষ্ঠ আইনজীবী মতিলাল রায়চৌধুরির কন্যা। দুশো বছরেরও বেশি সময় ধরে বসু পরিবার এই বাড়িতে বসবাস করলেও তাঁদের আদিনিবাস ছিল নদীয়া জেলার বড় জাগুলিতে।

কলকাতা শহর গড়ে ওঠার আগে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই জেলা ছিল বাংলার সংস্কৃতির পীঠস্থান। সারা ভারতে এখানকার পণ্ডিতদের খ্যাতি ছিল তখন। সত্যেন্দ্রনাথের পিতামাতার তিনিই ছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান। তবে তাঁর ছয় বোন ছিলেন। পিতা সুরেন্দ্রনাথ এবং পিতামহ অম্বিকাচরণ দুজনেই ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সরকারী চাকুরে।

সত্যেন্দ্রনাথ ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিলেন। শোনা যায়, দুষ্টুমি বন্ধ করার জন্য তাঁর বাবা তাঁকে সারাদিন অঙ্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকার মত অঙ্ক কষতে দিয়ে যেতেন। খেলাধুলাতেও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। দাবা, টেনিস ইত্যাদি নানা খেলায় তাঁকে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যেত। তবে ক্যারাম খেলার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রৌঢ় বয়সেও তাঁকে এই খেলাটা খেলতে দেখা গেছে।

অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। শোনা যায়, সেইসময় একখানি পাঠ্যপুস্তক কোনোভাবে ছিঁড়ে যায়। বিরক্ত হয়ে তিনি বইটি পুরোপুরি ছিঁড়ে ফেলে দেন। তাই দেখে তাঁর মা খুব বকাঝকা করেন। তখন নাকি তিনি মাকে বলেছিলেন যে ওই বইটির যেকোনো অংশ থেকে ধরলে তিনি বলে দিতে পারবেন। একই ক্লাশে পড়ে পাশের বাড়ির এমন এক ছাত্রের কাছ থেকে ওই বইটি চেয়ে এনে তাঁর মা বিভিন্ন অধ্যায় থেকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। বালক সত্যেন্দ্রনাথ হুবহু মুখস্ত বলে গেলেন। এমনি অসাধারণ প্রখর ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি।

মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষকদের অতি প্রিয় ছিলেন। হিন্দু স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন উপেন্দ্রনাথ বক্‌সী। তিনি টেস্ট পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথকে অঙ্কে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, প্রশ্নপত্রে ১১টি প্রশ্নের মধ্যে ১০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথের খাতায় আমি ১১টি প্রশ্নেরই উত্তর পাই। শুধু তাই নয়, জ্যামিতির একস্ট্রাগুলি সে দু-তিনটি উপায়ে সমাধান করে দেখিয়েছে। তাঁর এই অসাধারণ মেধার পরিচয় পেয়ে আমি এতটাই অভিভূত যে আমি তাঁকে ১০০-র মধ্যে ১১০ না দিয়ে পারলাম না। উপেন্দ্রনাথবাবু যে সেদিন ছাত্র চিনতে ভুল করেননি তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল পরবর্তীকালে। ১৯১৫ সালে তিনি রেকর্ড নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিশ্র গণিতে এম এস সি (M.Sc) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন। আর দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা। প্রেসিডেন্সী কলেজে বি এস সি পড়ার সময় থেকেই দু’জনে বন্ধু ছিলেন।

শ্যামবাজারের কাছে কম্বুলিয়াটোলার নামকরা চিকিৎসক যোগীন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়ের কন্যা ঊষাবতীর সঙ্গে ১৯১৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথের যখন বিবাহ হয় তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এস সি পড়ছেন। ঊষাবতী ছিলেন তাঁর পিতামাতার একমাত্র সন্তান। বিবাহের সময় সত্যেন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২০ বছর এবং তাঁর পত্নীর ১১ বছর।

১৯১৬ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাথ সাহা দু’জনেই অধ্যাপনার কাজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগে যোগ দেন। তবে এই বিভাগে তাঁদের দু’জনেরই বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। কারণ এই বিভাগের ‘ঘোষ প্রফেসর’ ডঃ গণেশ প্রসাদের সঙ্গে তাঁদের বনিবনা হচ্ছিল না। তাই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বদলি করে দেন।

কলকাতা বিশ্ববদ্যালয়ে বছর পাঁচেক পড়ানোর পর ১৯২১ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার পদে যোগ দেন। এখানে অধ্যাপনার সময়েই তিনি তাঁর ইতিহাস সৃষ্টিকারী গবেষণাপত্রটি আইনস্টাইনের কাছে পাঠান। পরের ঘটনা আগেই ব্যক্ত করেছি।

আইনস্টাইনকে পাঠানো প্রথম গবেষণাপত্রটি তখনও প্রকাশের অপেক্ষায়। এরই মধ্যে তিনি তাঁর পরবর্তী গবেষণাপত্রটি কর্তার কাছে পাঠিয়ে দেন। এই প্রসঙ্গে বলি সত্যেন্দ্রনাথ বসু তিন জনকে ‘কর্তা বলে সম্বোধন করতেন। এঁদের মধ্যে একজন হলেন তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু, অন্যজন হলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং তৃতীয় জন হলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। অধ্যাপক বসুর এই দ্বিতীয় গবেষণাপত্রটিও আইনস্টাইন জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ওই একই জার্নালে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। তিনি প্রথম গবেষণাপত্রটির যেভাবে প্রশংসা করেছিলেন এটির তেমন তা করলেন না। বরং এই নিবন্ধটির পাদটিকায় তিনি তাঁর মন্তব্যে লিখলেন যে তিনি বিজ্ঞানীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না। ফলে গবেষণাপত্রটি গাণিতিক আলোচনা ও প্রমাণের দিক থেকে অসামান্য হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানী মহলে তেমন গুরুত্ব পেল না।

গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘পদার্থের উপস্থিতিতে বিকিরণ ক্ষেত্রে তাপগতিবিদ্যাসম্মত সাম্য’ (Thermal Equilibrium Field in the presence of matter)। আইনস্টাইন নিবন্ধটির পাদটীকায় যে মন্তব্যই জুড়ে দিক না কেন অধ্যাপক বসু মনে করতেন এটি ছিল তাঁর জীবনের সর্ব শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্র। পরবর্তীকালে তিনি যখন ইউরোপ গিয়েছিলেন তখন জার্মানে আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। এই নিবন্ধটি নিয়ে দু’জনের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা সহমত হতে পারেননি।

অধ্য্যাপক বসু তখন প্যারিসে। সেখান থেকেই তিনি আরেকটি গবেষণাপত্র আইনস্টাইনের কাছে পাঠান। পাঠানোর আগে এই নিবন্ধটি তিনি বিজ্ঞানী লাজভাঁকে দেখিয়েছিলেন। লাজভাঁ নিবন্ধটির উচ্চ প্রসংশা করে বলেছিলেন, এটি অতি উচ্চমানের একটি গবেষণাপত্র এবং প্রকাশযোগ্য। অথচ আইনস্টাইন এই নিবন্ধটির কোনো গুরুত্বই দিলেন না। তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে চিরকাল বন্দী হয়ে থেকে গেল। অন্যত্র প্রকাশের সুযোগ থাকা সত্বেও অধ্যাপক বসু কেন তা করেন নি জানা যায় নি। জিজ্ঞেস করলে তিনি শুধু বলতেন “দুঃখ পেয়েছিলাম”। এর বেশি কিছু বলতে চাইতেন না— হয়ত গুরুকে অসম্মান করা হবে এই ভেবে! যাইহোক, পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের অভিমত হল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গবেষণাপত্র দুটির বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গুরু শিষ্য কেউই সঠিক ছিলেন না।

ইউরোপে ভ্রমণকালে যেসব খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে অধ্যাপক বসুর সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্ব হয়েছিল তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, আইনস্টাইন, মাদাম কুরী, অটো হান, লিজে মেইটনার, সিলভাঁ লেভি, লাজভাঁ, ওয়াল্টার বোথে, পউলি, হাইজেনবার্গ, জ্যাকেলিন, পিটার ডিবাই প্রভৃতি।

জার্মানিতে থাকাকালীন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে খবর আসে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জন্য শীগ্রই অধ্যাপকের পদ বিজ্ঞাপিত হবে। কিন্তু পি এইচ ডি না থাকলে এই পদের জন্য দরখাস্ত গৃহীত হবে না। বন্ধুরা বলে পাঠালেন যে তিনি যেন আইনস্টাইনের কাছ থেকে একটা প্রশংসাপত্র জোগাড় করে রাখেন। দরখাস্ত পাঠানোর সময় তিনি যেন সেটা দরখাস্তের সঙ্গে জুড়ে দেন। সত্যেন্দ্রনাথের সে সময় পি এইচ ডি উপাধি ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথের কাছে প্রশংসপত্র চাওয়ার কারণ জেনে আইনস্টাইন বলেছিলেন যে তাঁর গবেষণাপত্রটি কি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়? তাঁরা কি বুঝতে পারছেন না যে এই গবেষণা থেকে ক’ঝুড়ি পি এইচ ডি হতে পারে?

যাই হোক, আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথকে প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন। দু’বছর ইউরোপে কাটানোর পর দেশে ফিরে এসে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপকের পদে যোগ দেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে ‘খয়রা অধ্যাপকের’ পদে যোগ দেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সকলেই ভেবেছিলেন রমেশচন্দ্র মজুমদারের পরে সত্যেন্দ্রনাথ বসুই হবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। কিন্তু নানা কারণে সবার সেই আশা পূরণ হয় নি। ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ‘খয়রা অধ্যাপকের’ পদে যোগ দেন। এর প্রায় তিন বছর পরে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ নামে বাংলা ভাষায় মাসিকপত্র প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা নিরবিচ্ছিন্নভাবে আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। আমৃত্যু তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন।

  • সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে ছাপা ভারতীয় ডাকটিকিট
  • অধ্যাপক বসু দেশে বিদেশে নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
  • ১৯৪৯-৫০ সালে তিনি ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।
  • ১৯৫১ সালে ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক পরিগণন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয় আলোচনার জন্য ভারতের বিশেষ প্রতিনিধিরূপে তিনি প্যারিস যান।
  • ১৯৫২ সালে তিনি রাজ্যসভার সদস্য হন। ওই পদে তিনি ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন।
  • ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত করেন।
  • ১৯৫৫ সালে ‘আপেক্ষিকতাবাদের ৫০ বছর’ পূর্তি উপলক্ষে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন।
  • ১৯৫৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ওই বছরেই তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলংকৃত করেন।
  • ১৯৫৭ সালে তিনি কলকাতা, যাদবপুর এবং এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি পান।
  • ১৯৫৮ সালে তিনি এফ আর এস (FRS) হন।
  • ১৯৫৯ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান পান। ভারতে অধ্যাপকদের এটাই সর্বোচ্চ সম্মান।
  • ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট ১৯৬১ সালে তাঁকে ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে।
  • ১৯৬৩ সালে রাঁচী বিশ্ববিদ্যালিয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি ভাষণ দেন। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রতিনিধি হয়ে ওই বছরের জুলাই মাসে তিনি সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের আমন্ত্রণে কায়রো যান। এর আগে ১৯৬১ সালের মে মাসে তিনি সুইডেনে যান এস্‌কিলস্টুনা শহরে বিশ্বশান্তি সংসদের প্রস্তুতি কমিটির সম্মেলনে যোগ দিতে। ‘বিজ্ঞান ও দর্শন’ সম্পর্কিত এক আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রে যোগ দিতে আগস্ট মাসে তিনি টোকিও যান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে যান মস্কোতে, সেখানে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে। ওই বছরেই সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় তাঁকে ‘বিজ্ঞান ভাস্করম্‌’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন।
  • ১৯৬৪ সালে মহাজাতি সদনে তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দেন। তখন তাঁর সত্তর বছর বয়স। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের নিজস্ব ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন তিনি।
  • ১৯৭৩ সালে ১৯০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে ফেলো নির্বাচিত করেন।

ইউরোপ থেকে ফিরে এসে ঢাকায় থাকাকালীন তিনি একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেও বিকিরণ (Radiation) নিয়ে আর কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে তাঁকে দেখা যায়নি। এটা কি তাঁর অভিমান ছিল?

সত্যেন্দ্রনাথ বসু আড্ডা দিতে খুব ভালো বাসতেন। ঢাকায় থাকাকালীন ‘বারোজনা’ নামে তিনি সান্ধ্যসভার এক গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। এই সভাতে যে শুধু বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা হত তা নয়। সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতি নানা বিষয় আলোচনায় স্থান পেত। এমনকী সঙ্গীতচর্চাও হত।

সত্যেন্দ্রনাথ খুব ভালো এসরাজ বাজাতেন। দিজেন্দ্র-পুত্র দিলীপকুমার রায় ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ‘বারোজনা’ নামটা প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের দেওয়া। কলকাতায় ফিরে এলে তিনি একই রকম এক সান্ধ্যসভা-গোষ্ঠী তৈরি করেন। এই সভা তাঁর বাসভবনে প্রতি শনিবার বসত। সভার নাম ছিল ‘শনিবারের সম্মিলনী’। এই সভায় যেমন তাঁর বাল্যবন্ধু গিরিজাপতি ভট্টাচার্য, শচীন্দ্রনাথ সরকার, নীরেন্দ্রনাথ রায়, জীবনতারা হালদার, হরীতকৃষ্ণ দেব প্রভৃতিরা আসতেন তেমন আসতেন স্বামী শঙ্করানন্দ, সুবিমল লাহিড়ী, রাধারমণ মিত্র, কবি বিষ্ণু দে, হিরণ কুমার সান্যাল, জ্ঞানেন্দ্র লাল ভাদুড়ী, নন্দলাল মিত্র, মেজর সত্যেন বোস, মণি বাগচী, বিনোদবিহারী চক্রবর্তী, সত্যেন্দ্রনাথ সেন, দিলীপ বসু প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা। এই সভা চালু ছিল তাঁর মৃত্যুদিন পর্যন্ত।

১৯৭৪ সালের ১ জানুয়ারি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ভবনে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। বর্তমানে এই ভবনটির নাম ‘সত্যেন্দ্র ভবন’। এই সম্বর্ধনা সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘এবার যাবার পালা, তার ডাক কানে শুনছি। তিনি কি আসন্ন মৃত্যুর আভাস পাচ্ছিলেন? কেননা এর তেইশ দিন পরেই অর্থাৎ, ২৪ জানুয়ারি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৪ ফেব্রুয়ারি ভোরের আলো ফুটলো কিন্তু তিনি আর চোখ খুললেন না। মহাবিজ্ঞানীর মহাপ্রয়াণ হল।

সত্যেন্দ্র ভবনে একটি প্রদর্শশালা (museum) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে তাঁর ব্যবহৃত জিনিস, কাগজপত্র ও বই অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত আছে। এইসব অমূল্য সম্পদ সংগ্রহের সময় তাঁর পরিবার সব রকম সাহায্য করেছিলেন।

আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মৃত্যুর পর শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাতে গিয়ে বিজ্ঞানী এম জি মেনন বলেছিলেন যে ‘সত্যেন্দ্রনাথকে কেন নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল না’ এই প্রশ্নটি তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন দেশে এবং বিদেশের বহু বিজ্ঞানীকে করেছিলেন। কেউই কোনো উত্তর দিতে পারেন নি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ই সি জি সুদর্শনের মতে গুরু হার্ডি শিষ্য রামানুজনকে যেভাবে সাহায্য করেছিলেন গুরু আইনস্টাইন শিষ্য সত্যেন্দ্রনাথকে সেভাবে করেন নি। অধ্যাপক জি ভেঙ্কটরমনের মতে নোবেল কমিটি সত্যেন্দ্রনাথের ব্যাপারটা সঠিকভাবে বিচার করেননি। সত্যেন্দ্রনাথকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

১৯৮৬ সালে ভারত সরকার বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য সল্টলেকে গড়ে তুলেছেন ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার (S.N.Bose National Centre)। ১৯৯৪ সালে সারা দেশ জুড়ে আচার্য বসুর জন্মশতবর্ষ পালন করা হয়। এই উপলক্ষে রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ কালচার থেকে ২ খণ্ডে প্রকাশিত হয় ‘এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টিনারি ভলুম’ (S.N.Bose National Centenary Volume)। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ থেকে তাঁর সমগ্র বাংলা রচনাদি একত্রে মলাট বন্দি করা হয়েছে। কলকাতা পুরসভা তাঁর স্মৃতিতে একটি রাস্তার নামকরণ করেছে। তাঁর বাড়ির কাছাকাছি তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে।

ভারতের বরেণ্য এই কৃতি সন্তান আমাদের সকলের পরম গর্বের ও শ্রদ্ধার। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিজ্ঞানের জগতকে চিরকাল এগিয়ে নিয়ে যাবে।


কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়: জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখালেখি।