ধ্রুব যে তারা
মহাপুরুষেরা যা বলেন তা ধ্রুব সত্য। অর্থাৎ সত্যের পথ থেকে তা বিচ্যুত নয়। অর্থাৎ সত্যের পথ থেকে তার কোনো নড়াচড়া নেই। তাহলে ধ্রুবতারা নিশ্চয় সেই তারা যার কোনো নড়াচড়া নেই। মানে যা একেবারে স্থির। অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে যে কোনো দিনে যে কোনো সময়ে এই তারা আকাশের একই জায়গায় দেখা যাবে। বাস্তবিক তাই। ধ্রুবতারা যে স্থির শুধু তাই নয়, পৃথিবী থেকে তাকে সর্বদাই উত্তর আকাশে দেখা যায়। এককালে যখন দিগদর্শন যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি তখন এই ধ্রুবতারা দেখে জাহাজের নাবিক সমুদ্রে তার অবস্থান আর গতিপথ ঠিক করত। দিনে সূর্য থাকে কিন্তু রাতে থাকে না। তাই দিনের বেলা সূর্য দেখে দিক ঠিক করা গেলেও রাতে তা সম্ভব ছিল না। তখন আকাশে ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে দিক ঠিক করা হত। এমনকী এখনও অনেক গ্রামে গঞ্জে এমনভাবে দিক ঠিক করার প্রচলন রয়ে গেছে।
একেবারে ছোটবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি গ্রহরা স্থিরভাবে আলো দেয় কিন্তু তারা বা নক্ষত্ররা স্থির নয়। আর তারা বা নক্ষত্রেরা মিটমিটে আলো দিলেও তারা কিন্তু স্থির। ধ্রুবতারা যদি তারা হয় তবে তা তো সে স্থির হবেই। তাহলে আর আগে একটা ‘ধ্রুব’ এই বিশেষণ জোড়া কেন? এটা কি অর্থহীন নয়?
এই জগতে বা মহাজগতে প্রকৃতপক্ষে স্থির বস্তু বলে কিছু নেই। আমাদের পৃথিবীর কথাই ধরা যাক। তা নিজের অক্ষের চারিদিকে সারাদিনে একপাক ঘুরে চলেছে। আবার এক বছর বা তিনশ পঁয়ষট্টি দিনে সূর্যকে সম্পূর্ণ একবার প্রদক্ষিণ করছে। অর্থাৎ সময়ের তারতম্যে আকাশে উপস্থিত বস্তু তার স্থান পরিবর্তন করছে পৃথিবীর সাপেক্ষে। খুব সহজ উদাহরণ হল আকাশে সূর্যের অবস্থান। সকালে যেটা দেখছি পূর্বে বিকালে সেটাই গিয়ে হাজির হচ্ছে পশ্চিমে। অর্থাৎ স্থির সূর্য কিন্তু পৃথিবীর গতিশীলতার সাপেক্ষে গতিশীল হয়ে পড়ছে। এককালে ইতালির পোপের সঙ্গে গ্যালিলিওর তো বিরাট মতপার্থক্য হয়েছিল এই নিয়ে। সেই মতপার্থক্য কতটা তিক্ত হয়েছিল বা তার ফল কী হয়েছিল সে নিয়ে অবশ্য বর্তমান প্রবন্ধটি নয়।
সে ইতিহাসের কথা এখন থাক। কারণ এ বিষয়টি অনেকেই জানে। আর সবাই জানে সূর্য একটি নক্ষত্র হওয়ার সুবাদে সর্বদাই এক অবস্থানে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর আবর্তন হেতু সে তার অবস্থান পাল্টায়। এইভাবে আকাশের বিভিন্ন নক্ষত্র ও অন্যান্য মহাকাশের বস্তু সময়ের সাপেক্ষে তার অবস্থান পরিবর্তন করছে।
গতি এবং স্থিতি বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ আপেক্ষিক। যেমন ধরুণ দুটো ট্রেন একসঙ্গে পাশাপাশি একই গতিতে একই দিকে যাচ্ছে। একটি ট্রেন থেকে আর একটি ট্রেনকে দেখলে কিন্তু স্থির বলে মনে হবে। আবার ধরুণ ওপরের উদাহরণে ট্রেন দুটো যদি দুই বিপরীত দিকে যায় তবে একটি ট্রেন থেকে আর একটিকে ভীষণ দ্রুত চলমান মনে হবে। ট্রেনদুটো যদি প্রত্যেকেই ষাট কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় দুই বিপরীত দিকে যায় তবে এক ট্রেন থেকে অন্যকে একশ কুড়ি কিলোমিটার বেগে একে অন্যকে অতিক্রম করছে বলে মনে হবে। কিন্তু কেউ যদি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে তবে সে কিন্তু উভয় ট্রেনকেই ষাট কিলোমিটার বেগে ভিন্ন দিকে যেতে দেখবে।
ওপরের উদাহরণটি দেওয়া হল আকাশের তারাগুলি কেন নিয়ত তাদের স্থান পরিবর্তন করে তা বোঝাতে। আমরা জানি তারাগুলি স্থির। তবে আবার স্থান পরিবর্তনের প্রশ্ন আসছে কী করে? আসলে তারাগুলি স্থির মহাকাশের সাপেক্ষে। কিন্তু আমাদের পৃথিবী তো গতিশীল। তাই তার এই গতিশীলতার সাপেক্ষে তারাগুলির অবস্থানও পরিবর্তনশীল হবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ধ্রুবতারা এমন এক তারা যাকে সর্বদাই আকাশের উত্তর দিকে এক অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব সেটা বুঝতে গেলে পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ সম্পর্কে কিছু জানতে হবে আর সঙ্গের ছবিটি ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
আমরা জানি পৃথিবীর দৈনিক ঘূর্ণন অক্ষ (diurnal axis) উল্লম্ব বা অনুভূমিক কিছুই নয়। এটি উল্লম্ব বা অনুভূমিক উভয় অক্ষের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন কৌণিক নতিতে অবস্থিত। সঙ্গের ছবিটি একটি মেঘমুক্ত রাতের আকাশের যেখানে তারা আর অন্যান্য মহাকাশের বস্তুগুলি খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়। এই আকাশে অনেক তারার মধ্যে ধ্রুবতারা ছাড়া অন্য যে কোনও একটি তারাকে বেছে নেওয়া হল পর্যবেক্ষণের সুবিধার জন্যে।
আকাশে অবস্থিত অনেক তারার মধ্যে ধ্রুবতারার অবস্থানের একটু বিশেষত্ব আছে। এই বিশেষ তারাটি বিশেষ একটি রেখার ওপর অবস্থিত। সেই রেখাটি হল পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ (diurnal axis)। অর্থাৎ যে রেখাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরে চলেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই রেখাটির থেকে দূরত্বে যে বিন্দুগুলি আছে তাদের প্রত্যেকের ঘূর্ণনের জন্যে অবস্থানের পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু এই রেখার ওপর অবস্থিত বিন্দুগুলির কোনও ঘূর্ণন হচ্ছে না আর তাই তাদের অবস্থানেরও কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। ধ্রুবতারা যেহেতু এই রেখার ওপর অবস্থিত তাই পৃথিবীর উপরস্থ যে কোনও বিন্দুর সাপেক্ষে তার অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। সারা দিন বা সারা বছরের সব কটা দিনে তাকে একই অবস্থানে দেখা যাচ্ছে।
বিষয়টি আরও একটু বুঝিয়ে বলা যেতে পারে। ধরা যাক আপনি একটি খোলা ছাতার বাঁট ধরে মানে তাকে স্থির রেখে ছাতাটিকে ঘোরাচ্ছেন। শিকের প্রান্তবিন্দুগুলি ঘূর্ণনের জন্যে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে। ঠিক যেমন একটি নাগরদোলার ঘোড়াগুলি ঘুরে চলে। কিন্তু বাঁটের শীর্ষবিন্দুটির কোনও ঘূর্ণন হচ্ছে না। সে কিন্তু একই অবস্থানে আছে। ছাতার শিকের প্রান্তবিন্দুগুলিকে ছাতার বাঁটের আবর্তন অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণমান পৃথিবীর উপরস্থ বিভিন্ন স্থান মনে করতে পারেন। ছাতার শীর্ষবিন্দুটি হল ধ্রুবতারার অবস্থান। মনে রাখবেন ছাতার বাঁটটিকে একই রেখা বরাবর ওপর দিকে আরও বাড়িয়ে গেলেও কিন্তু সেই রেখার উপরস্থ বিন্দুগুলি সর্বদাই ছাতার সাপেক্ষে স্থির থাকবে।
সঙ্গের ছবিতে আবর্তনরত পৃথিবীর দুটি অবস্থান নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বছরের যে কোনো দুটি দিনে পৃথিবীর অবস্থান। এই দুটি অবস্থান থেকে পৃথিবীর দুইটি ভিন্ন বিন্দু A এবং B থেকে ধ্রুবতারা আর অন্য যে কোনও একটি তারাকে লক্ষ করা হচ্ছে। অন্য তারাটির দৃষ্টিরেখা (line of vision) ভায়োলেট বা বেগুনী রেখা দিয়ে আর ধ্রুবতারার ক্ষেত্রে হলুদ রেখা দিয়ে নির্দেশ করা হয়েছে। ছবিতে এটা স্পষ্ট যে বছরের যে কোনও দিনে বা একটি নির্দিষ্ট দিনের দুই সময়ে বা একই দিনে পৃথিবীর উপরস্থ একাধিক অবস্থান থেকে মহাকাশের সাপেক্ষে অন্য তারাটির অবস্থান ঠিক থাকলেও পৃথিবীর সাপেক্ষে তারা ভিন্ন হয়ে গেছে। এমনকী দিক পর্যন্ত পালটে গেছে। কিন্তু ধ্রুবতারার অবস্থান একই অর্থাৎ আকাশের একেবারে ঠিক উত্তর দিকে। কারণ পৃথিবীর অক্ষটির চারপাশে পৃথিবী ঘূর্ণিত হলেও এই রেখাটির নিজের কোনও ঘূর্ণন নেই। তাই অবস্থানের নেই কোনও পরিবর্তন। সদা সতত পৃথিবীর উত্তর আকাশে বিদ্যমান। তাই এই তারা উত্তর আকাশে সর্বদা স্থির। এই রেখার ওপর আর কোনও দ্বিতীয় তারা পাওয়া যায় নি। পেলে সেটিও ধ্রুবতারার মতই ধ্রুব হয়ে বিরাজ করত পৃথিবীর আকাশে।
ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়: বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনের (গল্প ও উপন্যাস) লেখক ও গ্রন্থকার।