বিশ্বে ORS –এর পদার্পণ এক বাঙালীর হাত ধরে!!!
ORS (Oral Rehydration Solution)- এই শব্দটার সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত, সহজ কথায় নুন-চিনির জল। যেকোনো পেটের রোগ বা ডায়রিয়া, কলেরার মত মারাত্মক রোগের অব্যর্থ ওষুধ এই ORS। কিন্তু বিশ্বব্যপী বহুল প্রচলিত এই ওষুধের ব্যবহার শুরু হয়েছিল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকেই; বছর সাঁইত্রিশের এক বাঙালী শিশুরোগ চিকিৎসক ডঃ দিলীপ মহলানবিশের হাত ধরে। এই ওষুধের প্রয়োগ আগে থেকেই চালু ছিল ইন্ট্রাভেনাস পদ্ধতিতে অর্থাৎ ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে রোগীর শিরায় প্রয়োগ করা হত। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ এবং রোগীর ক্ষেত্রে কষ্টদায়কও বটে। কিন্তু ORS শুধুমাত্র পান করার মাধ্যমে যে এই মারণ রোগগুলির মোকাবিলা করা সম্ভব তা প্রথম বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন এই চিকিৎসক।
সালটা ১৯৭১, বাংলাদেশে তখন চলছে স্বাধীনতা যুদ্ধ। ওপাড়ের লক্ষলক্ষ অসহায় মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে এইপাড়ের সীমান্ত সংলগ্ন বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পে। সেই অস্থায়ী, অস্বাস্থ্যকর শিবিরে হঠাৎ শুরু হল কলেরা। মহামারির আকার ধারণ করল অচিরেই। রাস্তাঘাটে যেদিকে দুচোখ যায় শুধুই পড়ে মানুষের লাশ। চারিদিকে রোগীদের মল আর বমির স্রোত। সমগ্র দুনিয়া সাক্ষী থাকল এক ভয়ংকর মৃত্যুমিছিলের। বনগাঁ সীমান্ত জুড়ে তখন শুধুই মানুষের হাহকার। সেইসময় ঈশ্বরের দূতের মত এসে উপস্থিত হলেন দিলীপবাবু।
কলেরা বা ডায়রিয়ার মত রোগে, রোগীর রেহ থেকে সমস্ত জল বেরিয়ে যায় মলের সাথে। ফলে দেহে জলের অভাব দেখা দেয়, সাথে নুনও বেরিয়ে গিয়ে রক্তচাপ একদম কমে যায়। এইসময় রিহাইড্রেশনই একমাত্র ওষুধ। রিহাইড্রেশন হল- চিনি বা গ্লুকোজ, নুন বা সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং বেকিং সোডা বা সোডিয়াম বাইকার্বোনেটের মিশ্রণ। এই মিশ্রণ মানুষের খাদ্যনালীতে প্রবেশ করলে, তা বৃহদন্ত্রের জলশোষণের ক্ষমতা পুনরায় ফিরিয়ে আনে, ফলে ঘনঘন মলত্যাগ বন্ধ হয় এবং রোগী প্রাণ ফিরে পায়। এই ওষুধের প্রয়োগ হত মূলত ইন্ট্রাভেনাস পদ্ধতিতে অর্থাৎ সূচ ফুটিয়ে স্যালাইনের মাধ্যমে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কাজ হতে অনেক সময় লাগত, সেই তুলনায় সরাসরি খাদ্যনালীতে প্রবেশ করাতে পারলে তা আরও কমসময়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে। পানীয়ের মাধ্যমে এটি চালু করার বিষয়ে গবেষণা চলছিল। ১৯৬৪ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ক্যাপ্টেন ব্ব ফিলিপ্স দু’জন কলেরা রোগীর উপর ORS প্রয়োগ করে সফলতা পান। কিন্তু বাজারজাত ওষুধ হিসাবে ব্যবহারের ছাড়পত্র পেতে হলে চাই আরও পরীক্ষা। সেই ছাড়পত্র পাওয়া গেল আমাদের বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়া এক বিরাট সার্বজনিক এক্সপেরিমেন্ট থেকে।
সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে দিলীপবাবু তুলে ধরেছেন তখনকার অসহায় চিত্র। ক্যাম্পে-ক্যাম্পে রোগীর ছড়াছড়ি, পা ফেলার জায়গা নেই। তারই মধ্যে তিনি ও তাঁর ৮ জন সঙ্গী, যারা নিতান্তই সাধারণ মানুষ, কোনও ডাক্তার নন; অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। ইন্ট্রাভেনাস পুশ করতে করতে একসময় ওষুধের যোগান প্রায় ফুরিয়ে এল, বাধ্য হয়ে শুরু করলেন পানীয় হিসাবে প্রয়োগ। প্রথমদিকে সরকারি মেডিক্যাল টিমের কিছুজন তাঁকে বাধা দেন, কারণ কোনও সরকারি ছাড়পত্র ছিলনা ORS ব্যবহারের। কিন্তু তিনি ব্দ্ধপরিকর। ১ লিটার জলে ২২ গ্রাম গ্লুকোজ বা চিনি, ৩.৫ গ্রাম নুন বা সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং ২.৫ গ্রাম সোডিয়াম বাইকার্বোনেট বা বেকিং সোডা- এই ফর্মুলায় মিশ্রণ বানিয়ে শুরু হল খাওয়ানো। ফলও পেলেন হাতেনাতে। আস্তে-আস্তে আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হতে শুরু করল। বড়বাজার থেকে নিজেই কিনে নিয়ে এলেন বস্তা বস্তা নুন,চিনি, সোডা। ১৬ লিটারের ড্রামে বানানো হল সলিউশন। ২৪শে জুন- ৩০শে আগস্ট একটানা চলল লড়াই; অবশেষে এল বহু আকাঙ্খিত জয়। কলেরার নাগপাশ থেকে মুক্তি পেল মানুষ। আর ইন্ট্রাভেনাসের পরিবর্ত পদ্ধতি হিসাবে সমগ্র বিশ্বে পদার্পণ করল ORS।
প্রবাদপ্রতিম এই বাঙালী চিকিৎসকের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ই নভেম্বর, অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে। দেশভাগের সময় চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে- প্রথমে বরাহনগর, পরে শ্রীরামপুর। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। ১৯৫৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পাশ করেন দিলীপবাবু, সেখানেই শিশুবিভাগে ইন্টার্নশিপ শুরু করেন। ১৯৬০ সালে লন্ডনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে সুযোগ পান, DCH ডিগ্রী করেন, এডিনবরা থেকে পান MRCP ডিগ্রী। মাত্র ২৮ বছর বয়সে Queen Elizabeth Hospital for Children-এ যোগ দেন রেজিস্ট্রার পদে; সেইসময় এই পদে তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়। এরপর আমেরিকার Johns Hopkins University-এর মেডিক্যাল কেয়ার ফেলো পদে নিযুক্ত ছিলেন বেশ কিছুদিন। ১৯৬৪ সালে দেশে ফিরে আসেন। Johns Hopkins University-এরই একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল কলকাতার বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল; কলেরা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলত সেখানে। দেশে ফিরে যোগ দেন এই হাসপাতালে। বিবাহ করেন শ্রীমতী জয়ন্তী দেবীকে। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ORS এবং Special Metabolic Studies-এর উপর গবেষণা শুরু করেন, সাফল্যও পান; কিন্তু গবেষণাপত্র বার করেননি তখনও। তারপরেই ’৭১-এ ঘটে ঐ ঘটনা; যেন খানিকটা দৈবক্রমেই পেয়ে যান তাঁর এক্সপেরিমেন্টের আদর্শ স্থান। ফলাফল অভাবনীয়।
এই এক্সপেরিমেন্টে এতবড় সাফল্য পাওয়ার পর আর দেরী করেননি দিলীপবাবু, বিশদ তথ্য দিয়ে পেপার লিখলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে “Johns Hopkins” মেডিক্যাল জার্নালে স্থান পেল তাঁর লেখা পেপার। বিখ্যাত পত্রিকা “The Lancet” স্বীকৃতি দিল এই প্রকাশনাকে। সঙ্গে-সঙ্গে এই খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা বিশ্বে, সমগ্র বিশ্বের চিকিৎসা মহল থেকে সাধুবাদ জানানো হল তাঁকে। World Health Organisation (WHO) ও UNICEF থেকে সম্মানিত করা হল তাঁকে। ১৯৮০ এর মধ্যপর্ব থেকে ১৯৯০ এর প্রথম পর্ব পর্যন্ত WHO-এর Diarrhoea Disease Control Programme-এর মেডিক্যাল অফিসারের পদ অলংকৃত করেছেন। ১৯৯০-এ বাংলাদেশে International Centre for Diarrheal Disease research-এর ক্লিনিক্যাল সায়েন্সের ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত হন। ১৯৯৪-এ Royal Swedish Academy of Sciences –এর সদস্যপদে নির্বাচিত হন। যুক্ত ছিলেন পার্কসার্কাসের Institute of Child Health –এও।
গোটা জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন, বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ২০০২ সালে আরও তিন চিকিৎসকের সঙ্গে যৌথভাবে শিশুচিকিৎসা বিভাগে প্রথম “Pollin” পুরস্কারে ভূষিত হন।২০০৬ সালে যৌথভাবে পান “Prince Mahidol” পুরস্কার। WHO-এর গণনা অনুসারে তাঁর এই অবিস্মরণীয় অবদান সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৬০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।
জনদরদী এই ডাক্তার বিজ্ঞানী শুধু এখানেই থেমে থাকেননি, জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে তাঁর আরও অবদান আছে। ১৯৯১ সালে সল্টলেকের বাড়িতে তৈরি করেন “Society for Applied Studies”। বায়োমেডিক্যাল ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিসার্চের জন্য গড়ে তোলেন এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ডাক্তারি পাশ করা নতুন ছেলেমেয়েদের হাতেকলমে গবেষনার কাজ শেখানোর জন্যই তাঁর এই অভিনব উদ্যোগ। তবে বর্তমানে সরকারী সহযোগিতার অভাবে এই সোসাইটি বন্ধের মুখে; ছাত্রছাত্রীও তেমন নেই। তবে দিলীপবাবুর বিজ্ঞান সাধনায় কিন্তু ছেদ পড়েনি। ৮৫ বছর বয়সে এসেও তিনি সক্রিয়ভাবে চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় যুক্ত। মানবসেবার যে কঠিন ব্রত তিনি নিয়েছেন, সেই তপস্যায় আজও মগ্ন বাংলার গর্ব ডঃ দিলীপ মহলানবিশ।
তথ্যসূত্রঃ
ঐন্দ্রিলা সাউ: পেশাদার বিজ্ঞান বিষয়ক কন্টেন্ট রাইটার। Amul কোম্পানি থেকে “বিদ্যাশ্রী” পদকপ্রাপ্ত।