সরীসৃপ সংবাদ – ২
গিরগিটি-সদৃশ ‘টুয়াটারা’র দেহে পাওয়া গেল দুটি বিশেষ মাইটোকন্ড্রিয় জিনোম
এর আগে আর কোনো মেরুদন্ডী প্রাণীর দেহে শীত-সহনক্ষম সহায়ক এই বিশেষ একজোড়া জিন মেলেনি
এই গিরগিটি-সদৃশ টুয়াটারা অনেক আগে থেকেই ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। দীর্ঘ শতাব্দীব্যাপী জীবৎকাল, নানাবিধ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এবং সরীসৃপ হিসেবে ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতার মতো বহু অত্যাশ্চর্য গুণাবলী দেখা যায় এই টুয়াটারার। বর্তমানে প্রকাশ পেয়েছে যে, এর জিনগত প্রকরণ এর জীবন-ইতিহাসের মতোই অদ্ভুত। এর সাহায্যেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব কীভাবে অধিক তাপমাত্রা সহ্য করে নেয় টুয়াটারা।
টুয়াটারা’র অতিরিক্ত জিন জোড়া
২৯ জানুয়ারি ‘কমিউনিকেশন বায়োলজি’তে প্রকাশিত গবেষকদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় টুয়াটারার ক্ষেত্রে দুটি বিশেষ জিনগত কাঠামো বা প্রকরণের প্রতিলিপি আছে মাইটোকন্ড্রিয়া তৈরির জন্য।
বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ ক্রিস স্নিডার (Chris Schneider) যিনি এই গবেষণায় যুক্ত নন, জানিয়েছেন ‘এটিই প্রথম দৃষ্টান্ত যেখানে মেরুদণ্ডী প্রাণীদেহে অতিরিক্ত একটি মাইটোকন্ড্রিয় জিনোমের প্রতিলিপি পাওয়া গেল’। অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদেহে একটিই মাত্র মাইটোকন্ড্রিয় জিনোমের প্রতিলিপি থাকে। মুসেল হল একমাত্র জীব যার দেহে দুটি প্রতিলিপি পাওয়া যায়।
কী এই মাইটোকণ্ড্রিয়া?
মাইটোকন্ড্রিয়া আসলে একটি ক্ষুদ্রকায় শক্তির ভাণ্ডার, এর অভ্যন্তরস্থ জিনগত উপাদান সাধারণত এর গঠনে এবং কার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে যে এই মাইটোকন্ড্রিয়ার ডি এন এ বয়োবৃদ্ধি এবং মানুষের বিপাকীয়, পেশিসম্পর্কিত কিংবা স্নায়বিক নানাপ্রকার ক্যান্সারে খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। গবেষকরা বলছেন, অন্যান্য প্রাণীর মাইটোকন্ড্রিয় জিনোম পরীক্ষা করে পাওয়া যেতে পারে মানুষের নানা রোগের গোপন প্রক্রিয়ার সূত্র।
ক্যালিফে অকল্যাণ্ডের পেরাল্টা জিনোমিক্স ইনস্টিটিউটের জিনোম-বিশেষজ্ঞ রবার্ট ম্যাকির মতে, ‘সাধারণ মানুষের ধারণায় শুধুমাত্র বয়োবৃদ্ধি আর রোগব্যাধির সঙ্গেই সম্পর্কিত নয় মাইটোকন্ড্রিয়ার জিনোম, এর থেকেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তার আছে, শীতল পরিবেশে কীভাবে প্রাণীদেহে বয়োবৃদ্ধিকে বিলম্বিত করে তা জানা গেলে মাইটোকন্ড্রিয়ার কাজ সম্পর্কে আরো তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে’।
টুয়াটারার জিন-রহস্য উদঘাটনের প্রয়াস
নিউজিল্যান্ডের ডানডিনের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনিক জীববিজ্ঞানী নিল জেমিলের ‘টুয়াটারা জিনোম প্রজেক্ট’ এর মধ্য দিয়েই ২০১২ সালে প্রথম শুরু হয় টুয়াটারার জিন-রহস্য উদঘাটনের প্রয়াস।
সেই আবিষ্কার জিনোমের মাইটোকন্ড্রিয়ার আরো গভীর অনুসন্ধানের দিকে নিয়ে গেছে গবেষকদের। ডি এন এ-র সংকেত পাঠোদ্ধার করার চেনা পদ্ধতি হল ডি এন এ-কে খণ্ডে খণ্ডে বিভাজিত করে পাঠোদ্ধার করা এবং তারপর পুনরায় খণ্ডগুলিকে বিন্যস্ত করা পূর্বের সজ্জায়। এর ফলে প্রতি একক খণ্ড অনেক স্পষ্টভাবে অবলোকন করা যায়।
এদিকে দীর্ঘ ডি এন এ-খণ্ডের পাঠোদ্ধারের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিমেষেই ম্যাকি’র গবেষণাগারে টুয়াটারার মাইটোকন্ড্রিয় জিনোমের সজ্জার সামগ্রিক গঠন দেখা সম্ভব হল। এই নতুন পদ্ধতির নাম ‘দীর্ঘ পাঠ-বিন্যাস’ (Long read Sequencing) যা কিনা নিঃসন্দেহে জিন বিন্যাসের ভবিষ্যৎ। এক নিমেষে আস্ত অণুর বিন্যাসকরণও এর দ্বারাই সম্ভব বলে ম্যাকি জানিয়েছেন।
ওয়াশিংটন ডি.সি-র স্মিথসোনিয়ান্স গ্লোবাল জিনোম ইনিশিয়েটিভ-এর আণবিক জীববিজ্ঞানী ড্যান মুল্কাহি এবং ম্যাকি যখন সেই জিনের তথ্যগুলি নিয়ে দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা করছিলেন তখন মুল্কাহি এক সম্ভাবনার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার মনে হয় দুটো মাইটোকন্ড্রিয় জিনোম রয়েছে এখানে!’
খণ্ডিত অবিন্যস্ত অংশগুলি এবং সমগ্র গঠনগত অংশ পাশাপাশি তুলনা করে এই সম্ভাবনা উঠে আসে এবং এও লক্ষ্য করা যায় যে মাইটকন্ড্রিয় ডি এন এ-র একই অংশের খণ্ড হলেও বিস্ময়করভাবে তারা জিন-বিন্যাসে সম্পূর্ণ পৃথক, যেভাবে দুই পৃথক সুরকারের হাতে একই গানের স্বরলিপি ভিন্নতা পায় তেমনই। এই ফারাক চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে গবেষকদের কপালে। সাধারণভাবে যেহেতু মায়ের ডিম্বাণু থেকেই একমাত্র মাইটোকন্ড্রিয় ডি এন এ সৃষ্টি হয়, বিজ্ঞানীরা তাই এর মধ্যে একটিমাত্র মাইটোকন্ড্রিয় জিনোম-প্রতিলিপি দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু অন্যদিকে নিউক্লিয় ডি এন এ যেহেতু পিতা-মাতা উভয়ের শুক্র ও ডিম্ব থেকেই উদ্ভূত হয়, তার মধ্যে দুটি প্রতিলিপি থাকাটাই স্বাভাবিক।
বিজ্ঞানীরা প্রচণ্ড পরিশ্রমে দুটি পূর্ণ কার্যকর মাইটোকন্ড্রিয় জিনোমকে একজোট করেন এবং অবিশ্বাস্যকর হলেও ১০.৪ শতাংশ ভিন্নতা লক্ষ্য করেন যেখানে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির মাইটকন্ড্রিয় জিনোমের ভিন্নতার সূচক ৮.৯ শতাংশ। মুল্কাহি বলেন, ‘টুয়াটারার জিনের বিন্যাস-সজ্জা একেবারেই অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মতো নয়’।
ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনোম-বিশেষজ্ঞ লারা আর্বান বিশ্লেষণ করে দেখান দুটি জিনোমের মধ্যে যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে তার মূল কারণ একটির বিপাকীয় দশা। একটি প্রাণীর কোশীয় বিপাক পরিবেশের প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করার শক্তি দেয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা দুটি মাইটোকন্ড্রিয় জিনোম হয়তো টুয়াটারার ক্ষেত্রে কোশীয় বিপাক চরম তাপমাত্রার বিপরীতে একপ্রকার নমনীয়তা তৈরি করে।
ম্যাকি জানান, ‘টুয়াটারার মাইটোকন্ড্রিয় জিনোম আমার দেখা সব থেকে জটিল ব্যাপার’। প্রাণীর বিপাকীয় উৎসগুলির জিনগত ভিত্তি অনুসন্ধানের মাধ্যমেই মাইটোকন্ড্রিয় জিনোমের কার্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে যা কিনা মানুষের নানাবিধ বিপাকীয় ব্যাধির প্রতিকারের রাস্তা দেখাতে পারে।