তাপ ও শক্তি
বাবুরা খুব গরিব। তার বাবা ভোরে তিনচাকার সাইকেল ভ্যান নিয়ে হাটে চলে যায়। সেখান থেকে কাঁচা আনাজ সবজি এসব নিয়ে এসে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে। ফেরে সেই বেলা দুটো আড়াইটের সময়। তখন পড়ে থাকে কিছু শুকনো সবজি।তাই সকালে আনাজ তেমন ঘরে থাকে না বাবুদের। মা তাড়াতাড়ি কোনোরকমে আলুভাতে আর ডাল তৈরি করে বাবুকে খেতে দেয়। বাবু স্কুলে চলে গেলে বাবুর মা কয়েক বাড়ি কাজে যায়। তা সেদিন বাবুর মায়ের উঠতে খুব দেরি হয়ে গেছে।
আগের দিন শরীর একটু খারাপ ছিল। তাড়াতাড়ি ভাত আর আলুভাতেই বেড়ে দিল বাবুকে।কিন্তু মুশকিল হল আলুভাতেটা মাখা নিয়ে। এত গরম যে হাতে ধরাই যাচ্ছে না। বাবুর যদিও বেশ আশংকা হচ্ছিল স্কুলে না দেরি হয়ে যায়। কিন্তু তবু সে মায়ের অবস্থা বুঝে এগিয়ে এল মায়ের সাহায্যে।
“দেখি মা দেখি”, বলে একটা খুন্তি নিয়ে এসে তার ধারাল দিকটা বসিয়ে আলুটা দুভাগ করে দিল। তারপর চারভাগ। এমনি করে আস্তে আস্তে কটা ভাগ করে মাকে বলল তার ওপর ফুঁ দিতে।
সামান্য একটু পরেই আলুটা ঠান্ডা হয়ে গেল আর মা সহজেই মেখে ফেলল। খুশি হয়ে বলল, “হ্যাঁরে বাবু এটা তুই জানলি কি করে রে? মুকুল কাকিমাকে করতে দেখেছিস বোধহয়?”
বাবু বলল, “না মা, এ তো আমাদের বিজ্ঞান বইতেই আছে। আসলে কি জান, এই যে আলুটাকে আমি এত ভাগ করলুম তাতে আলুর ওপর অনেকগুলো চওড়া পিঠ হয়ে গেল। বিজ্ঞানের ভাষায় এগুলোকে তল বা সারফেস বলে মা। তাপ জিনিসটা চট করে ছড়ায় যখন তার এই তল বা সারফেস অনেক বেশি হয়। কারণ তাপ শুধু ওপরের পিঠ থেকেই বাইরে ছড়ায়। যখন আলুটা গোটা ছিল তখন এর ওপরের তল খুব ছোট ছিল। যত কাটবে তত তার সারফেস বাড়বে মা। আর তত তাড়াতাড়ি সেটা ঠান্ডা হবে”
মা তো অবাক। বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক। এইজন্যেই সেদিন তোর পাঁচু জ্যাঠা সেদিন কাপের গরম চা ডিসে ঢেলে খেল। বলল তার সময় নেই কাপ থেকে চা খাবার।-পাঁচু জ্যাঠা তো ঠিকই করেছে। কাপের ওপরের সারফেস কম। ডিসে ঢাললে সেটা বেশি হয়ে যায়। আর সব জায়গা থেকে তাপ উড়ে যায় বলে চা তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়।”
মা মুগ্ধ নয়নে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,” তোর ইস্কুলের বিজ্ঞান বইতে এইসব লেখা আছে বুঝি? বিজ্ঞান খুব কাজের জিনিস বুঝি?”
“হ্যাঁ মা। বিজ্ঞান কত ভাল মা। আমাদের কত ভুল ধারণা দূর করে দেয়। আর বিজ্ঞানই তো আসল। সেই তো আমাদের সব কাজ করে দেয়। আমরা তাকে না জানলে কে জানবে বল? কেই বা তাকে সুন্দর ভাবে আমাদের কাজে লাগাবে?”
মা একটু ম্রিয়মান হয়ে বলল, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ বাবা। এসব বিজ্ঞান আমি বুঝব না। বিজ্ঞান বড় শক্ত জিনিস।”
“কিচ্ছু শক্ত নয় মা। আগ্রহ থাকতে হয়। তুমি যে সেদিন অত শক্ত সেলাইয়ের কাজটা মুকুল কাকিমাকে শিখিয়ে দিলে কাকিমাও তো কত তাড়াতাড়ি শিখে গেল। তার আগ্রহ ছিল তাই তো?”
মা মাথা নাড়ল, “তা বটে।”
“আসলে জান মা আগ্রহ আর দরকার মানে প্রয়োজন আমাদের কাছে অনেক শক্ত জিনিস সহজ করে দেয়। বল না আজ আমাকে তাড়াতাড়ি আলুভাতে মেখে ভাত দেওয়াটা তোমার দরকার ছিল কিনা? আর সেই দরকার তোমার আগ্রহ এনেছিল কিনা?
তুমি শুধু নিজেকে অশিক্ষিত ভাব তাই তুমি অশিক্ষিত। তুমি ইস্কুলে যেতে পার নি তাই বলে তুমি অশিক্ষিত হবে কেন? এমন অনেক জিনিস আমি তোমাকে বলে দিতে পারি। তোমার কাজে লাগবে। তখন তুমিও অনেক শিক্ষিত লোকের কথার জবাব দিতে পারবে।”
কথা বলতে বলতে মায়ের খুব কষ্ট হতে লাগল। আগুনের ধারে একা হাতে রান্না করা তো চাট্টিখানি কথা নয়? এদিকে খেতে বসে গরম ভাত খেতে খেতে বাবুরও সারা গায়ে ঘাম। ইলেক্ট্রিক ফ্যান তাদের বাড়ি নেই। তাড়াতাড়ি হাতপাখাটা নিয়ে নাড়তে লাগল।
“এই যে তুমি হাতপাখা নেড়ে বাতাস করছ আর আমাদের শরীর ঠাণ্ডা হচ্ছে। এর কারণ জান মা?”
মা মুখ ম্লান করে বলল, “এর আবার কি। এমনই তো হওয়ার কথা বাবা। গাছে গাছে হাওয়া বয় তাতেই আমাদের দেহ ঠাণ্ডা হয়।”
“আসলে কি জান, আমাদের শরীরে যে তাপ জমা আছে সেটা চলে গেলে শরীর ঠাণ্ডা হয়। হাওয়া যখন বয় তখন বাতাস এই তাপ আমাদের শরীর থেকে নিয়ে চলে যায়। যত হাওয়া বইবে তত তাড়াতাড়ি তাপ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাবে।”
“তাপটা কিরে বাবু? তুই জানিস? কোথা দিয়ে সে বেরিয়ে যায় আর কোথা দিয়েই বা ঢোকে?”
বাবু বলল, “তাপ তো জানার জিনিস নয় মা। বোঝার জিনিস। অনুভব করার জিনিস।”
মা বলল, “সব আমার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল বাবু। কিচ্ছু মাথায় ঢুকল না। অনুভব করার জিনিস সে আবার কি?”
বাবু হাসল, “তোমাকে বুঝিয়ে বলছি মা। এই যে গান তুমি শোন। বলতে পার গানটা কি?”
“গানটা আবার কি। গানটা মানে গান আবার কি? শুনতে ভাল লাগে তাই শুনি।”
বাবু বলল, “শুনতে ভাল লাগে। তার মানে মনের ব্যাপার তাই নয়? মানে বোঝার ব্যাপার কি বল? মানে অনুভব করার জিনিস তাই না মা? ভাল গান শুনলে মন ভাল থাকে আর খারাপ গান শুনলে মনটা খিঁচড়ে যায় কি না বল?”
মা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ রে বাবু তা যায়।”
গানকে কি দেখা যায়? কিংবা ঝুড়িয়ে রাখতে পার?”
মা এবারেও মাথা নাড়েন। তবে দুদিকে। মানে না।
“তাপটাও তেমনি জিনিস। সে শুধু বোঝা যায়। হাত দিলে তুমি বুঝতে পার”
মা আবার ঘাড় নাড়লেন, “ঠিক ঠিক।”
“তবে বলতে পারি তাপ একটা শক্তি, যেটা থাকলে কোনও জিনিস গরম হয় আর বেরিয়ে গেলে তা ঠাণ্ডা হয়। তাপকে দেখা যায় না মা। ধরাছোঁয়াও যায় না। তাপ যে একটা শক্তি।”
“বাবু তুই আবার সব গোলমাল করে দিচ্ছিস। শক্তি আবার বিজ্ঞানে থাকে নাকি রে? আর দেখা যায় না বলছিস কেন? আমাদের ভীমা দাসের গায়ে কি জোর জানিস। লোকে বলে একটা হাতির শক্তি নাকি তার। তা ভীমাকে তো দেখা যায় আর তাকে ধরাও যায় বাবা। তবে ধরতে কেউ পারে না। ধরতে গেলেই যেন গুঁতিয়ে দেয়। যা জোর গায়ে।”
বাবু বলল, “না মা ভীমা কাকুর শক্তি নয়। তবে ওর শক্তি আছে এটা ঠিক। যার শক্তি আছে সে কিছু কাজ করতে পারে। যেমন তুমি রান্না কর, আমি ইস্কুলে যাই। খাবার আমাদের এই শক্তি দেয় মা। তুমি যদি দু’দিন না খেয়ে থাক তো উঠতেই পারবে না। এই যে আমি, তুমি বা ভীমাকাকু এরা সব বস্তু কেউ শক্তি নই। আমাদের মধ্যে শক্তি থাকে আর তাই কাজ করতে পারি। যার গায়ে যত বেশি শক্তি সে তত বেশি কাজ করতে পারে। কাজই হল শক্তির মাপ।”
মা আবার একটু একটু ঘাড় নাড়েন। মানে একটু একটু মাথায় ঢুকছে যেন।
“মরা মানুষের কোনও শক্তি থাকে না তাই সে কোনও কাজও করতে পারে না। এই যে দেখছ ঠান্ডা জল ওতে চাল ফেললে ভাত হবে না মা। কারণ ওতে কোনও শক্তি নেই। কিন্তু ওকে ফোটাও চাল সেদ্ধ হয়ে ভাত হবে। ওই যে আগুন মানে তাপ সেই তাকে তখন শক্তি দেবে। কাজ করার শক্তি। শক্তিকে দেখা যায় না মা। কাজকেও দেখা যায় না। শুধু দেখা যায় কাজের ফলটাকে।”
বাবু ভেবেছিল মা খুব বিরক্ত হবে। কিন্তু মা খুব কৌতূহলী হয়ে বলল, “বা বা বেশ লাগছে। শক্তির কথা আরো কিছু বল। তাপ একটা শক্তি বুঝলুম। তার কথা আর কিছু বল বাবা।”
“আজ ইস্কুলের দেরি হয়ে যাবে মা। অন্য একদিন বলব। তোমাকে বললে আমার নিজের বোঝাটাও সহজ হয়ে যাবে। স্যার বলেছেন জ্ঞান দিলে নাকি জ্ঞান বেড়ে যায়। আমারও একটা করার সুযোগ আসবে সেটা পরীক্ষা করে দেখার।”
বাবুর কপালে চুমু খেয়ে মা ভাবতে লাগল আজ তার মনটা এত ভাল লাগছে কেন। সত্যি তো, কিছু জানার মধ্যে অনেক আনন্দ লুকিয়ে থাকতে পারে এটাই যে তার অজানা ছিল এতদিন। তার ইস্কুলে পড়া ছোট্ট ছেলেটা তার কাছে সেই কৌতূহলের দরজা খুলে দিল আজ।
ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়: বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনের (গল্প ও উপন্যাস) লেখক ও গ্রন্থকার।