Free ArticlesPhysics-পদার্থবিজ্ঞান

শব্দদৈত্যের উদ্ভব

Sound wave

আমজাদ আলির সরোদ শুনতে বসেছেন? মুগ্ধতা আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। কিংবা রবিশংকরের সেতার? আবেশে ভরে যাবে মন। এভাবেই বিভিন্ন শিল্পীদের গান, বাজনা আপনাদের মনকে পৌঁছে দেবে মুগ্ধতার এক বিশেষ মাত্রায়। লতা মঙ্গেসকর কী সন্ধ্যা মুখার্জীর গান আপনার কানে মধু ঢালে। সেই মধু পৌঁছে যায় মনের গভীরে। সৃষ্টি করে আবেশ আর পুলক। আপনি আমন্ত্রণ করেন এই শব্দকে। আবার পচা টমেটো ছোঁড়ার উপযুক্ত কোনও শিল্পীর গান আপনার কানের মধ্যে দিয়ে মনে ঢেলে দেয় চরম বিরক্তি। আপনি উঠে চলে আসতে বাধ্য হন অনুষ্ঠান ছেড়ে।

সুর কাকে বলে?

গানের এই যে শব্দ যা মনকে মোহিত করে দেয় তা হল সুর। সুর হল কোনও নির্দিষ্ট একটি কম্পাংকের শব্দ। হারমোনিয়ামের সা থেকে নি পর্যন্ত প্রত্যেকটি এক একটি কম্পাঙ্কের শব্দ। উদারা, মুদারা এবং তারা এই সুরগুচ্ছের মধ্যে উদারা হল খাদের সুর। মুদারা হল মধ্যম বা সাধারণ সুর। আর তারা হল চড়া সুর। উদারা, মুদারা বা তারার সা থেকে নি সুরগুলি একই ধরনের হলেও এদের কম্পাঙ্কগুলি গুণিতকে পরিবর্তিত হয়। যেমন ধরুণ উদারার সা যদি ২৫৬ সংখ্যার কম্পাংক বিশিষ্ট হয় তো মুদারার সা হবে এই ২৫৬ সংখ্যাটির একটি মৌলিক গুণিতক (যেমন ধরুণ ২৫৬ X ২)। আবার তারার সা হবে এই ২৫৬ সংখ্যাটির আরও উচ্চ গুণিতক (যেমন ধরা যাক ২৫৬ X ৩)।

সুর সর্বদা একটি মাত্র কম্পাংক বিশিষ্ট শব্দ নিয়ে গঠিত বলে তা হয় সুমধুর। অবশ্য সব সুর যে সর্বদা একটি মাত্র কম্পাংকের শব্দ নিয়ে গঠিত হয় তা নয়। মিশ্রও হতে পারে। যেমন ধরুণ সা এবং রে একসঙ্গে উৎপাদিত সুর অথবা সা থেকে ধা পর্যন্ত খুব দ্রুত গড়িয়ে যাওয়া (এক মাত্রার মধ্যেই)। যাঁরা সঙ্গীত চর্চা করেন তাঁরা অবশ্যই আমার থেকে ভালো জানবেন।

এটি অবশ্য সংগীত শিক্ষার প্রবন্ধ নয়। আসলে সুর জিনিসটা বোঝানোর জন্যেই এটা বলা হল। সুর জিনিসটা খুব মিষ্টি শব্দের এই গুণগত বৈশিষ্টের জন্যে। মানুষ মুগ্ধ হয়ে শোনে। তবে মন হল আসল জিনিস। মনই মুগ্ধতা আনে আর তা ধরে রাখে। আবার সেই সেটা ত্যাগও করে। তাই সবাই গান ভালবাসতে নাও পারে। আবার কেউ কেউ বেশিক্ষণ ভাল নাও বাসতে পারে।

এবার আসি স্বরের প্রসঙ্গে

বাথরুমের ছিটকিনি বন্ধ করে অনেকে কিছু গাইলেও সবার গলায় সুর নাও থাকতে পারে। কিন্তু সুস্থ গলা বা ভোকাল কর্ড বিশিষ্ট যে কোনও মানুষের গলাতে স্বর থাকবেই থাকবে। স্বর হল আমাদের সাধারণ কথাবার্তা, চিৎকার, হাসি-কান্না ইত্যাদি। স্বরের সঙ্গে সুরের পার্থক্য হল স্বরের মধ্যে একাধিক কম্পাঙ্কের শব্দ মিশ্রিত থাকে। তাই স্বর সাধারণত একটু মোটা হয় আর তার কম্পাঙ্ক সুরের থেকেও কম হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় স্বরে প্রাবল্য সাধারণত বেশি থাকে।

প্রাবল্য কথাটার মানে হল কত প্রবল শক্তিতে এই শব্দ আমাদের কানে পৌঁছে দিচ্ছে। সুরের মধ্যে শব্দের কম্পাঙ্ক অনেক বেশি হওয়ার জন্য একটি গান সাধারণ ভাবে গাওয়া হলেও তা বেশ কিছু দূর থেকে শোনা যায়। কিন্তু খুব মিষ্টি করে শোনা যায়। কারণ একাধিক কম্পাঙ্কের অনুপস্থিতি। এর সঙ্গে আবার বাদ্যযন্ত্রগুলি সমতালে কম্পিত হওয়ার ফলে শব্দের অনুরণণে কম্পাঙ্কের অনেক বৃদ্ধি হয়। সবাই হয়ত জেনে থাকবেন একটি বস্তু যখন একই সঙ্গে একাধিক সমান বা বিভিন্ন কম্পাঙ্কযুক্ত হয় তখন তার মোট কম্পাঙ্কের বৃদ্ধি ঘটে আর চূড়ান্ত কম্পাঙ্ক হিসেবে সমস্ত কম্পাঙ্কের সমষ্টি নির্ধারিত হয়। যখন হারমোনিয়াম ‘সা’ সুরটি নিঃসৃত করে আর গায়ক সেই সুরের সঙ্গে মিলিয়ে শব্দ নিঃসৃত করেন তখন হারমোনিয়াম আর গলার সুর দুই সুরের মিশ্রণে অনুরণণ সৃষ্টি হয় আর স্পষ্ট ও সুমধুর হয়।

শব্দের ‘গুণ’ বা ‘জাতি’ কাকে বলে?

শব্দের আর একটি বৈশিষ্ট হল ‘গুণ’ বা ‘জাতি’ অর্থাৎ quality। এটি বাদ্যযন্ত্রের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। আলু সেদ্ধ খাওয়া আর তাতে নুন তেল মশলা মিশিয়ে তরকারি করে খাওয়া কিন্তু এক নয়। প্রথমটির থেকে দ্বিতীয়টি অধিক সুস্বাদু। তাই দুই কম্পাঙ্ক আর বাদ্যযন্ত্রের সহযোগিতায় শব্দের কম্পাঙ্ক যেমন বাড়ে তেমনি তা আরও বেশি সুশ্রাব্য হয়। ঠিক ওইজন্যেই খালি গলায় গাওয়া গানের থেক বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গাওয়া গান অনেক বেশি সুমধুর।

অনুরণণ আর তার প্রভাব

অনুরণণ আর তার প্রভাব নিয়ে আর একটু বিস্তারণ ঘটানো যেতেই পারে। ধরুণ একটি বস্তু একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন কপাঙ্কে কম্পিত হচ্ছে। এই দুটি কম্পাঙ্কই ২৫৬ মানের। ফল হল বস্তুটি ২৫৬+২৫৬ বা মোট ৫১২ কম্পাঙ্কে কম্পিত হবে। সৈনবাহিনীকে কখনও মার্চ করতে করতে কোনও সেতু অতিক্রম করতে দেওয়া হয় না। কারণ সেতুর নিজস্ব একটি সর্বোচ্চ সহনশীল কম্পাঙ্ক আছে তার থেকে ওপরে উঠলে সেই কম্পন সে সহ্য করতে পারে না আর ভেঙে পড়ে। সেনাবাহিনী একসঙ্গে মার্চ করতে থাকলে প্রত্যেকের পদক্ষেপের কম্পন অনুরণনের ফলে সমষ্টি হিসেবে সেতুর অনুভূত হয় আর এই বিশাল কম্পন অবশ্যই তার নিজস্ব সহনশীল কম্পাঙ্কের অধিক হয় আর সেতু ভেঙে পড়তে পারে।

মাঝে মাঝে শব্দ কিন্তু এতই শক্তিমান হয়ে উঠতে পারে যে সে কোনও জিনিস স্পর্শ না করেও তাকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। ভেঙেও দিতে পারে। ভয়ানক বজ্রপাতের সময় অনেকেই লক্ষ করেছেন বাড়ির দরজা জানলা বা আলমারি কাঁপছে। মনে রাখতে হবে ভূমিকম্পে যে প্রবল কম্পন সৃষ্টি হয় তাও এই অনুরণণেরই ফল।

দেখা গেছে নারীর কন্ঠস্বর সূক্ষ্ম, সুরেলা আর সুমিষ্ট হয়। অন্য দিকে পুরুষের কন্ঠস্বর ভারি আর গম্ভীর হয়। পুরুষের কণ্ঠস্বরে প্রাবল্য বেশি থাকলেও নারীর কন্ঠস্বরে থাকে না।একটি নারীকন্ঠের চিৎকার অনেক দূর থেকে শোনা গেলেও একটু পুরুষ কন্ঠের চিৎকার অত দূর থেকে শোনা যায় না। মেয়েদের গলার কম্পাংক পুরুষের থেকে অনেক বেশি হওয়াই এর কারণ। সেইজন্যে অনেক সময় দেখা যায় মেয়েদের গলার গান বা আবৃত্তি ছেলেদের থেকে অনেক বেশি সুশ্রাব্য আর আকর্ষণীয় হয়।

স্বরের মধ্যে কম্পাঙ্কের মিশ্রতা থাকে। মনে রাখতে হবে মানুষ বা কোনও জীবিত প্রাণী ছাড়াও শব্দ উৎপাদিত হয়। গাড়ি ছোটে, কারখানা চলে, বোমা-বন্ধুক ফাটে, কামান দাগে। ঝরণা বা জলপ্রপাত উঁচু পাহাড় বা টিলার শীর্ষ থেকে মাটিতে এসে পড়ে। নদী বয়ে চলে। সাগর ঢেউ নাচায়। বাতাস ঝড় তোলে। প্রকৃতির অনেক কর্মকাণ্ডেই শব্দ তৈরি হতে পারে আর অবশ্যই হয়। এই সব কিছুতেই শব্দ উৎপন্ন হয় আর সেই শব্দ মিশ্র কম্পাঙ্কের শব্দ। কারোর ক্ষেত্রে কম কম্পাঙ্ক কারোর ক্ষেত্রে বেশি।

আগেই হয়ত বলেছি শব্দ একটি তরঙ্গ বা wave। কিন্তু এটি হল অনুদৈর্ঘ তরঙ্গ বা longitudinal wave অর্থাৎ যেদিকে কম্পন সেদিকেই এর গতি। আর এক প্রকারের তরঙ্গ আছে তা হল তির্যক তরঙ্গ বা Transverse Waves। এই বিশেষ তরঙ্গে কম্পন আর কম্পনশীল বস্তুকণার গতি পরস্পর সমকোণে থাকে। যেমন সাগরের ঢেউ। লক্ষ করলে দেখা যাবে সাগরে ঢেউয়ের জলকণা ওপরে নিচে কম্পিত হয় কিন্তু ঢেউটি এগিয়ে আসে তটের দিকে। অর্থাৎ কণাগুলির কম্পন আর ঢেউ পরস্পর সমকৌণিক।

Longitudinal & Transverse Wave | Image Source: Encyclopædia Britannica, Inc.


বিনোদনের জন্যে শব্দকে উৎপন্ন ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন গান, বাজনা আবৃত্তি ইত্যাদি। কিন্তু এই বিনোদনের উদ্দেশ্যে আর এক প্রকার শব্দ উৎপন্ন করা হয় তার কথা ভুললে চলবে না। প্রথমটা যদি শব্দদেবতা বলি তো অন্যটাকে বলতে হয় শব্দদৈত্য। শব্দদেবতা প্রাকৃতিক আর মনুষ্যসৃষ্ট দুইই হয়। মনুষ্যকৃত সঙ্গীতচর্চার কথা আগেই বলেছি। প্রাকৃতিক সুমধুর শব্দের আধার অনেক আছে। পাখির ডাক, বাতাসের শনশন আওয়াজ, নদী বা ঝরণার কলকল শব্দ, বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ ইত্যাদি।

শব্দ আবার দৈত্যের আকারেও আসতে পারে। এখানেও প্রাকৃতিক আর মনুষ্যসৃষ্ট দুই ভাবে হতে পারে। ঘন কালো আকাশ থেকে পড়া বাজের কড় কড় আওয়াজ। বিশাল জলপ্রপাতের আওয়াজ। ঝড়ের গর্জন। সমুদ্রের ফোঁস ফোঁসানি। আবার তাও হতে পারে মনুষ্যসৃষ্ট। যেমন বিকট আর বিরাট বাজনা। বাজি বা বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে হয় শব্দবাজি। যেমন পটকা, বোমা, ছোট ছোট ছেলেদের বন্দুক ক্যাপ ইত্যাদি। এরোপ্লেন বা হেলিকপ্টারের আওয়াজ। কল-কারখানার আওয়াজ, জল বা যেকোনো পাম্পের শব্দ, চলমান গাড়ির শব্দ এইসব।

শব্দবাজির সব গুলোতেই শুধুমাত্র শব্দ উৎপন্ন হয় বা শব্দ উৎপাদনের জন্যেই সেগুলো তৈরি করা হয় তা নয়। শব্দের সঙ্গে অবশ্যই থাকে আলোর ঝলকানি। এই উচ্চ শব্দ আর তীব্র আলোর ঝলকানি আনে একটা চমক আর পুলক। যে বাজির শব্দের জোর যত বেশি মনের মধ্যে বিশেষ ভাবে অল্প বয়সী মনের মধ্যে তা সৃষ্টি করে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনা আর উন্মাদনা। এখানে বাজির প্রশংসা বা নিন্দা কিছুই করা হচ্ছে না। শুধু বাজির দ্বারা কী ধরনের শব্দ হয় বা হতে পারে সেই নিয়েই বলা হল।

বাজির শব্দ অনেক কম্পাঙ্কের মিশ্রণ। এতে প্রাবল্যও থাকে প্রচুর। তাই বিশাল একটা শক্তিতে সে আঘাত করে আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ে। এত বিশাল যে কল্পনা করা যায় না। সাধারণত শিশু, মহিলা আর বয়স্কদের শ্রবণেন্দ্রিয়গুলি খুব সংবেদনশীল হয়। কানের কাছে একটি পটকা ফাটলে যে কোনও মানুষেরই কানে তালা ধরে যায়। কানের বহু অংশ আছে। বর্তমানে সে প্রসঙ্গে বিস্তারিত না গিয়েও বলা যায় আমাদের শরীরে কোনও কাজই স্নায়ুতন্ত্র ছাড়া হয় না। কানেও রয়েছে শ্রবণ, স্নায়ু বা অডিটরি নার্ভ। খুব জোরে পটকা ফাটলে এই স্নায়ুগুলি সাময়িক ভাবে অবশ হয়ে যায় আর পরবর্তী কোনও শব্দের অনুভূতিকে মস্তিষ্কে পৌঁছে দিতে পারে না। এটিকে কানের একটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধও বলা যায়। একটু পরে অবশতা কাটিয়ে উঠলে অবশ্য কান আবার ঠিক হয়ে যায়। তবে এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে শব্দ যদি শব্দদৈত্যের আকারে আসে তবে কানের স্থায়ী ক্ষতিও হতে পারে।

যে শব্দ প্রকৃতি উৎপাদন করছে তাতে হয় আমাদের কোনও হাত নেই। যেমন আমরা চেষ্টা করলেও উস্রির ঝরণা বা নায়েগ্রা ফলসের শব্দের মাত্রা কমিয়ে আনতে পারি না। কিংবা নিয়ন্ত্রিত করতে পারি না সাগরের উত্তাল ঊর্মিমালার কলরোল। কিন্তু যে শব্দ মানুষ তৈরি করছে তার নিজের প্রয়োজনে তাকে নিয়ন্ত্রিত করতেই পারি। তাই শব্দবাজিকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে একটা নির্দিষ্ট ডেসিবেল সীমার মধ্যে। উড়োজাহাজের ভেতরের যাত্রীদের প্রবল শব্দের অত্যাচার থেকে রেহাই দিতে ব্যবহার করা হয়েছে সাউন্ড প্রুফের। শুধু মনে রাখতে হবে সব কিছুতেই লাগাম একটা পরাতে হয়। লাগাম না পরালে সামান্য একটা ঘোড়াও হয়ত পক্ষীরাজ হয়ে উঠতে পারে। সেই পক্ষীরাজ আপনার ক্ষতি করবে না উপকার করবে তা কিন্তু ঠিক করে সময় আর পরিস্থিতি।


ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়: বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনের (গল্প ও উপন্যাস) লেখক ও গ্রন্থকার।