সবুজ চা ও ফ্যাশ্ন্ দুনিয়া
আধুনিক ফ্যাশ্ন্ দুনিয়ায় দুটি মূলমন্ত্র হল ওজনহ্রাস (slimming) ও ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষা (Skin care)। আর এই দুই এর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সবুজ চা (Green tea) এর প্রসঙ্গ। তবে এই কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সবুজ চা কোনো নব আবিষ্কৃত চা-এর ভ্যারাইটি।আর্কিওলজিকাল কার্বনডেটিং পদ্ধতির সাহায্যে জানা গেছে যে আজ থেকে পাঁচ লক্ষ বছর আগেও সবুজ চা জলে ফোটানোর প্রচলন ছিল।
সারা পৃথিবীতেই তরল পানীয় হিসাবে জলের স্থান যে প্রথম ও অদ্বিতীয় এই কথা অনস্বীকার্য। তবে দ্বিতীয় স্থানটি যার দখলে নিঃসন্দেহে সেটি হল চা। দৈনিক পানীয় হিসাবে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে চায়ের বোধ হয় কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিকতম হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বে চায়ের বার্ষিক উৎপাদন 2.5 মিলিয়ন টন। আর এই সমগ্র উৎপাদনের 20% হল সবুজ চা। আসুন দেখি কী এই সবুজ চা – কী এর পার্থক্য আমাদের চিরপরিচিত কালো চা-পাতার সঙ্গে।
আসলে কিন্ত কালো বা সবুজ, দুই চা-পাতারই উৎস এক। উভয়েই ‘ক্যামেলিয়াসিনেনসিস’ গাছের পাতা। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? সেটা হল প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতির পার্থক্য। কালো চা-পাতা গাছ থেকে তোলার পরে সূর্যের কড়া তাপে শুকিয়ে নিয়ে তার পর ফ্যাক্টরিতে এর প্রক্রিয়াকরণ শুরু হ্য়। আর সবুজ চা এর ক্ষেত্রে গাছ থেকে সদ্য তোলা পাতা সরাসরি উত্তপ্ত করা হয় বাষ্প দ্বারা (Steaming) বা প্যানফ্রাই পদ্ধতিতে। এর ফলে পাতায় অবস্থিত একটি বিশেষ উৎসেচক (enzyme) ভেঙ্গে যায়। (এই উৎসেচকের কাজ হল পাতা যখন দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যের তাপে শুকোতে থাকে, যেটা করা হয় কালো চা-পাতার ক্ষেত্রে, এই উৎসেচক ধীরে ধীরে পাতার সবুজ রঙ (green pigment) কে ভেঙ্গে ফেলে)। কাজেই স্টিমিং বা প্যানফ্রাইপদ্ধতিতে শুষ্ক করার সময় ঐ বিশেষ উৎসেচকের অনুপস্থিতির ফলে সবুজ পাতার রঙ অপরিবর্তিত থাকে।
এবার ফিরে আসি আধুনিক জীবনযাত্রায় সবুজ চায়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গে। সবুজ চায়ের প্রধান তিনটি উপাদান হল ক্যাটেসিনস (catechins), ক্যাফিনস আর থিয়েনিনস। এ ছাড়াও প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত সরল ও কম তাপমাত্রায় হওয়ার দরুন ভিটামিন- B, C, A & E এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি রক্ষিত (intact) থাকে কালো চা-পাতার তুলনায়। আর আছে স্বল্প পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড ও বিটা-ক্যারোটিন।
সবুজ চায়ের উৎকৃষ্টতা ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার মূল উৎস হল এই ক্যাটেসিনস উপাদান। ক্যাটেসিনস হল বিভিন্ন পলিফেনল আর ট্যানিনস (polyphenol & tanins) এর সমন্বয়, যার ফলে সবুজ চা একাধিক গুণের অধিকারী। যেমন, দেহের অতিরিক্ত ফ্যাটকে ধবংস (burns fat) করে দেহের ওজন হ্রাসে তৎপরতা; অ্যান্টিঅক্সিড্যানট ও অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল হিসাবে কাজ করা; দাঁতের ক্ষয়রোধ করার ক্ষমতা; নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধদূরীকরণ ইত্যাদি নানান আকর্ষণীয় গুণের অধিকারী। সবুজ চাপাতার নির্যাস (extract) অতি কার্যকরী অ্যান্টিঅক্সিড্যানট। অনেক নামিদামি কসমেটিক কোম্পানিই তাদের “স্কিনকেয়ারপ্রোডাক্টস” এ সবুজ চাপাতার নির্যাস ব্যবহার করে। তাই কসমেটিক দুনিয়ায় এই সবুজ চায়ের খুব কদর ও চাহিদা।
দ্বিতীয় উপাদান ক্যাফিনস হল শক্তিশালী উদ্দীপক (Stimulant)। দেহের ক্লান্তি ও অবসাদ দৃর করতে এর জুরি নেই। ‘দিনের শেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে ঘরে ফেরার পরে এক কাপ গরম ও সুগন্ধী চা’, আহা, এর কোনো তুলনা হয়?
এবার আসি তৃতীয় উপাদান থিয়েনিনের কথায়। এটি এমন একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড যা চা ছাড়া আর কোনো খাদ্যবস্তুর মধ্যে পাওয়া যায় না। চায়ের আকর্ষণী শক্তি যে ‘ফ্লেভার’(flavour), তা প্রদান করে এই থিয়েনিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিডটি।
এছাড়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভিটামিন B, C, A & E থাকার ফলে সবুজ চা-এ খাদ্যগুণ ও আছে। আর ডায়াবেটিকদের জন্য সুখবর – সবুজ চায়ের পাতায় চিনির শতকরা পরিমাণ শূণ্য।
তবে প্রিয় পাঠকবৃন্দ… শুধু গুণপনার কথা বলেই আমার সবুজ চায়ের বৃত্তান্তে ইতি টানছিনা। কিছু সাবধানতার প্রসঙ্গে এবার আসছি। মনে রাখা দরকার, বিশেষ করে অতি দ্রুত ওজন হ্রাস ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির তাড়নায় অতি উৎসাহী ও উচ্চাকাঙ্খী মহিলা/পুরুষ উভয়ের উদ্দেশ্যেই এই সাবধান বাণী – “মাত্রাতিরিক্ত সবুজ চা পান থেকে বিরত থাকুন।”
খুব বেশি পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিড্যানট এর উপস্থিতি এবং অপেক্ষাকৃত কম ক্যাফিনস থাকার কারণে সবুজ চা অবশ্যই একটি স্বাস্থ্যকর পানীয়। কিন্ত অপর দিকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সবুজ চা-এর উপাদানে যে ট্যানিনস যৌগগুলি আছে সেগুলি প্রতিদিনের খাবারের ( daily diets) আয়রনের সঙ্গে এক রকমের স্থায়ী ও জটিল যৌগ তৈরি করে। এর ফলে রক্তে হিমোগ্লোবিন (আয়রণ ও গ্লোবিন নামক প্রোটিনের একটি স্থায়ী জটিল যৌগ)-এর পরিমাণে ঘাটতি হতে থাকে, শরীর শিকার হয় ‘lron deficient anaemia’ রোগের। ক্রমবর্ধমান সবুজ চায়ের প্রতি আসক্তির কারণে বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে এই রোগের বিস্তার বেশ উদ্বেগজনক। এছাড়াও অতিরিক্ত সবুজ চা পানের একাধিক সাইড এফেক্ট – নিদ্রাহীণতা, অকারণেবিরক্তি (irritability), রক্তের উচ্চচাপ ইত্যাদি। তবে উপরোক্ত সমস্ত উপসর্গগুলিই ঘটে মাত্রাতিরিক্ত সবুজ চা পানে।
এই প্রসঙ্গে আবার একটি উল্লেখযোগ্য ও আশাপ্রদ পর্যবেক্ষণের কথা বলিঃ-
“March 2005 Edition of the American Journal of Clinical Nutrition” এর একটি দীর্ঘ পরীক্ষালব্ধ পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে …. দীর্ঘ দিন নিয়মিত ও পরিমিত সবুজ চা পানের ফলে শরীরে একটি ‘ডিফেন্স মেকানিজম’ তৈরি হয়। কীভাবে? যারা দীর্ঘ দিন নিয়মিত ও পরিমিত চা পান করেন তাদের মুখের লালায় (saliva) অতিরিক্ত পরিমাণ PRP (proline rich protein) নিঃসৃত হয়। এই PRP সবুজ চা-এর একটি প্রধান উপাদান ট্যানিনস (অবাঞ্ছিত সাইড এফেক্টগুলির জন্য দায়ী) কে বন্দি করে ফেলে একটি স্থায়ি জটিল যৌগ গঠণের মাধ্যমে। এর ফলে শরীর অতিরিক্ত ট্যানিনস-এর প্রভাব মুক্ত হয়।
পরিশেষে তাই বলি ওজন হ্রাসে আগ্রহী ও ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষায় যত্নশীল মহিলা/পুরুষ সকলে সবুজ চা পান করুন, তবে ধীরে। নিয়মিত ও পরিমিত পরিমাণে। নচেৎ ফল হবে বিপরীত। সৌন্দর্য লাভের পরিবর্তে হবেন হতাশ ও রোগগ্রস্ত।
ড. অঞ্জনা ঘোষ: বিজ্ঞান লেখিকা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অজৈব রসায়নে পিএইচডি | বর্তমানে অশোক হল বালিকা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সিনিয়র বিভাগ)-এর শিক্ষিকা।