স্মরণীয় বাঙালি গণিতজ্ঞ শ্রীধর আচার্য
সাধারণ বাঙালি অনেক গণিতজ্ঞকে স্মরণ করতে না পারলেও বাংলার শ্রেষ্ঠ দুই গণিতজ্ঞকে কোনোদিনও ভুলতে পারবে না।এক হলেন “গণিত শিল্পী” কেশব চন্দ্র নাগ আর অপরজন প্রাচীন বাংলার শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ, মহান দার্শনিক শ্রীধর আচার্য। কিংবদন্তি কেশব চন্দ্র নাগ বা কে.সি.নাগের অসাধারণ গণিতের বইগুলি বাংলার ঘরে ঘরে সমাদৃত হয়ে আছে বহুযুগ ধরে।তাঁর বইয়ের কঠিন অঙ্কগুলি যেমন অনেক ছাত্রের মনকে তাড়া করে বেরিয়েছে ঠিক তেমনি প্রতিটা অধ্যায়ের প্রতিটা অঙ্কের একাধিক পদ্ধতিতে সমাধান করার নমুনা এবং অনুশীলনীতে বিভিন্ন ধরণের অঙ্ক করতে দিয়ে ছাত্রকে গাণিতিক জগতের অবাধ বিচরণের দ্বার উন্মুক্ত করেও দিয়েছে।কে.সি.নাগের হোক বা যেকোনো প্রাক-মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের গণিতের বইয়ে পাঠ্য ‘দ্বিঘাত সমীকরণ(Quadratic equation)’-এর সমাধানের জন্য যাঁর আবিষ্কৃত অনবদ্য সূত্রটির কথা মনে পড়ে তিনি আর কেউই নন এক হাজার বছর আগেকার আমাদের এই বাংলার এক কিংবদন্তি গণিত পন্ডিত ‘শ্রীধর আচার্য’।তিনি আমাদের এই বাংলারই মানুষ ছিলেন যা আমাদের পরম গৌরবের বিষয়। এবার আলোকপাত করা যাক তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে।
আমরা সকলেই জানি যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে প্রাচীন ভারতবর্ষের এক উচ্চস্থানে বিরাজমান ছিল। মিশরীয় সভ্যতা,গ্রীক সভ্যতা ইত্যাদি আরও প্রাচীন সভ্যতার মতোনই ভারতীয় সভ্যতাও প্রাচীনযুগে গণিতের জগতে এক বিশাল উন্নতিলাভ করেছিল।এই প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও গণিতবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘শ্রীধর আচার্য’।এই শ্রীধর আচার্য ‘শ্রীধরাচার্য’ বা ‘শ্রীধর’ নামেও পরিচিত ছিলেন।এখানে উল্লেখ্য যে,‘শ্রীধর ভট্ট’ নামে আরও একজন ব্যক্তির নাম জানা যায়, কিন্তু তিনি ও শ্রীধর আচার্য একই ব্যক্তি কিনা সে বিষয়ে মতভেদ আছে।গণিতজ্ঞের পাশাপাশি তিনি ছিলেন প্রাচীন দার্শনিক,ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ, বিজ্ঞানী এবং সংস্কৃত পণ্ডিত। তিনি দশম শতাব্দীর শেষভাগে খুব সম্ভবত 991 খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।যদিও কারোও মতে তিনি 750 খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন আবার অন্য একদলের মতে তাঁর জীবনকাল 870-930 খ্রিষ্টাব্দ।তবে বেশিরভাগ পন্ডিতের মত অনুসারে তাঁর জন্ম সাল হিসেবে 750-930 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ধরে নেওয়া হয়েছে।
তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুকাল নিয়ে সংশয় যেমন ছিল ঠিক তেমনি সংশয় ছিল তাঁর বাসস্থান নিয়েও।অনেকের মতে তিনি বঙ্গের আবার কারুর মতে তিনি অষ্টম শতকে দক্ষিণ ভারতে জন্মগ্রহণ করেন।যদিও বেশিরভাগ পন্ডিতের মতে তাঁর জন্মগ্রহণ গঙ্গার পশ্চিম তীরে রাঢ় অংশের দক্ষিণ রাধা (যা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা)-র ভূরিশ্রেষ্ঠী(ভূরিসৃষ্টি বা ভূরশুট)গ্রামে।তা যাইহোক,বেশিরভাগ পন্ডিতের যা মত অর্থাৎ তিনি প্রাচীন ভারতের বঙ্গদেশেই জন্মেছিলেন গ্রহণ করলে আমরা বাংলার মানুষ এক পরম আনন্দে মেতে উঠি।তাঁর জন্ম হয় একবার ব্রাহ্মণ পরিবারে।তাঁর পিতার নাম বলদেব শর্মা বা বলদেব আচার্য এবং মাতার নাম অচ্ছোকা দেবী।
এখানে উল্লেখ্য যে, তাঁর পিতাও ছিলেন একজন সংস্কৃত পণ্ডিত যাঁর কাছে দূরদূরান্ত থেকে ছাত্ররা শিক্ষালাভ করতে। বালক শ্রীধরও তাঁর পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।কিন্তু পরে শ্রীধর কোথায় বিদ্যা শিক্ষা শেষ করেন সে ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি।শ্রীধর আচার্য মহর্ষি গৌতম ও মহর্ষি কণাদের লেখা শ্লোকের ব্যাখ্যা বা ভাষ্য দিয়েছিলেন।আগেই বলা হয়েছে যে, তিনি ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ তাই ন্যায়শাস্ত্র নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণা রয়েছে যার ফসল রূপে আমরা পাই ‘ন্যায়কন্দলী’।এই গ্রন্থটি আনুমানিক 991 খ্রিষ্টাব্দে প্রশস্তপাদ রচিত পদার্থধর্মগ্রন্থের টীকা হিসেবে রচিত।এই গ্রন্থে তিনিই প্রথম বৈশেষিক দর্শনের আস্তিক্য ব্যাখ্যা করেন।
প্রাচীনকালের লেখকরা তাঁদের মধ্যে বংশ পরিচয় দিয়ে গেছেন। শ্রীধরও তাঁর ‘ন্যায়কন্দলী’ বইয়ে এ সম্পর্কে কিছুটা উল্লেখ করে গেছেন।আসলে,দক্ষিণ রাঢ়ের রাজা এবং পান্ডুভূমি-বিহারের প্রতিষ্ঠাতা পান্ডুদাস ছিলেন শ্রীধর আচার্যের পৃষ্ঠপোষক,যাঁর আশ্রয়ে থেকে শ্রীধর ন্যায়কন্দলী রচনা করেন। এতে
এই ‘ন্যায়কন্দলী’ যে তাঁর রচনা সে ব্যাপারে যদিও অনেকে পণ্ডিতের সন্দেহ ছিল তবুও দবিবেদী মহাশয়ের মতে শ্রীধর বা শ্রীধর আচার্য ‘ন্যায়কন্দলী’-র প্রণেতা ছিলেন।আরও জোরালো প্রমাণ এই যে,ন্যাইয়কন্দলীর রচয়িতা শ্রীধরের বসবাস দক্ষিণ রাঢ়ের ভূরিসৃষ্টি বা ভূরশুট গ্রামে ছিল।আর কি সন্দেহের অবকাশ থাকে? আর এই উক্ত তথ্যই জানিয়ে দেয় যে মহাদার্শনিক শ্রীধর ও গণিতজ্ঞ শ্রীধর একই ব্যক্তি যা অনেকেই মনে করেন।গণিত বিষয়ক দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন যা নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে।
গণিতের জগতে শ্রীধর আচার্য-এর অবদান
খুব সম্ভবত 1020 খ্রিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত ভাষায় গণিতের এক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার নাম ‘পাটীগণিতসার’ বা ‘গণিতসার’।এই গ্রন্থটিকে ‘ত্রিশতিকা’ নামেও ডাকা হয় কারণ এখানে আর্যাছন্দে তিনশোটি শ্লোক আছে বলে।এই বইটিতে সংখ্যা গণনা(counting of numbers), পরিমাপ(measures), প্রকৃত সংখ্যা (natural numbers),শূন্য(zero), গুণন (multiplication), ভাগ(division), বর্গ(square), বর্গমূল(square root),ঘন(cube), ঘন মূল(cube root), ভগ্নাংশ(fraction), তিন-এর নিয়ম(rule of three), সুদকষা(interest calculation), অংশিদারিত্বের ব্যবসায়(joint business or partnership) এমনকি পরিমিতি (Mensuration) নিয়ে যেমন ক্ষেত্রফল(area) ও আয়তন(volume) নির্ণয় সহ আরও অনেক গণিতের বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিষয় শ্লোকের আকারে আলোচনা করা আছে।উক্ত গ্রন্থটিতে বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের নিয়ম দেওয়া হলেও গোলকের পৃষ্ঠক্ষেত্রফলের নির্ণয় দেওয়া নেই।
অপর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি তিনি রচনা করেছিলেন তা হল ‘পাটীগণিত’।প্রাচীন ভারতীয় আচার্যদের মধ্যে শ্রীধর আচার্যের ‘শূন্য(0)’ সম্পর্কে ব্যাখ্যাগুলি সবচেয়ে বিশদ,যথাযথ,প্রাঞ্জল এবং চমৎকারও বটে।বর্তমান যুগের আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ অর্থাৎ ‘কম্পিউটার’ তৈরিই করা যেত না যদি আমাদের শূন্য সম্পর্কে বিশেষ ধ্যান-ধারণাই না থাকত। ‘ত্রিশতিকা’র একটি শ্লোকে তিনি লিখেছেন যে, “যদি শূন্য কোনো সংখ্যা বা রাশির সাথে যোগ করা হয় তবে সংখ্যাটি একই থাকবে; যদি শুন্য কোনো সংখ্যা থেকে বিয়োগ করা হয় তবে সংখ্যাটি অপরিবর্তিত থাকবে; যদি শুন্য দিয়ে গুণ করা হয় কোনো সংখ্যাকে তবে গুণফল শূন্য হবে।”ধরি একটি সংখ্যা ‘a’ তাহলে শ্লোকটির সাংকেতিক বা গাণিতিক অর্থ দাঁড়ায় এরকমঃ-
a+0=a; a-0=a; 0xa=0; ax0=0.
এই শ্লোকটি সম্পর্কে বেলজীয়-মার্কিন রসায়নবিদ এবং ঐতিহাসিক জর্জ সার্টন(31শে আগস্ট 1884-22শে মার্চ 1956) সাহেবের মত যা তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘Introduction to the history of Science’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ও 589 পৃষ্ঠায় তা হল-‘সংস্কৃত ভাষায় শূন্যের গুণ ও তাৎপর্য সম্বন্ধে সবচেয়ে পরিষ্কার ও প্রাঞ্জল আলোচনা।’
তবে,এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে শ্রীধর আচার্য কোন রাশি বা সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে বা শুন্যকে কো্নো রাশি দিয়ে ভাগ করলে কি ফললাভ করা যাবে তা নিয়ে আলোকপাত করেননি।বহুবছর বাদে দ্বাদশ শতাব্দীতে মহর্ষি ভাস্করাচার্য বলেছিলেন যে কোনো রাশিকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হবে অনন্ত রাশি যা বলাবাহুল্য অনির্দিষ্ট(undefined)আর আমরা তো সবাই জানি যে,শূন্যকে কোনো রাশি দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল শূন্যই হবে।এক্ষেত্রে বলে নিই যে,ভাস্করাচার্য শূন্য দ্বারা ভাগ করা নিয়ে আলোকপাত করে শুন্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান শ্রীধর আচার্যের মতো আরও সমৃদ্ধশালী করে তুললেও তিনি কিন্তু তাঁর রচিত গণিত বিষয়ক গ্রন্থে শ্রীধরের বীজগণিতের অনেক নিয়ম গ্রহণ করেছেন যা দুর্ভাগ্যবশত শ্রীধর আচার্যের প্রতি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা স্বীকার বা নামোল্লেখ না করে এই ব্যাপারটি আমাদের দুঃখিত করে।
তা যাইহোক, এবার আমরা আলোচনা করব শ্রীধর আচার্যের পাই(π) সম্পর্কিত গবেষণা নিয়ে।এর আগে প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আর্যভট্ট পাই-এর মান চার দশমিক স্থান অবধি নির্ভুল বের করেন। কিন্তু অনেক পন্ডিতের মতে, উক্ত মানটি সঠিকভাবে নির্ণয় করার উপায় নেই।কারণ আর্যভট্ট যেকোনো বৃত্তের পরিধি (circumference) ও ব্যাস(radius)-এর অনুপাত যা একটি ধ্রুব সংখ্যা 22/7 ধরে পাই-এর মান বার করেছিলেন।কিন্তু 22 কে 7 দিয়ে ভাগ করলে ভাগশেষ কি শূন্য হয়? তাই শ্রীধর আচার্য পাই-এর মান √10 হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন।√10-এর আনুমানিক বা আসন্ন মান(approximate value) হল 3.16227766017 ।বর্তমানে আমরা সবাই জানি যে পাই-এর আনুমানিক মান হল 3.14159265359। শ্রীধর আচার্যের আমলে আধুনিক যুগের ক্যালকুলেটার ছিল না কিন্তু তাঁর গনণা করা পাই-এর সংখ্যার মান আপাতভাবে সঠিক বলাই যায় কারণ এর সাথে আসল পাই-এর মানের ফারাক অতি অল্প।
শ্রীধর আচার্য তার লেখার মাধ্যমে পাটিগণিত ও বীজগণিতের প্রয়োগের দিকটিও তুলে ধরেছিলেন।ভগ্নাংশের ভাগের ক্ষেত্রে তিনি লক্ষ্য করেন ভাজক(divisor)-এর সাথে সাথে ভগ্নাংশটিও বৃদ্ধি পেতে থাকে।এজন্য তিনি কোন ভগ্নাংশকে ভাগ প্রসঙ্গে ভাজকের অন্যোন্যক(reciprocal ) দ্বারা গুণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন।তিনিই প্রথম বীজগণিতকে পাটীগণিতের থেকে আলাদা করেন।তিনি যে দ্বিঘাত সমীকরণের তত্ব আবিষ্কার করেন তা আজও সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা শিখছে এবং প্রয়োজন মতো প্রয়োগ করছে।শ্রীধর আচার্য দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানের যে সূত্র আবিষ্কার করেন তার জন্য তিনি বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে আছেন কারণ তাঁর দেওয়া সমাধান সূত্রটি বীজগণিত তথা গণিত এমনকি বিজ্ঞান জগতের এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে আছে।দ্বিঘাত সমীকরণ বলতে আমরা সেইরকম সমীকরণকেই বুঝি যার অজ্ঞাত রাশির সর্বোচ্চ মাত্রা(exponent) দুই হবে।অর্থাৎ একটি আদর্শ দ্বিঘাত সমীকরণ হলঃ-
যেখানে a-এর মান 0 হবে না বা a≠0।
শ্রীধর আচার্যের দেওয়া ফর্মুলা বা সূত্র ধরে আমরা অজ্ঞাত রাশি x এর মান নির্ণয় করতে পারি।এবার দেখা যাক, শ্রীধর আচার্যের সূত্র কিভাবে আহরণ করা বা ‘derive’ করা যায়ঃ-
ধরে নিই যে, দ্বিঘাত সমীকরণটি হল-
ax2 + bx + c = 0
উভয় দিকে 4a দ্বারা গুণ করলে পাই,
4a2x2 + 4abx + 4ac = 0
উভয় দিক থেকে 4ac বিয়োগ করলে পাই,
4a2x2 + 4abx = – 4ac
উভয় দিকে যোগ করলে পাই,
4a2x2 + 4abx + b2= – 4ac + b2
[যেহেতু, (m + n)2 m2 + 2mn + n2 ] অতয়েব,
(2ax + b)2 = b2 – 4ac
ধরি, b2 – 4ac = D
তাহলে, (2ax + b)2 = D
উভয় দিকে বর্গমূল করে পাই,
2ax + b = ± √D
অথবা,
এবার, উভয় দিকে 2a দ্বারা ভাগ করলে পাই,
x = {- b ± √(b2 – 4ac)}/2a
শেষের এই সমীকরণটি যা x-এর মান নির্ণয় করছে তা ‘শ্রীধর আচার্যের সমীকরণ (Sridhar Acharya equation)’ নামে পরিচিত।
এইভাবে, আমরা x-এর দুটো মান(values) বা দ্বিঘাত সমীকরণের ক্ষেত্রে যাকে মূল(roots) বলে তা নির্ণয় করতে পারি।এখানে উল্লেখযোগ্য যে,‘D’-কে বলা হয় ‘পৃথায়ক (discriminant)’।
এখানে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যেকোনো দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানের ক্ষেত্রে আমরা শ্রীধর আচার্যের সূত্রটি ব্যবহার করে থাকি। দ্বিঘাত সমীকরণের মাত্রা নির্ণয়ের তাঁর এই সূত্রটি তাঁর নামানুসারে ‘শ্রীধর আচার্যের উপপাদ্য’ নামেও প্রচলিত।তবে জানা যায় যে,দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধান সম্পর্কে শ্রীধর আচার্য একটি বই লিখেছিলেন যা দুর্ভাগ্যবশত নিখোঁজ হয়ে যায়।গণিতের ইতিহাসে দ্বিঘাতসহ সমীকরণ সমাধানের ক্ষেত্রে তিনি প্রথম কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম একজন।
মনে করা হয় যে, তিনি অন্তত আরও তিনটি গ্রন্থ রচনা করেন যেগুলোর নাম ‘বীজগণিত’, ‘নবশতি’ এবং ‘বরাহপতি’।এই তথ্য পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞদের যেমন দ্বিতীয় ভাস্কর-১১৫০ সালের কাছাকাছি লেখা থেকে, মাক্কিভট্টের-১৩৭৭ সালের কাছাকাছি লেখা থেকে এবং রাঘবভট্টের-১৪৯৩ সালের লেখা থেকে। ভাস্করাচার্য শ্রীধর রচিত ‘বীজগণিত’ গ্রন্থটির উল্লেখ করলেও শ্রীধরের এই বিষয়ক কোনো গ্রন্থ আবিষ্কৃত হয়নি।হতেও পারে যে তিনি বীজগণিত গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন যা দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানের গ্রন্থটির মতো হারিয়ে গেছে।
মহান দার্শনিক শ্রীধর আচার্যের রূপে
আগেই বলা হয়েছে ন্যায়কন্দলীর কথা।দর্শনের উপর তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল ‘অদ্বয়সিদ্ধি’, ‘তত্ত্ববোধসংগ্রহটীকা’, ‘শ্রীধরপদ্ধতি (যা জাতকখন্ডের গ্রন্থ)’ ইত্যাদি।
নিঃসন্দেহে শ্রীধর আচার্যকে বলা যায় মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তাঁকে শুধু সংস্কৃত পণ্ডিত নয় বরং বলা যায় মহাপণ্ডিতজ্ঞ।আর বলা যায় তাঁকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ, ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ এবং বিজ্ঞানী।তিনি ইংরেজ বা ইউরোপীয়দের আগমনের বহুকাল আগে এমনকি সুলতানরা ভারত আক্রমণের আক্রমণের আগে জন্মেছিলেন। জানা যায় যে, তিনি মহারাজ মহীপাল দেবের সমসাময়িক।তথাপি গণিত তথা বিজ্ঞান জগতে তাঁর অপরিসীম অবদান, তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা প্রাচীন বাংলার তথা ভারতের গণিত ও বিজ্ঞানচর্চার গরিমাকেই প্রকাশ করে তোলে। তাঁর চমৎকার সব আবিষ্কারগুলি শুধু বাংলার মানুষ তথা আপামর বাঙালিকেই নয় বরং গোটা ভারত উপমহাদেশকে গৌরবান্বিত করে এবং সেই সঙ্গে গোটা বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে।
আসলে বলতে কি, বাংলার তথা ভারতের ইতিহাসে গুপ্তযুগের মতো পালযুগকেও বলা হয় ‘ক্ষণজন্মা’ কারণ এই সময় বাংলার তথা ভারতের বৌদ্ধিক,বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর সারা বিশ্বজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করেছিল আর তার সৌজন্যেই ছিল বাংলা তিন কৃতি সন্তান মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর,আয়ুর্বেদশাস্ত্রজ্ঞ ও পণ্ডিত চক্রপাণি দত্ত এবং গণিতজ্ঞ ও পন্ডিত শ্রীধর আচার্য।
ইন্দ্রনীল মজুমদার: বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর, বর্তমানে বিজ্ঞান লেখক।