Biography-জীবনীFree Articles

প্রাচীন বাংলার চিকিৎসাবিজ্ঞানী চক্রপাণি দত্ত

chakrapani-dutta

আমরা সবাই জানি যে প্রাচীন ভারত জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক সুপরিচিত পীঠস্থান হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে গর্বিত ছিল। প্রাচীন ভারতের সেই উজ্জ্বল সময় অঙ্গরাজ্য বঙ্গদেশও যে পিছিয়ে ছিল না তার প্রমাণ হিসেবে সাক্ষী রয়েছে ইতিহাসের পাতা। বঙ্গদেশের বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে রয়েছে বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শরীরতত্ত্ববিদ, সংস্কৃত পণ্ডিত ও আয়ুর্বেদিক সুচিকিৎসক চক্রপাণি দত্তের নাম। চক্রপাণি দত্ত চিকিৎসক হিসেবে এতোটাই বিখ্যাত ছিলেন যে অনেক দূর থেকে রোগীরা চিকিৎসার জন্য তাঁর কাছে আসতেন। তিনিও সারাদিন আনন্দ সহকারে রোগীদের চিকিৎসা করতেন আর অবসর সময় গ্রন্থ রচনা করতেন।

এভাবেই কাটত বাংলার এই প্রাচীন চিকিৎসকের দিন। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ রোগনিদানবিদদের মধ্যে অন্যতম। গ্রন্থ রচনাতেও তিনি ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতোই পারদর্শী। প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে তাঁর রচিত তিনটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলি হলঃ- ‘চিকিৎসাসংগ্রহ’, ‘দ্রব্যগুণ’ এবং ‘সর্বসারসংগ্রহ’। উল্লিখিত গ্রন্থগুলির মধ্যে প্রথমটিকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ মৌলিক বৈদ্যক (আয়ুর্বেদ) গ্রন্থ যা ‘চক্রদত্ত’ নামে প্রসিদ্ধ। এই গ্রন্থে তিনি চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এতে চরকন্যাস, বৃদ্ধসুশ্রুত ইত্যাদি কয়েকটি লুপ্তপ্রায় প্রাচীন আয়ুর্বেদগ্রন্থের বিশেষ বিশেষ অংশ বা শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাঁর রচিত ঔষুধ সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘মুক্তাবলী’। একসময় বিভিন্ন জায়গায় চক্রপাণি দত্তের রচিত গ্রন্থগুলি খুব জনপ্রিয় ছিল।

এতো গেলো চিকিৎসাশাস্ত্রের জগতে চক্রপাণি দত্তের রচিত গ্রন্থের কথা। এবার আসি টীকাকার হিসেবে তাঁর অবদানের কথায়। তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রের টীকাকার হিসেবেও খুব খ্যাতি ছিল। চক্রপাণি বিশ্ববিখ্যাত ‘চরকসংহিতা’-র উপর ‘চরকতত্ত্বপ্রদীপিকা’ এবং ‘সুশ্রুতসংহিতা’-র উপর ‘ভানুমতী’ নামক দুইখানি পাণ্ডিত্যপূর্ণ টীকা রচনা করার জন্যে যথাক্রমে ‘চরকচতুরানন’ ও ‘সুশ্রুতসহস্রনয়ন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। মাধব-নিদানের উপরও তাঁর টীকা পাওয়া গেছে।

চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও চক্রপাণি ব্যাকরণ ও ন্যায়দর্শন সম্পর্কিত গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। তাঁর একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ হল ‘ব্যাকরণতত্ত্বচন্দ্রিকা’। জানা যায় যে, মহর্ষি গৌতম (গোতম বা অক্ষপাদ) রচিত ন্যায়সূত্রের ওপর তিনি একটি টীকা রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত একটি কোষগ্রন্থের নাম ‘শব্দচন্দ্রিকা’। তখনকার দিনে একটি কোষগ্রন্থ রচনা করা এক নিঃসন্দেহে কঠিনতম কাজ।

এবার আলোচনা করা যাক চক্রপাণি দত্তের জীবন নিয়ে। ঐতিহাসিকদের মতে একাদশ শতকের শেষভাগে উত্তরবঙ্গের গৌড় অঞ্চলে তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। আবার অনেকের মতে তাঁর জন্ম বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত ময়রেশ্বর গ্রামে। তাঁর লোধ্রবলী কুলীন বংশ ছিল বলে মনে করা হয়। তবে তাঁদের আদি নিবাস ছিল বরেন্দ্রভূমের এক গ্রামে এবং সেখানেই তিনি জীবনের পরবর্তীকালে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর আবির্ভাবের সময় বাংলায় পাল রাজাদের শাসনকাল ছিল। ষোড়শ শতকের টীকাকার শিবদাস সেনের মতে তাঁর পিতা নারায়ণ দত্ত ছিলেন গৌড়রাজ নয়পাল (যাঁর রাজত্বকাল আনুমানিক 1040-70 খ্রি. আবার অনেকের মতে 1038-54 খ্রি.)-এর সমসাময়িক এবং তাঁর রন্ধনশালার অধ্যক্ষ। চক্রপাণির গুরু ছিলেন নরদত্ত।

শুরুতেই বলে নিই যে চক্রপাণি দত্ত জীবনে রাজতন্ত্রের অনেক উত্থান ও পতনের সাক্ষী ছিলেন। অন্য রাজার দ্বারা যদি নিজের রাজ্য আক্রান্ত হয়-এই ভয় রাজাকে যেমন কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে দেখেছিলেন তেমনি দেখেছিলেন সিংহাসনের অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্য রাজা তাঁর ভাইদের কারাবন্দি করতে। এবার ফিরে আসি চক্রপাণি দত্তের ছেলেবেলায় যখন গুরুগৃহে যাবেন সেই সময়টাতে। সেইবার রাজ্যের প্রতিটা মানুষ বড়োই আনন্দে মেতে উঠেছিল। এই আনন্দে মেতে ওঠার কারণ হল এই যে কলচুরি বংশীয় চেদিরাজ কর্ণ বা লক্ষীকর্ণ গৌড় আক্রমণ করে দখল করতে এলে প্রথমে সাফল্য লাভ করলেও পরে পারেননি, তাঁকে পরাস্ত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু সবাই আনন্দে যোগ দিলেও যোগ দিলেন না স্বয়ং সম্রাট নয়পাল। তিনি চিন্তিত এবং কিছুটা আতঙ্কিত ছিলেন, কারণ কিছুদিন আগে লক্ষীকর্ণ গৌড় আক্রমণ করে রাজাকে অপদস্থ করেন। যদিও লক্ষীকর্ণ পরাস্ত হয়ে ফিরে গেছেন তবুও চিন্তা হয় যে তিনি যদি ভবিষ্যতে দ্বিগুণ শক্তি সঞ্চয় করে আবার আক্রমণ করেন, তখন কী হবে? এইসব চিন্তার দরুন সম্রাট নয়পাল তাঁর গুরুদেব প্রখ্যাত বৌদ্ধ তত্ত্বাচার্য অতীশ দীপঙ্করের স্মরণাপন্ন হন। রাজার বয়স হয়েছে তাই বোধহয় চেদিরাজের সঙ্গে যুদ্ধ নয় বরং শান্তিস্থাপন করতে চাইছিলেন। তাঁর পিতা প্রথম মহিপালের অনেক প্রচেষ্টার ফলে পাল বংশের হারানো গৌরব কিছুটা ফিরে পাওয়া গিয়েছিল। তবে আপ্রাণ চেষ্টা করেও রাজেন্দ্রচোল ও গাঙ্গেয় দেবকে আটকাতে পারেননি। গুরুদেব অতীশ দীপঙ্কর কখন আসবেন?-এই ভেবে রাজা যখন পথ চেয়ে বসেছিলেন তখন রাজচিকিৎসক, রন্ধনশালার অধ্যক্ষ নারায়ন দত্ত তাঁর বালক পুত্র চক্রপাণি দত্তকে নিয়ে হাজির হলেন। নারায়ণ দত্ত জানালেন যে তাঁর বালক পুত্র গুরুগৃহে যাবার পূর্বে রাজার আশীর্বাদ চাইতে এসেছে। বৃদ্ধ রাজা নয়পাল আসন ছেড়ে উঠে বালকের মাথায় চুম্বন করলেন এবং তাকে কাছে টেনে নিয়ে বিখ্যাত চিকিৎসক হওয়ার আশীর্বাদ করলেন। বালক চক্রপাণি দত্তকে রাজা সর্বশাস্ত্র বিশারদ হওয়ার আশীর্বাদ করেছিলেন। রাজা আপনমনে বলেছিলেন যে পাল সাম্রাজ্যের গৌরব সূর্য অস্তমিত। দেশের দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে তাই রাজা অন্তর থেকে আশা রাখছেন যে এই নব প্রজন্মই পারবে পাল সাম্রাজ্যের গৌরবকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি আরও আশা করেছিলেন যে, ‘বালক চক্রপাণি দত্ত যখন পূর্ণতা অর্জন করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে, একজন সুচিকিৎসক হয়ে ফিরে আসবে আর ততোদিন যদি সম্রাট জীবিত থাকেন তাহলে যেন সে উপযুক্ত চিকিৎসক হিসেবে সম্রাটের পাশে এসে দাঁড়ায়’।

তখন গুরুগৃহে পড়াশোনা করতে হতো। তাই সাত বছর ধরে বালক চক্রপাণি দত্ত গুরুগৃহে চিকিৎসাশাস্ত্র শিখে যবে ফিরে এলেন ততদিনে নয়পাল পরলোকে গমন করে গেছেন। তাঁর জায়গায় সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁর পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপাল। চক্রপাণি দত্ত তাঁর বৃদ্ধ পিতা নারায়ণ দত্তকে কাজ থেকে অবসর দিয়ে নিজের চিকিৎসাশাস্ত্র শুরু করলেন এবং সম্রাট তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজসভায় তাঁর পিতার আসনে বসলেন। সম্রাট তৃতীয় বিগ্রহপাল চক্রপাণি দত্তকে আরও জ্ঞানার্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠালেন। তখন

মগধ (এখনকার বিহারের পাটনা ও গয়া জেলা) ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থান। দেশ-দেশান্তরের ছাত্ররা সেখানে যেতেন শিক্ষালাভ করতে। চক্রপাণি দত্ত গেলেন মগধে। সেই সময় আমাদের দেশে তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, ও দন্তপুরী ও সারনাথ-এইসব ছিল পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। চক্রপাণি দত্ত বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় গেলেন শিক্ষালাভের জন্যে। তারপর তিনি সারাদেশ পরিভ্রমণ করেছিলেন। মানুষকে জেনেছিলেন, জেনেছিলেন মানুষের ভিতরে থাকা শরীর নামক যন্ত্রকে আর সেই যন্ত্রকে কিভাবে ঠিক রাখতে হয় তাও অধ্যয়ন করেছিলেন। আরও কত কি বিদ্যা অর্জন করেছিলেন কে জানে?

অবশেষে সম্রাট তৃতীয় বিগ্রহপালের সাদর আমন্ত্রণে দেশে ফিরলেন। কিন্তু দেখলেন যে, রাজ্যের অবস্থা ভালো নয় কারণ নানান জায়গায় বিদ্রোহ দেখা দিচ্ছে যা তৃতীয় বিগ্রহপাল সর্বশক্তি দিয়ে দমন করতে পারছেন না। বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র বা রাজ্য গঠিত হয়েছিল। এছাড়াও বাইরের প্রদেশ থেকেও আক্রমণ নেমে আসে যেমন কর্ণাটকের চালুক্যরা বঙ্গদেশে আক্রমণ করে গৌড়ের কিয়দংশ এবং কামরূপ অঞ্চল দখল করে নেয় এবং প্রায় এই সময়েই উড়িষ্যার রাজা বঙ্গের গৌড় এবং রাঢ় অঞ্চল দখল করে নেয়। অবশেষে এই দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে কষ্টে ও হতাশায় 1064 খ্রি. সম্রাট এই ইহলোক ত্যাগ করেন।

এরপর শুরু হল সিংহাসন নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব। আর তা শুরু হওয়ার ফলে সম্রাট তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল কুচক্রীদের পরামর্শক্রমে তাঁর অপর দুই ভাই রামপাল আর শূরপালকে কারাবন্দি করে নিজে সিংহাসনে সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হলেন। এর ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের সামন্তরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সম্রাট দ্বিতীয় মহীপাল তা দমন করার জন্যে সামন্তদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। আর এই সুযোগে বরেন্দ্র অঞ্চলের উচ্চাভিলাষী দিব্য কৈবর্ত বরেন্দ্রভূমিতে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবে বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। দেশের এই করুণ অবস্থা আর সহ্য করতে পারলেন না চক্রপাণি দত্ত তাই আর গৌড়ে থাকতে নারাজ হয়ে সেই অঞ্চল ত্যাগ করে তাঁর আদি নিবাস বরেন্দ্র ভূমের গ্রামে চলে এলেন। সেখানে গিয়ে আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণা শুরু করেন।

চক্রপাণি দত্ত ছিলেন অনেক প্রতিভার অধিকারী। এর আগে সংস্কৃত, সাহিত্যে ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এবার আসি রসায়নবিদ হিসেবে তাঁর অবদানের কথায়। চক্রপাণি দত্ত একজন বিশিষ্ট রসায়নবিদও ছিলেন। তিনি সম্ভবত পারদ-গন্ধকঘটিত লবণ (Mercury Sulphide) কজ্জলী বা রসপর্পটি আবিষ্কার করেন। তিনি সম্ভবত প্রথম ঔষধ হিসেবে কজ্জলীর ব্যবহার প্রচলন করেছিলেন। তাঁর ভাই ভানুও ছিলেন তাঁরই মতোন অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোগনিদানবিদ, আয়ুর্বেদশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং সুচিকিৎসক।

একাদশ শতাব্দীর একদম শেষে বা দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুতে এই বিখ্যাত চিকিৎসক,সুপ্রসিদ্ধ আয়ুর্বেদশাস্ত্র বিশারদ ও গবেষক, মহাপণ্ডিত রসায়নবিদ চক্রপাণি দত্তের তিরোধান হয়।

আমরা বাঙালি তাই প্রাচীন বাংলার এই কৃতি চিকিৎসককে নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই গর্ব করা উচিৎ। প্রাচীনকালে এঁরাই বাঙালি জাতির নাম-যশ ও বৌদ্ধিক, বৈজ্ঞানিক সত্তাকে দেশ ও দশের কাছে তুলে ধরে বাঙালি জাতি তথা বঙ্গভূমিকে গৌরবান্বিত করেছিলেন। তাই বাঙালি চিকিৎসক, বিজ্ঞানী তো বটেই এমনকী আম-বাঙালিরও উচিৎ আত্মবিস্মৃতির সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া এইসব উজ্জ্বল হীরেগুলিকে স্মরণ করা।


ইন্দ্রনীল মজুমদার: বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর, বর্তমানে বিজ্ঞান লেখক।