কোনো বস্তুকে ফেলার গল্প
‘প্রফেসর বালক’ ওরফে ‘প্রফেসর বালকৃষ্ণ হাজরা’-কে তো আমরা সবাই চিনি। তিনি তো আমাদের পাড়াতেই থাকেন।তা সেইদিন আমার বন্ধু সুমিত আমাদের বাড়ীতে এসেছিল।সুমিত আমার ক্লাসমেট।তা আমি ওকে নিয়ে প্রফেসর বালকের বাড়িতে গেলাম। এবার গল্পের ছলে বলি সেদিনকার বিজ্ঞানের গল্প।
প্রফেসর বালক তাঁর আরাম কেদারায় বসে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’ (Principia) গ্রন্থটি পড়ছিলেন। আমাদের দেখে খুশি হলেন এবং বললেন, “কেমন আছ?” আমি বললাম, “ভালই আছি। আমার স্কুলের বন্ধু সুমিত আপনার কথা শুনে,আপনার কাছে গল্প শুনতে এসেছে। ওর বিজ্ঞান খুব ভালোলাগে।” সুমিত বিজ্ঞানী কাকুকে প্রণাম করলেন। বিজ্ঞানীকাকু হেসে বললেন, “ভালো আছো তো?” সুমিত উত্তর দিল, “হ্যাঁ।” আমি বললাম, “আপনি কেমন আছেন?” বিজ্ঞানীকাকু বললেন, “আমি তো ভালোই আছি। আজকে এই অবসর সময় আমার এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানীবন্ধু উইলিয়াম স্মিথ ও তাঁর স্ত্রীর দেওয়া স্যার আইজ্যাক নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া (Principia)’ গ্রন্থটি পাঠ করছিলাম।”
বিজ্ঞানীকাকুকে আমি বললাম, “আজকে বিজ্ঞানের এক মজার গল্প শোনান।বিজ্ঞান মানে আপনার কাছে তো গল্পই।”
সুমিত চমকে উঠল।বোধহয় বেচারীর “বিজ্ঞান তো আপনার কাছে গল্পই”- এই কথাটি বোধগম্য হয়নি।
আমি বললাম, “আচ্ছা বিজ্ঞানীকাকু, আমি দেখেছি যে যখন দুটো বস্তু ফেলা হয় যার ভর (mass) বেশি, সেই আগে পড়ে…….”
বিজ্ঞানী কাকু আমাকে থামিয়ে হেসে বললেন, “সবসময় তা হয় না। বায়ুশূন্য (vacuum) যেখানে, সেখানে দুটো দুরকম ভরের বস্তু একই সময় পড়বে। প্রথমত জানতে হবে, কোনো বস্তু উপর থেকে নীচে পড়ে কেন? নীচে পড়ে কারণ পৃথিবী ওই বস্তুটিকে নিজের কেন্দ্রের দিকে বা নিজেরই দিকে এক বল দিয়ে টানছে বলে। এই বলটিকে বলা হয় ‘অভিকর্ষ’। ইংরেজ এবং মার্কিনরা বলে ‘gravity’। তা যাই হোক, অভিকর্ষ নামক বল (force)- এর জন্য কোনো বস্তু মাটিতে পড়ে।
আরেকটা বল কাজ করে এই মহাবিশ্বে যার ফলে এক বস্তু অপর বস্তুকে আকর্ষিত করে। বিজ্ঞানের গল্পের যে আকর্ষণের জন্যে তোমরা যেমন আমার কাছে এসেছ সেইরকমই আকর্ষণ। এই আকর্ষিত বলটিকে বলে ‘মহাকর্ষ (gravitation)’। এইসবই স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) সাহেবের আবিষ্কার।এখন আমরা আলোচনা করব ‘বস্তুকে ফেলার ইতিহাস’। বহুকাল আগে গ্রীক বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটেলের(৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ধারণা ছিল যে, ‘দুটি বস্তু যাদের ভর (mass) আলাদা, ওপর থেকে ফেলে দিলে, দুটো বস্তুই একই সঙ্গে মাটিতে পড়বে না। ভর যার বেশি সেই আগে মাটিতে পড়বে।’ ভারী বস্তু মাটিতে পড়ে কারণ বাতাসের যে প্রতিরোধ (resistance) তা ভারী বস্তুর বেলায় কম,হালকা বস্তুর বেলায় বেশি।
আমরা বাতাসের এক মহাসমুদ্রে বাস করি। কিন্তু বায়ুশূন্যতায় (in vacuum) দেখা যায় দুরকম বস্তুই একই সময়ে একই সাথে পড়ছে। গ্যালিলিও অ্যারিস্টটলের অমৃতবাণী ভুল প্রমাণ করার জন্যে ইতালির বিখ্যাত ‘পিসার হেলানো মিনার (leaning tower of Pisa)’(১৩৬০ সালে যার নির্মাণ শেষ হয়)-এর ওপরে উঠে সেখান থেকে দর্শকদের সামনে ভর আলাদা, ভেতরকার বস্তু (constituent materials), কাঠামো (structure and size) আলাদা এমন দুটি বস্তুকে ফেলে দেন এবং দুটি বস্তু সমান সময় মাটিতে পড়ে।তিনি এভাবে প্রমাণ করেন যে, দুটি পতনশীল বস্তুর ভর (mass), ভার (weight) আলাদা হলেও একই সময় মাটিতে পড়বে। অর্থাৎ গ্রাভিটির জন্যে vacuum-এ দুটি বস্তু একই সময় পড়বে, যদি তাদের স্থির (rest) অবস্থা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এটি প্রমাণিত করার জন্য অ্যারিস্টটলের অনুগামীরা তাঁর ওপর চটে যান।শুধু প্রমাণ করেই গ্যালিলিও ক্ষান্ত হননি। তিনি কয়েকটি নিয়ম লিখে গিয়েছিলেন, যার নাম ‘laws of falling bodies’ বা ‘পতনশীল বস্তুর ধর্ম’। এখানে বলা হচ্ছে যেঃ-
১) বায়ুশূন্যতায়, সমস্ত বস্তু স্থির অবস্থা থেকে সমপরিমাণ দূরত্বে নেমে আসে,
২) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, পতনশীল বস্তুটির বেগ পতনের সময়ের সাথে আনুপাতিক (Directly Proportional) হবে।
৩) যে পথ ধরে পতনশীল বস্তুটি নেমে আসে তা সময়ের বর্গ (square of the time)-র সাথে আনুপাতিক।
ধরে নেওয়া যাক, পতনশীল বস্তুর বেগ v cm/sec
(v সেন্টিমিটার প্রতি সেকেন্ড) ও সেটি h cm(h সেন্টিমিটার) পথ ধরে নেমে আসে t সময়ে।তাহলে, দ্বিতীয় নিয়ম অনুসারে,
v ∝ t
আর তৃতীয় নিয়ম অনুসারে,
h ∝ t2
তাহলে এই গেল পতনশীল বস্তুর নিয়ামাবলী। স্যার আইজ্যাক নিউটন প্রথম নিয়্মটি প্রমাণের জন্য একটি পরীক্ষা চালান যার নাম ‘Guinea-feather experiment’ (গিনি ও পালক পরীক্ষা)। Guinea (গিনি) হল প্রাক্তন বৃটিশ স্বর্ণমুদ্রা আর feather মানে পালক তা তো জানোই।নিউটন কি করলেন জানো?তিনি একটি কাছের নল (Glass tube)-এ গিনি ও পালক ফেললেন, দেখা গেল গ্লাস টিউবে বায়ু থাকাকালীন গিনিটি আগে পড়েছিল,পরে পালক।পরে, নল থেকে হাওয়া বার করে দিলে দেখা গেল, দুটোই একই সময়ে পড়ল।”
গ্যালিলিওর সেই বিখ্যাত পিসার হেলানো মিনারের উপর পরীক্ষার চিত্র (সূত্রঃ-https://fallingobjects.weebly.com)
প্রফেসর বালক থামলেন, আমি বললাম, “তাহলে আমরা জোর গলায় বলতে পারি যে বায়ুশূন্য অবস্থায় অভিকর্ষ সমস্ত বস্তুকে (হাল্কা, ভা্রী যাই হোক না কেন) সমবেগে সমসময় পড়তে সাহায্য করে, যদি তারা উভয়েই একই জায়গা থেকে স্থির অবস্থা থেকে পড়ে।”
প্রফেসর বালক বললেন, “একদমই ঠিক। তাহলে দেখলে তো, বুঝলে তো, কোনো বস্তুকে ফেলার গল্প।আজকের পর্ব এখানেই শেষ, আবার এসো কিন্তু।”
আমরা বললাম, “নিশ্চয়ই।”
সুমিত বলল, “বিজ্ঞানের গল্প শোনার মজাই আলাদা, জয় বিজ্ঞানের জয়।”
ইন্দ্রনীল মজুমদার: বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর, বর্তমানে বিজ্ঞান লেখক।