Free ArticlesPopular Science-জনপ্রিয় বিজ্ঞান

সোপি ওয়াটার

Soapy-water-preventing-corona

চারিদিকে করোনা ভাইরাসের করাল গ্রাস অনুভব করা যাচ্ছে। এই করাল গ্রাস থেকে বাচঁতে নানান ধরনের সর্তকতাও অবলম্বন করা হচ্ছে যার মধ্যে অন্যতম হলো হাত ধোয়া। একটা সময় সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুলে যাদের শুচিবায়ুগ্রস্ত বলা হত বা টিভির অ্যাডে ব্যঙ্গ করা হত ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে বা বলা ভালো বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী তারাই হয়ে উঠেছে আজকের রোল মডেল। তাই, চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শে সবাইকে বারবার হাত ধুতে হচ্ছে সাবান দিয়ে বা বারবার ব্যবহার করতে হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এর ফলে, বাজারে সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা এখন তুঙ্গে। এমনকী, এদের যোগানেও টান পড়েছে।

তাই এ কথা মাথায় রেখে বিশেষজ্ঞদের মত হল সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ভালো বিকল্প হতে পারে ‘সোপি ওয়াটার’। বাংলায় একে বলা যায় ‘সাবান যুক্ত জল’ বা একধরনের তরল সাবান। বিশ্বের অনেক জায়গাতেই বিশেষত অনুন্নত দেশগুলির প্রত্যন্ত গ্রামে হাত ধোয়ার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। এইসব দেশগুলিতে তো বটেই এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও স্কুল, বাজার, দোকানপাট সহ বিভিন্ন জায়গায় সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। তাই, মূলত মানুষের মধ্যে হাত ধোয়ার অভ্যাস বাড়াতে ও সাবানের অধিক মূল্য থেকে বাঁচতে 2008 সালে কেনিয়ার একটি স্কুলে এবং পরে পেরুতে সোপি ওয়াটারের ব্যবস্থা চালু হয়। তারপর সহজেই প্রস্তুত করা যায় হাত ধোয়ার এই ব্যবস্থাটি সারাবিশ্বে এমনকী পড়শি বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এবার জেনে নেওয়া যাক, সোপি ওয়াটার জিনিসটা ঠিক কী? নামেই রয়েছে ‘সোপি’ অর্থাৎ ‘সাবানযুক্ত’। সহজ কথায় বলা যায় সোপি ওয়াটার হল ডিটারজেন্ট(গুঁড়ো সাবান) ও জলের মিশ্রণ। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি-র গবেষকদের মতে বাজারে পাওয়া যায় যেকোনো ডিটারজেন্ট দিয়েই বানানো যেতে পারে সোপি ওয়াটার। ওই গবেষণা সংস্থার এনভায়রনমেন্টাল ইনটারভেনশন ইউনিটির প্রকল্প সহায়ক মো. মাহবুবুর রহমান একটি ইন্টারভিউতে জানিয়েছেন যে গবেষণায় দেখা গেছে যে, সোপি ওয়াটার অন্যান্য সাবান বা লিক্যুইড সোপ যেভাবে কাজ করে ঠিক সেভাবেই কাজ করে বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসবের থেকে বেশি ভালো কাজ করে। এমনকী কমদামি গুঁড়ো সাবানগুলোও বেশি ভালো কাজ করে। আসলে, গুঁড়ো সাবানগুলোতে ক্ষারের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। যার ফলে, গুঁড়ো সাবান ভাইরাসের বিরুদ্ধে বেশি ভালো কাজ করে।

সোপি ওয়াটার বানানোর পদ্ধতি খুবই সহজ। ঘরে বসেই খুব কম সময় ও খুব কম খরচে অনায়াসেই বানিয়ে ফেলা যায় এই সোপি ওয়াটার। বাংলাদেশের গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি-র সহকারী বিজ্ঞানী নুহু আমিনের এই সোপি ওয়াটারের ওপর একটি ভিডিও দেখে আমাকে বাড়িতে সোপি ওয়াটার বানাতে বড়োই অনুপ্রাণিত করে বা উদ্বুদ্ধ করে। সোপি ওয়াটার তৈরি করার জন্য একটি 1.5 L (দেড় লিটার)-এর জলভর্তি বোতল লাগবে। কানায় কানায় জলভর্তি না থাকলেও বোতলের গলা পর্যন্ত যেন ভর্তি থাকে। বাজারে পাওয়া যায় যেকোনো কোম্পানির বা ব্র্যান্ডের ডিটারজেন্ট। একটি ফানেল বা ফিল্টার পেপার লাগবে। এই ফানেল বা ফিল্টার পেপার যদি না পাওয়া যায় তাহলেও কোনো চিন্তা নেই, যেকোনো কাগজকে ফিল্টার পেপারের আকারে বানিয়ে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়া, একটি চায়ের চামচ লাগবে। বোতলের ছিপির মাঝখানে আগে থেকে একটা ছিদ্র করে রাখতে হবে। প্রথমে, বোতলের মুখে ফানেল বা ফিল্টার পেপারটি রাখতে হবে। এরপর 4 চামচ( 30 গ্রাম বা পুরো চার চামচে ক্ষেত্রে 40 গ্রাম নেওয়া যেতে পারে তবে বেশি নেওয়া ভালো) ডিটারজেন্ট নিয়ে জলের সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার ফিল্টারের জন্যে ব্যবহৃত ফানেল বা ফিল্টার পেপারটি সরিয়ে বোতলে ছিপিটা আটকে দিতে হবে এবং ছিপির মাঝখানের ছিদ্রটিকে আঙুল দিয়ে চেপে, বোতলটিকে ধরে ভালোভাবে ঝাঁকাতে হবে।এভাবে, সোপি ওয়াটার রেডি হয়ে গেল। আমি ব্যক্তিগতভাবে 500 mL (500 মিলিলিটার)-এর বোতলে সোপি ওয়াটার বানিয়েছিলাম। সেক্ষেত্রে এক চামচ ও একটু বেশি ডিটারজেন্ট নিয়েছিলাম। কেউ চাইলে 250 mL (250 মিলিলিটার)-এর বোতলে সোপি ওয়াটার বানাতে পারেন। সেক্ষেত্রে এক চামচের একটু কম ডিটারজেন্ট লাগবে।

আসলে, দেড় লিটার বোতলে সোপি অয়াটার বানাতে যদি 30 গ্রাম ডিটারজেন্ট নেওয়া হয় তবে সেক্ষেত্রে জলের আয়তন অনুযায়ী ডিটারজেন্ট নেওয়া যেতে পারে 1 লিটারের জন্য 20 গ্রাম এবং 500 মিলিলিটারের জন্য 10 গ্রাম আর 250 মিলিলিটারের জন্য 5 গ্রাম। এভাবেই, চার চায়ের চামচ যদি 1.5 লিটার বোতলে নেওয়া হয় তবে দু’চামচের বেশি প্রায় তিন চামচের কাছাকাছি ডিটারজেন্ট লাগবে 1 লিটারের ক্ষেত্রে এবং এক চামচের একটু বেশি ডিটারজেন্ট লাগবে 500 মিলিলিটারের ক্ষেত্রে আর এক চামচের একটু কম ডিটারজেন্ট লাগবে 250 মিলিলিটারের ক্ষেত্রে। আসলে দেড় লিটারের ক্ষেত্রে ধরে নিয়ে ইউনিটারি মেথড বা ঐকিক নিয়ম অনুযায়ী কত গ্রাম বা কত চামচ ডিটারজেন্ট নিতে হবে অর্থাৎ কত পরিমাণ লাগবে তা বুঝতে পারা যাবে। তবে বিজ্ঞানী নুহু আমিন আমায় জানান যে, এই করোনা মহামারীর সময় একটু বেশি ডিটারজেন্ট নেওয়া ভালো সাবধানতামূলক হিসেবে। 500 মিলিলিটারে ফেনা সাবানের তুলনায় কম হবে কিন্তু এই সোপি ওয়াটারের কার্যক্ষমতা বা ফলপ্রসূতা (efficacy) বেশি হবে।

এবার আসি হাতে নেওয়া বা ডিসপেন্স করার ব্যাপারে। বোতলের ছিপির মাঝে খুব সহজেই ছিদ্র করে নিয়ে ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া, বাজার থেকে স্প্রে কিনে বোতলের মুখে লাগিয়ে খুব সহজেই সোপি ওয়াটার ব্যবহার করা যাবে। আর এই পদ্ধতিটি খুবই সুবিধাজনক আর এতে সোপি ওয়াটার নষ্ট হয় না এবং খুব ভালোমতনভাবে পুরো হাতের মধ্যে নেওয়া যায়। এছাড়া, ডিসপেন্সারের মাধ্যমেও প্রয়োজনমতো ডিসপেন্স করতে পারেন। ব্যবহারের আগে সোপি ওয়াটারের বোতলটিকে ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। তবে স্প্রে লাগালে ঝাঁকানোর কোনো দরকার নেই।

এবার জেনে নেওয়া যাক কোন কোন জায়গায় সোপি ওয়াটার ব্যবহার করা উচিত বা করা যায়। বাড়ির বেসিনে বা বাথরুমে সোপি ওয়াটার রাখা যায়। এখন ঘন ঘন হাত ধুতে লাগবে তাই সোপি ওয়াটার খুবই কাজে লাগবে।সোপি ওয়াটার সেই সমস্ত জায়গায় দেওয়া দরকার যেখানে লোক সমাগম বেশি এবং হাত ধোয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। সেজন্য বিভিন্ন বাজার, গারমেন্টস ইত্যাদি জায়গায় সোপি ওয়াটার ব্যবহার করা যেতে পারে। বিভিন্ন দোকানপাট, শপিংমল এমনকী বস্তিতে যেখানে সাবান রাখার সমস্যা বা সাবান চুরি যাওয়ার ভয় থাকে সেখানে সোপি ওয়াটার খুবই কার্যকরী। হাসপাতাল, ডাক্তারের চেম্বার যেখানে বিভিন্ন রুগীরা আসেন সেখানে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সাবান প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করতে হয়। তাই, সেখানে সোপি ওয়াটারের ব্যবহার খুবই প্রয়োজন। বিশেষ করে,এখন যখন ডাক্তার, স্বাস্থকর্মী ও রুগী সব পক্ষই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে রয়েছেন তখন সোপি ওয়াটার দ্বারা বারবার হাত ধোয়া যেতেই পারে। প্রয়োজনমতো সোপি ওয়াটার খুব সহজেই রিফিলিং করা যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, সোপি ওয়াটার সাবানের মতোই কাজ করে।আবার এতে ক্ষারের পরিমাণ বেশি থাকার দরুন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সাবানের চেয়েও বেশি ভালো কাজ করে। এই তরল সাবান খরচ ও সময়-দুটোই বাঁচায়। এই মুহূর্তে যখন গোটা বিশ্ব নোভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে তখন হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে সোপি ওয়াটার একটি ভালো বিকল্প অস্ত্র হয়ে উঠুক।


ইন্দ্রনীল মজুমদার: বিজ্ঞানে স্নাতকত্তোর, বর্তমানে বিজ্ঞান লেখক।