Popular Science-জনপ্রিয় বিজ্ঞান

সুদূরের এক উপগ্রহ টাইটান

ছোট শব্দ টাইটান। মানে অনেক। কখনও কোন ক্ষমতাবান, বড় পদ-মর্যাদার মানুষ। কখনও সিনেমা। হতে পারে বানিজ্যিক কোম্পানির কোন উৎপাদিত বস্তু। আবার কখনও পৌরাণিক চরিত্র। গ্রিক পুরাণে টাইটানের কথা আছে। তিনি মহাকাশের দেবতা। ইউরেনাস (আকাশ) আর গেইয়ার (পৃথিবী) সন্তান।

আমাদের আলোচনায় অন্য টাইটান। তার অবস্থান মহাকাশে, পৃথিবী গ্রহ থেকে বহু দূরে (৭৪৫০ লক্ষ মাইল)। প্রতি ঘণ্টায় ১৮০০০ মাইল বেগে উপগ্রহ ছুটলেও টাইটানে পৌঁছাতে লাগবে বেশ কয়েক বছর। টাইটান একটি উপগ্রহ। সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ শনি, তার চারদিকে ঘুরে চলেছে টাইটান। অর্থাৎ শনির চাঁদ। শনির উপগ্রহ অনেক (৬২), তবে টাইটান আকারে বৃহত্তম। উপগ্রহ হিসাবে সৌর জগতে টাইটান আকারে দ্বিতীয় বৃহত্তম। প্রথম স্থানে বৃহস্পতির উপগ্রহ গ্যানিমেড।

অনন্ত বিশ্বের মহাকাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গ্রহ উপগ্রহ। আমাদের সৌরজগতেই আছে আটটি গ্রহ আর একশ পঁচাশিটির মতো উপগ্রহ। এর মধ্যে আলাদা করে টাইটানকে জানবার দরকার কী? কেন বিশ্ব জুড়ে টাইটানকে নিয়ে এত উৎসাহ? অজানাকে জানবার একটা কৌতূহল তো মানুষের আছেই। তার সাথে যুক্ত হয়েছে এক গভীর আতঙ্ক। কেবলই প্রশ্ন উঠছে, পৃথিবী যদি ধ্বংস হয়ে যায়?

তেমন সম্ভাবনা তো আছে। পৃথিবী গ্রহের উষ্ণায়নের ফলে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। ফল স্বরূপ প্রবল ঝড় জলোচ্ছ্বাস বন্যায় বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হেতু অচিরেই ধ্বংসের মুখে দাঁড়াবে পৃথিবী। সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে যাবে অনেক দেশ। পৃথিবীর বহু প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মনুষ্য প্রজাতিরও সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটতে পারে।

কোটি কোটি বছর ধরে গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। আসন্ন বিপদ থেকে একে বাঁচানোর কি কোন উপায় নেই? উপায় খুঁজতে ভাবনা শুরু হয়েছে। দেশ বিদেশে বহু ভাষায় কল্পকাহিনী রচনা হয়েছে ঢের। আর বিজ্ঞানী মহলে মনুষ্য প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার চিন্তা ও ক্রিয়াকর্ম শুরু হয়েছে।

কয়েক দশক ধরেই চলছে ভাবনা। সৌর জগতের অন্য কোনো গ্রহে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে মানুষ। জল্পনার শুরু বহুদিন আগে। মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে ছিটকে আসা উল্কাপিণ্ড বিশ্লেষণ করে এককোষী জীবের ফসিলের সন্ধান মিলেছে (২০০৯)। সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ মঙ্গলের ঘূর্ণন কাল এবং ঋতু পরিবর্তন অনেকটা পৃথিবীর মতোই। তাই মঙ্গল গ্রহেও প্রাণ সৃষ্টির পরিবেশ মিলতে পারে। এমন একটা জল্পনা বরাবরই ছিল বিজ্ঞানীদের।

আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার (National Aeronautics and space administration, NASA) আবিষ্কার জল্পনাকে আরও উসকে দিল। নাসার পরীক্ষায় জলের সন্ধান মিলেছে মঙ্গলে। আর যেখানে জল, সেখানেই জীবনের সম্ভাবনা। নাসা মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে মানুষ সহ মহাকাশযান ছুটবে ৫৪৬ লক্ষ কিলোমিটার দূরে মঙ্গল গ্রহ অভিমুখে।

মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর ‘মার্স ওয়ান’ নামের এক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে একটি ডাচ সংস্থা। নাসার আগেই, ২০২৪ সালের মধ্যে, তারা মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে চায়। এই বিরল অভিযানে অংশ নিতে ইচ্ছুক দু’লাখেরও বেশি মানুষ। তবে বেছে নেওয়া হবে মাত্র ২৫ জনকে। যারা মঙ্গল গ্রহে যাবেন তাদের আর পৃথিবীতে ফিরে আসা হবে না কোনদিন। মঙ্গলের মাটিতেই হবে তাদের সমাধি।

ভিনগ্রহে বসতি স্থাপনের কথা উঠলে প্রথমেই মঙ্গল গ্রহের নাম উঠে আসে। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীর মতে, ‘পৃথিবীর বাইরে মানব বসতির জন্য সৌরজগতে টাইটানই সবচেয়ে উপযুক্ত। এতে পৃথিবী-সদৃশ অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, টাইটানকে ঘিরে রয়েছে ঘন বায়ুমন্ডলের স্তর। সেটি সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে এর বাসিন্দাদের রক্ষা করতে সক্ষম’। বলছেন আমান্ডা হেনড্রিক্স (অ্যারিজোনার প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইনস্টিটিউট) আর ইউক ইউং (ক্যালটেক, ক্যালিফোর্নিয়া)।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, টাইটান উপগ্রহটিতে রয়েছে ৩০ কোটি মানুষের ভার বহন করবার মত সম্পদ। মনুষ্য বসতির জন্য দরকার শক্তি। আর বেশ কিছু শক্তির উৎস টাইটানের মধ্যে মজুদ আছে। যেমন, নিউক্লিয়, রাসায়নিক, জলবিদ্যৎ, বায়ু এবং এমনকি সৌরশক্তি। (তথ্য সুত্রঃ Amanda R. Hendrix, Yuk L. Yung, Journal of Astrobiology and Outreach, 2 Jul 2017)।

মহাকাশযানে নিউক্লিয় শক্তি ব্যবহার করা হয়। শক্তির উৎস প্লুটোনিয়াম — ২৩৮। টাইটানেও এটি উপযুক্ত শক্তির উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। এছাড়াও টাইটানে রয়েছে বিপুল পরিমাণে মিথেন এবং তরল হাইড্রোকার্বন। টাইটানের সমুদ্রে মজুত রয়েছে প্রচুর রাসায়নিক উপাদান যা থেকেও শক্তির যোগান হতে পারে।

তরলের এই জলাধারগুলো মিথেন-ইথেন-এর সমুদ্র যা বিদ্যুৎ-শক্তির উৎস হতে পারে। যদিও ইতিপূর্বে দেখা গেছে টাইটানের সমুদ্রগুলোতে ঢেউ মাত্র ১ সেন্টিমিটার উচু। তবে গবেষকরা বলছেন, এগুলোকে ঢাল (স্লপ) বেয়ে প্রবাহিত করে উল্লেখযোগ্য শক্তি পাওয়া সম্ভব।

টাইটানের পৃষ্ঠের উঁচু অংশের বাতাস কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদন কড়া সম্ভব। যদিও টাইটানের পৃষ্ঠদেশে বাতাসের গতিবেগ নামমাত্র, কিন্তু বায়ুমন্ডলের ৪০ কিলোমিটার উপরে এর গতিবেগ প্রতিসেকেন্ডে ২০ মিটার পর্যন্ত হয়। এই বাতাস থেকে টারবাইন বা অন্য কোনো ব্যবস্থার সাহায্যে শক্তি সংগ্রহ করা সম্ভব।

সবচেয়ে বেশী আলোচ্য শক্তির উৎস অবশ্য সৌর শক্তি। যদিও সূর্য টাইটান থেকে অনেক দূরে (পৃথিবীর তুলনায় টাইটানের কাছ থেকে ১০ গুণ দূরে) তবুও গবেষক দল বলছেন উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে টাইটানের সৌর শক্তিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। টাইটান, সৌরমণ্ডলের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ। ডাচ অ্যাস্ট্রোনোমার ক্রিস্টান হাইজিন ‘টাইটান’ আবিস্কার করেছিলেন সাড়ে তিনশ বছর আগে (২৫ মার্চ ১৬৫৫)। বলা হয়েছে আগেই, টাইটান আমাদের সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যেখানে পৃথিবীর মতো বায়ুমণ্ডল (অ্যাটমোস্ফিয়ার) রয়েছে।

কেমন সে বায়ুমণ্ডল? টাইটানের বায়ুমণ্ডল ছেয়ে আছে ঘন ধূলিকণায়। ধূলিকণায় আচ্ছাদিত বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তুলনায় টাইটানের বায়ুমণ্ডলের ব্যাপ্তি অনেকটাই বেশী। বায়ুমণ্ডলে ঘন ধুলোর আবরণ থাকার কারণে টাইটানের ভূপৃষ্ঠ সঠিক ভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি। তাই বহু বছর ধরে টাইটানকে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ মনে করা হত এবং এর ঘন ধুলোর স্তর অতিক্রম করে এর পৃষ্ঠদেশের খবরা-খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি।

পরবর্তীকালে টাইটানের আকাশে মহাকাশযান পাঠিয়ে এর আকারের সঠিক পরিমাপ করা সম্ভব হয়। আমরা জানতে পারি, সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ হল গ্যানিমেড আর টাইটান দ্বিতীয় বৃহত্তম। আকারে আমাদের চাঁদ এবং মঙ্গল গ্রহের থেকে বড়। টাইটানের ব্যাস (ডায়ামিটার) ৫১৫১ কিলোমিটার। টাইটানের একদিন মানে পৃথিবীর ১৫ দিন ২২ ঘন্টা। টাইটানের ভূত্বক খুবই পাতলা, গভীরতা প্রায় ৩৪০০ কিলোমিটার। ভূত্বক কঠিন বরফে আচ্ছাদিত।

টাইটান এখনও বহু রহস্যে ঘেরা। শনি গ্রহ থেকে প্রায় ১২ লক্ষ কিলোমিটার দূরে (পৃথিবী থেকে ৭৪৫০ লক্ষ কিমি) অবস্থিত এই উপগ্রহকে একটি জীবন্ত উপগ্রহ বলে মনে করা হয়। এখানে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে।

টাইটানে আমাদের পৃথিবীর মতোই বায়ুমণ্ডল রয়েছে। কিন্তু ভিন্নতর বায়ুমণ্ডল। মনে করা হয়, টাইটানের জন্ম আমাদের সৌরমণ্ডল সৃষ্টির সময়েই ঘটেছিল। কিন্তু টাইটানে বায়ুমণ্ডল খুবই নতুন, এটি প্রায় ১০ লক্ষ থেকে ১০ কোটি বছরের পুরোনো। টাইটানের বায়ুমণ্ডলে রয়েছে ৯৫% নাইট্রোজেন, আর বাকি ৫ % অংশে রয়েছে মিথেন, হাইড্রোজেন এবং অন্যান্য গ্যাস।

পুরো ব্রহ্মাণ্ডে, এ যাবত তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর পর টাইটানই এমন জায়গা যেখানে প্রচুর পরিমাণে তরল পদার্থ রয়েছে। কী সেই তরল পদার্থ? সেটি কার্বন আর হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি সরলতম জৈব যৌগ, মিথেন। যেভাবে পৃথিবীতে তরল কঠিন এবং গ্যাসীয়, এই তিন অবস্থায় জল পাওয়া যায়, ঠিকই তেমনই টাইটানে মিথেন তিন অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ তরল, কঠিন এবং গ্যাসীয় মিথেন টাইটানে পাওয়া যায়। যেমন পৃথিবীর সমুদ্র এবং নদী অপরিসীম জলের ভাণ্ডার, তেমনই টাইটানের নদী সমুদ্র মিথেনের বিশাল ভাণ্ডার।

পৃথিবীতে জলের কনা বায়ুমণ্ডলে ঠাণ্ডা হয়ে সৃষ্টি করে মেঘ। আর টাইটানের মেঘ মিথেন-সৃষ্ট। বৃষ্টিতে মিথেন ঝরে পরে টাইটানের ভূত্বকে। মনে কড়া হয়, টাইটানের সামগ্রিক প্রাকৃতিক গঠনে — অর্থাৎ নদী সমুদ্র পাহাড় পর্বত — ছড়িয়ে আছে মিথেন।

মিথেন পাওয়া যায় টাইটানের আগ্নেয়গিরিতেও। আগ্নেয়গিরি থেকে লাভার বদলে নির্গত হয় অতি ঠাণ্ডা এমোনিয়া ও মিথেনের মিশ্রণ (Ammonia and methane mixture)। এগুলোকে বলা হয় আইস ভলকেন।

টাইটানের গড় তাপমাত্রা মাইনাস ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ প্রবল ঠাণ্ডা। এখানে অতি শৈত্যের প্রধান কারণ ধুলিকনা পূর্ণ বায়ুমন্ডল। ধূলিকণা থাকার ফলে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে মহাকাশে ফিরে যায়। ভূত্বকে আসতে পারে না।

টাইটানে নদীর সন্ধানও মিলেছে। দীর্ঘতম নদী ২৫০ মাইল লম্বা, পৃথিবীর নীল নদের সাথে তুলনীয়। টাইটানে নদীর প্রবাহে বয়ে চলে তরল মিথেন ও ইথেন। নদী মিলিত হয় হ্রদ বা সমুদ্রে। টাইটানের এই দীর্ঘতম নদী মিলিত হয়েছে উপগ্রহের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঝিল, ‘লিজিয়া ম্যারে’তে।

টাইটান উপগ্রহের সবচেয়ে বড় ঝিলের নাম ‘ক্রাঙ্কেন মারে’। বিশাল এই ঝিলের বিস্তৃতি ১ লক্ষ ৫৪ হাজার স্কোয়ার মাইল। পৃথিবীর বৃহত্তম লেক, ক্যাস্পিয়ান সাগর ১.৪ লক্ষ স্কোয়ার মাইল। ক্র্যাঙ্কেন মারের ঝিল আমেরিকার লেক সুপিরিয়ারের থেকে ৫ গুণ বড়। টাইটানের ঝিল গুলোতে অনেক দ্বীপ বা আইল্যান্ড দেখতে পাওয়া গেছে। কিন্তু লিজিয়া ম্যারে ঝিলের দ্বীপ গুলো খুবই রহস্যময়। বলা হয় ‘ম্যাজিক আইল্যান্ড’। আইল্যান্ড গুলি মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায় আবার কিছু সময় পরে ফিরে আসে। কেন এরকম হয়? রহস্যভেদ করবার জন্য টাইটানে বহুবার মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে। কিন্তু রহস্যের জট খোলেনি এখনও।

টাইটানে প্রথম মহাকাশযান পায়োনিয়র-১১ পাঠানো হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। টাইটানের কিছু ছবিও পৃথিবীতে পাঠিয়ে ছিল পায়োনিয়র-১১। এর উদ্ঘাটিত তথ্য অনুযায়ী, টাইটান প্রাণের সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ-বিহীন খুবই ঠাণ্ডা একটি উপগ্রহ। পায়োনিয়র-১১ পর ভয়েজার ১ এবং ভয়েজার ২ নামের দুটি মহাকাশযান পাঠান হয়েছিল টাইটানে (১৯৮০ এবং ৮১ সালে)। ভয়েজার ওয়ানকে এমন ভাবে তৈরি কড়া হয়েছিল যাতে এটি প্রদক্ষিণ করবার সময় টাইটানের সঠিক আকার পরিমাপ করতে পারে। অনেক তথ্য হাতে এলেও বহু রহস্য জানা যায়নি। তাই পরবর্তী সময়ে নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির যৌথ উদ্যোগে ‘ক্যাসিনি হায়জেন্স’ নামের আরেকটি মহাকাশযান টাইটানে পাঠান হয়। টাইটানের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল ক্যাসিনি হায়জেন্স (১লা জুলাই ২০০৪)।

মহাকাশ যানটি টাইটানের সবচেয়ে কাছে, ৮৮০ কিলোমিটার দূরে, পৌঁছে গিয়েছিল। সেই সময় এটি টাইটানের উত্তর দিকের সমুদ্র এবং ঝিলে জমে থাকা প্রচুর পরিমাণ তরল পর্দাথের খোঁজ পায়।

এর পরে ঘটল আভাবিত সাফল্য। হাইজেন্স প্রোব টাইটানের ভূ-পৃষ্ঠে অবতরণ করতে সক্ষম হল (১৪ জানুয়ারি ২০০৫)। পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত জায়গায় মানুষের তৈরি যান অবতরণ করল। জায়গাটির নাম দেওয়া হয় অ্যাডেরি। টাইটানের একটি উজ্জ্বল জায়গা সেটি। কী তথ্য উঠে এল হাইজেন্স প্রকল্পে? টাইটানে কি কোন জীবিত প্রাণী থাকতে পারে? থাকতে পারে সে রকমই মনে করেন বৈজ্ঞানিকরা। পরীক্ষায় জানা গেছে, টাইটানে সেই ধরনের জৈব যৌগ (অর্গানিক মেটেরিয়াল) মজুত আছে যাদের বিক্রিয়ায় পৃথিবীতে জীবনের সৃষ্টি হয়েছিল।

ভবিষ্যতে টাইটানের বুকে জীবনের সৃষ্টি হতে পারে। বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন টাইটানে মিথেনের ঝিল বা সমুদ্রেও থাকতে পারে জীবন যেমন পৃথিবীর সমুদ্রে দেখতে পাওয়া গেছিল। টাইটানের সেই সমস্ত প্রাণীরা হয়তো শ্বাস নেওয়ার জন্যে অক্সিজেনের বদলে হাইড্রোজেন (H2) ব্যাবহার করে। তারা গ্লুকোজের পরিবর্তে অ্যাসিটালিনের সাহায্য নিয়ে হয়ত শক্তি সংগ্রহ করে। শ্বাসক্রিয়ায় তারা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বদলে মিথেন বাতাসে ছাড়ে। আমরা পৃথিবীতে পানীয় হিসাবে জলকে ব্যবহার করি টাইটানে হয়তো মিথেন বা ইথেনের ব্যবহার করা হয়।

প্রাণের সম্ভাবনা থাকা সত্বেও, টাইটানে মানুষের টিকে থাকা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কারণ সূর্যের অবস্থান। সূর্যের অবস্থান অনেক দূরে তাই এখানকার পরিবেশ খুবই ঠাণ্ডা। জমাট অবস্থায় রয়েছে জলের অণুগুলো (water molecule)। কার্বন ডাই অক্সাইড আর অক্সিজেন আছে খুবই কম পরিমাণে। আর আছে অতি অল্প আলো। সব মিলিয়ে টাইটানের পরিবেশ এখনও মনুষ্য জীবন ধারণের অন্তরায়।

আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর পর, আমাদের সূর্য তার তাপের উৎস নিঃশেষিত করে যখন মৃতপ্রায় হয়ে যাবে (রেড জায়েন্ট), তখন টাইটানের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা অনেকটাই বেড়ে যাবে। সেই অবস্থায় উপগ্রহটি উত্তপ্ত হবে। ঠাণ্ডায় জমে থাকা জল উত্তাপে তরলে পরিণত হবে। বায়ুমণ্ডলের উপরের ধুলিকণার আস্তরণ পাতলা হতে থাকবে। তখন হয়ত টাইটান আমাদের বসবাসের জন্য সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে উপযোগী জায়গা হতে পারে।

আপাতত টাইটানে মানুষের বসতি না হোক, টাইটান সম্পর্কিত গবেষণা চলতে থাকুক। এতে উঠে আসতে পারে অনেক সম্ভাবনা। জীব-রসায়নের অনেক নতুন তথ্য।


ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী: পূর্বতন বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্, চিত্তরঞ্জন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা সংস্থান, কলকাতা।