Biography-জীবনীFree Articles

উদ্বেগ, হতাশা এবং বোলজম্যানের এনট্রপি ফর্মুলা

তাঁর সমাধি ফলকে উৎকীর্ণ আছে তাঁর সেই বিখ্যাত ফর্মুলা, যা বোলজম্যানের এনট্রপি ফর্মুলা নামে পরিচিত। থারমোডিনামিক্স পড়া সকলের কাছে যা পরিচিতঃ S = k · log W ।

বিজ্ঞানী লুডভিক বোলজম্যান (Ludwig Boltzmann, 1844-1906) সম্পর্কে বেশি কিছু জানা ছিল না। তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি জেনে আগ্রহী হয়ে একটু-আধটু পড়তে পড়তে অনেক চিত্তাকর্ষক ও রোমাঞ্চকর অজানা ইতিহাসের খোঁজ পেলাম। তারই কিছু কিছু বলার চেষ্টা করব এখানে। বোলজম্যানের ফিজিক্সের জটিলতার ভেতরে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই, তাই সে চেষ্টাও করব না। শুধু তাঁর কাজের বিস্তৃতির পরিধি ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। তাঁর কথা পড়তে পড়তে যে কথাটা আমার মনে হচ্ছিল তা হল, মেধাবী বোলজম্যানের আরও অনেক কীর্তি প্রত্যক্ষ করতে পারত বিজ্ঞানের জগৎ যদি না অসহয়তা, উদ্বেগ আর অস্বীকৃতির হতাশা তাঁর মস্তিষ্কের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিত। সে সব কথায় পরে আসব। প্রথমে তাঁর বেড়ে ওঠা ও অবদানের কথা বলব।

লুডভিকের দাদু ছিলেন ঘড়ি প্রস্তুতকারক। ভিয়েনা থেকে বার্লিনে আসেন দাদু। বাবা ছিলেন ট্যাক্স অফিসার। ট্যাক্স অফিসারের ছেলে লুডভিকের ছিল সংখ্যার প্রতি তীব্র আকর্ষণ। যেন রক্তের মধ্যে সংখ্যার স্রোত। পনেরো বছর বয়সে বাবা মারা যায়। ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স নিয়ে পড়লেন লুডভিক। মাত্র বাইশ বছর বয়সে পি এইচ ডি করলেন ‘কাইনেটিক থিয়োরি অফ গ্যাসেস’ নিয়ে।

উনবিংশ শতকের শেষভাগের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার একজন অন্যতম কীর্তিমান বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক ছিলেন লুডভিক বোলজম্যান। এই অস্ট্রিয় পদার্থ বিজ্ঞানীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের প্রবর্তনা। বোলজম্যানকে তাই স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের জনক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। তাপগতিবিদ্যা (থারমোডিনামিক্স), গ্যাসের গতিতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণার জন্যে বিখ্যাত। ‘সেকেন্ড ল অফ থারমোডিনামিক্স’-এর স্ট্যাটিস্টিক্যাল ব্যাখ্যাতা এবং ‘কাইনেটিক থিয়োরি অফ গ্যাস’ সংক্রান্ত কাজে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।

১৮৬০ এবং ১৮৭০ এর দশকের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাব তখন জেমস ক্লার্ক, ম্যাক্সওয়েল ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ডের তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন।। রুডলফ ক্লসিয়াস থারমোডিনামিক্স-এ এন্ট্রপির ধারণা নিয়ে আসছেন। যখন কাইনেটিক থিয়োরি হয়ে উঠছে একটি অগ্রগামী কাজ। এই সময়েই লুডভিক বোলজম্যান শুরু করেছেন তাঁর সায়েন্টিফিক কেরিয়ার এবং প্রকাশ পাচ্ছে ‘কাইনেটিক থিয়োরি’ সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্রগুলি।

দু-তিন জন দিকপাল তাত্ত্বিক পদার্থবিদ অগ্রাহ্য করেছিলেন বোলজম্যানের ওইসব কাজ। মান্যতা দেননি তাঁরা। বছরের পর বছর বিরোধিতা আর কটাক্ষ করে গেছেন। সম্ভবত এই জন্যেই এক জায়গায় স্থিত হতে পারেননি বোলজম্যান। জীবৎকালে নিজের কাজের স্বীকৃতি না পাওয়ার হতাশা থেকেই সম্ভবত মস্তিষ্কের ভারসাম্য খুব বেশি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ কথা ঠিক, সকলে বিরুদ্ধাচারণ, উপহাস, অসহায়তা, অন্যের দ্বারা ভুল প্রতিপন্ন হওয়া ইত্যাদির মতো বিরোধিতা অত সহজে নিতে পারেন না। যেমন বোলজম্যান পারেননি। মানসিক অস্থিরতার কারণে তিনি মেয়াদ ফুরোনোর আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাড়িতে স্ত্রী আর মেয়েদের নিয়ে সাংসারিক জীবনের শান্তির মধ্যে ফিরে এসেছিলেন। ঘটনা হল, বোলজম্যান জেনে যেতে পারেননি তাঁর কাজ স্বীকৃত হওয়ার কথা।

বোলজম্যানের সেই বিখ্যাত এনট্রপি ফর্মুলা যা তাঁর সমাধি ফলকে উৎকীর্ণ করা তা বোলজম্যানের মৃত্যুর বছরখানেক পরে প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হল ‘অ্যাভোগাড্রো-র নাম্বার’ এবং বোলজম্যান ধ্রুবক। সেই সঙ্গে পরমাণু ও কণিকার অস্তিত্বও প্রমাণিত হল। স্বনামধন্য পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক প্রথম উল্লেখ করলেন- “The logarithmic connection between entropy and probability was first stated by L. Boltzmann in his kinetic theory of gases”.

দিনটি ছিল ১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ। গ্রীষ্মাবকাশে বেড়াতে গিয়ে একটি হোটেলে উঠেছিলেন স্ত্রী এবং কন্যাদের সঙ্গে নিয়ে। ওখানেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন বোলজম্যান। এভাবেই বড়ো বেদনার মতো বেজে উঠেছিল তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়টি।


ড. সিদ্ধার্থ মজুমদার: বিজ্ঞান গবেষক এবং  বিজ্ঞান প্রশাসক, অ্যাকাডেমিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগ, সিএস.আই.আর.-আই.আই.সি.বি.  (অবসরপ্রাপ্ত)