Engineering & Technology-প্রজুক্তি ও প্রকৌশলFree Articles

মাইক্রোওয়েভের দুনিয়া

মাইক্রোওয়েভ ওভেনের অভ্যেস এখন ঘরে ঘরে। শহরাঞ্চলে এমন বাড়ি পাওয়া যাবে না, যেখানে এমন একখানা যন্ত্র নেই। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে? মাইক্রোওয়েভ ওভেনে কাপ রেখে দিয়ে বোতাম টিপে এক মিনিট ঘুরিয়ে নাও, ঠাণ্ডা চা একেবারে তাজা গরম। কাপের চা যদিও গরম হবে, কাপ নিজে কিন্তু গরম হয়ে হাত পোড়াবে না।

গত শতাব্দীর অন্য অনেক আবিষ্কারের মধ্যে মাইক্রোওয়েভের আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু কী ওভেন? আজ যে মোবাইল নামক যন্ত্রটি শহর গ্রাম নির্বিশেষে মানব জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, তার পিছনেও আছে মাইক্রোওয়েভের অবদান।

মাইক্রোওয়েভের আবিষ্কার কিন্তু যুদ্ধের স্বার্থে সৃষ্টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর সমরকুশলীরা অনুভব করলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। হঠাৎ কোনও যুদ্ধ জাহাজ বা হেলিকপ্টার শত্রুপক্ষের সীমানা থেকে হানা দিলে তার উপস্থিতি মুহূর্তে বুঝে না নিলে, তার আঘাত থেকে বাঁচার উপায় নেই – শত্রুর আকস্মিক বোমা বর্ষণে নাজেহাল হতে হবে। তাই বিজ্ঞানীদের আদেশ দেওয়া হল, অবিলম্বে যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি এক মুহূর্তে জেনে যাওয়া যায়, এমন কোনও যন্ত্র বানাও।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি দূরসঞ্চারে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ ব্যবহার করা যেতে পারে, এ কথার বৈজ্ঞানিক হদিস দিয়ে যান স্যর জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু সে কেবলই অংকের সমীকরণে। পরবর্তীকালে একটি হাই ফ্রিকোয়েন্সি ইন্ডাকশন কয়েল ব্যবহার করে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ তৈরি করে এবং একটু দূরে তাকে আর একটি কয়েলেসনাক্ত করে বিজ্ঞানী হাইনরিখ হার্জ দেখিয়ে দেন, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ সঞ্চারণে কোন মাধ্যম লাগে না। তখনই রেডিও আবিষ্কারের সুচনা হয়ে গেল। পরবর্তী ষাট সত্তর বছরে বিজ্ঞান দেখল রেডিও আবিষ্কার ও তার অসামান্য বিবর্তন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাবার পর ১৯৪৫ সালে রাডার নিয়ে কাজ করছিলেন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার পার্সি স্পেন্সার। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো রাডার (RADAR) একটি সংক্ষিপ্ত শব্দ, যার পুরোটা হচ্ছে রেডিও ডিটেকশন এন্ড রেঞ্জিং। স্পেন্সার তখন রেডিয়ন কোম্পানির মাইনে করা ইঞ্জিনিয়ার। রেডিয়ন সেই সময়ে আমেরিকার সবচাইতে বড় যুদ্ধাস্ত্র বানাবার কোম্পানি। স্পেন্সার একদিন একটি উচ্চ শক্তি সম্পন্ন মাইক্রোওয়েভ বিম নিয়ে কাজ করবার সময় হঠাৎ-ই আবিষ্কার করেন তার কোটের পকেটে রেখে দেওয়া চকোলেট বার গলে গেছে। অথচ হল্যান্ডে সে সময়ে বেশ শীত।

পার্সি স্পেন্সার (Percy Spencer) | Image Source: Google

স্পেন্সার মাইক্রোওয়েভের উত্তাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা অনুমান করে যন্ত্রের মধ্যে ভুট্টা দানা ছড়িয়ে দিতেই এক মুহূর্তে পপকর্ণ তৈরি। এরপর আরও পরীক্ষা করে দেখার জন্য আস্ত ডিম ঢুকিয়ে দিয়ে যন্ত্র চালু করতেই ডিম ফেটে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আসলে মাইক্রোওয়েভ জলের অণুগুলোকে আন্দোলিত করে উত্তাপ সৃষ্টি করে। ডিমের ভিতরের জলীয় অংশ বাস্পে পরিণত হয়ে ডিমের খোলার উপর চাপ সৃষ্টি করায় ডিম ফেটে চৌচির হয়ে যায়।

এরপর স্পেন্সারের আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়ে ফেলল রেডিয়ন কোম্পানি। একটি বিশাল আকৃতির মাইক্রোওয়েভ ওভেন বনানো হল, যার উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট এবং ওজন প্রায় সাড়ে তিনশো কিলো। সেই বাক্সে মাইক্রোওয়েভ পাঠিয়ে খুব কম সময়ে খাবার রান্না করে বাজারে তাক লাগিয়ে দিল রেডিয়ন কোম্পানি। কিন্তু মুশকিল হল এই যে, এধরনের ওভেন গৃহস্থের রান্নাঘরে ঢুকবে কেমন করে! কাজেই মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ক্রমশ আরও অনেক কোম্পানি মাইক্রোওয়েভ ওভেনের আকৃতি ও বানাবার খরচ কম করবার কাজে মন দিল। ফলে রান্নাঘরে ব্যবহৃত হবার যোগ্য মাইক্রোওয়েভ ওভেন তৈরি হয়ে গেল। ভারতেও গত দশ পনের বছরে এই যন্ত্র বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

এতো গেল আবিষ্কারের কাহিনী। এবারে দেখে নেওয়া যাক মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার তৈরি হওয়ার পিছনে লুকিয়ে থাকা প্রযুক্তিগত কৌশল। মাইক্রোওয়েভ আসলে একটি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, যার কম্পাংক ৩০০ মেগা হার্জ থেকে ৩০০ গিগা হার্জ পর্যন্ত হতে পারে। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গতিবেগ = কম্পাংক× তরঙ্গ দৈর্ঘ। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, তরঙ্গ দৈর্ঘকম্পাঙ্কের সাথে ব্যাস্তানুপাতিক। তাই তরঙ্গের কম্পাংক যত বেশি, দৈর্ঘ তত কম। এই উচ্চ কম্পাঙ্কের মাইক্রোওয়েভতরঙ্গের দৈর্ঘ অনেক কম, ১০০সেমি থেকে ০.১সেমি পর্যন্ত। তরঙ্গ দৈর্ঘ ছোট হওয়ায় ও কম্পাংক অনেক বেশি হওয়ায় তার শক্তি বেশি হয় এবং এই তরঙ্গ অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে এবং সোজাসুজি ভ্রমণ করে। তরঙ্গের ও মাইক্রোওয়েভের এই ধর্ম কাজে লাগানো হয় দূরসঞ্চারে। যেমন মোবাইল ফোন ও টেলিভিশনের সংকেত প্রেরণ করা হয় মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে।

এবার দেখি মাইক্রোওয়েভ তৈরি করা হয় যে যন্ত্রে সেটা কেমন। মাইক্রোওয়েভ তৈরি হয় ম্যাগ্নেট্রন নামের যন্ত্রে (নিচে ছবি)। গহ্বর যুক্ত যে তামাটে রঙের সিলিন্ডার দেখা যাচ্ছে, তাকে বলা হয় এ্যনোড আর হলুদ রঙের যে নলটি কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে, সেটি হচ্ছে ক্যাথোড। ক্যাথোডের মাঝে আছে একটি ফিলামেন্ট, যা ক্যাথোডকে গরম করে। ক্যাথোডের উপর লাগানো থাকে বেরিয়াম অক্সাইডের পরত। ফিলামেন্টে তারের সাহায্যে বিদ্যুৎ পাঠালে ক্যাথোড গরম হয়ে ইলেকট্রন স্রোত প্রবাহিত হয়। একটি শক্তিশালী স্থায়ী চুম্বক এমন ভাবে ম্যাগ্নেট্রনে বসানো থাকে, যাতে বিদ্যুৎ প্রবাহ ও চুম্বক ক্ষেত্র পরস্পরের সাথে উল্লম্ব অবস্থায় কাজ করে।

এই তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রবেশ করে ইলেকট্রন স্ক্রুয়ের মতো প্যাঁচালো পথে এ্যনোডের দিকে ছুটে যায়। এ্যনোডের গহ্বরের সরু পথে এই উচ্চ শক্তি সম্পন্ন ইলেকট্রন প্রবেশ করলে কম্পনের সৃষ্টি হয়, যাকে বলা হয় ক্যাভিটি রেজোন্যান্স। ফলে মাইক্রোওয়েভ উৎপন্ন হয়। ম্যাগ্নেট্রন যন্ত্রে মাইক্রোওয়েভকে দিশা নির্দেশ করবার জন্য ব্যবহার করা হয় একটি বিশেষ ব্যবস্থা, যাকে বলা হয় ওয়েভ গাইড। ওয়েভ গাইডের কাজ হল উৎপন্ন মাইক্রোওয়েভকে একটি সূক্ষ্ম পথে পরিচালিত করা।

Microwave Magnetron

মাইক্রোওয়েভ ওভেনের বাক্সের ভিতর আলোর বাল্বের ঠিক পাশেই ধাতব জালির পিছনে লাগানো থাকে ম্যাগ্নেট্রন। বাক্সের ভিতরে তাকালে সহজেই ওয়েভ গাইড দেখতে পাওয়া যায়, যার শেষ অংশ বাক্সের ভিতরেই থাকে। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ভিতরে থাকে একটি ঘূর্ণায়মান কাঁচের টেবিল, যার উপর পাত্র রাখা হয়। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের গোলাকৃতি টেবিলের উপর পাত্র রাখলে খাদ্য বস্তু চারিদিক থেকে গরম হতে থাকে। এই যন্ত্রে কম সময়ে রান্না হয় ও খাদ্যের গুণ নষ্ট হয় না। তবে মাইক্রোওয়েভ ওভেন ব্যবহারের কিছু নিয়ম মেনে চলা অতি আবশ্যিক।

আধুনিক মাইক্রোওয়েভ ওভেনে তিনটি মোড থাকে – মাইক্রো, কনভেকশন আর গ্রিল। মাইক্রো মোডে ধাতব পাত্র রাখলে চলবে না, কারণ মাইক্রোওয়েভ ধাতব পাত্রে পড়লে শর্ট সার্কিট হয়ে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে, যা অত্যন্ত বিপদজনক। এই মোডে যন্ত্র চালাবার সময় কাঁচের পাত্র বা বিশেষ ধরনের প্লাস্টিকেরপাত্র ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক বা কাঁচের অণুকে মাইক্রোওয়েভ আন্দলিত করতে পারে না। ফলে সহজেই ওয়েভ পাত্র পার হয়ে যায়। কিন্তু মাইক্রোওয়েভ পাত্রে রাখা খাদ্যবস্তুর অণুকে অত্যন্ত উচ্চ কম্পাংকে আন্দোলিত করে তাকে গরম করে তোলে। জলের অনুর উপর মাইক্রোওয়েভের প্রভাব সবচাইতে বেশি। তাই পাত্রে রাখা জল দু-এক মিনিটেই গরম হয়ে গেলেও কাঁচের পাত্র গরম হয় না। কনভেকশন ও গ্রিল মোডে ম্যাগ্নেট্রন বন্ধ থাকে, একটি বিশেষ ইলেকট্রিকাল হিটার চালু হয়ে ওভেনে উত্তাপ সৃষ্টি করে। সেই উত্তাপকে সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপনা থেকেই চালু হয় একটি ফ্যান। গ্রিল মোডে উচ্চতাপে ইলেকট্রিকাল হিটার খাদ্যকে গ্রিল করতে বা সেঁকে নিতে সাহায্য করে।

কনভেকশন এবং গ্রিল মোডে ম্যাগ্নেট্রন বন্ধ থাকায় মাইক্রোওয়েভ তৈরি হয় না। কাজেই এই দুই মোডে ওভেন চালাবার সময় ধাতব পাত্র রাখলে অসুবিধা নেই। কেক তৈরি করতে কনভেকশন মোড ব্যবহার হয়। প্রায়শই আমরা শুনে থাকি মাইক্রোওয়েভ ওভেনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন চুম্বক শক্তি মানব শরীরে ক্ষতি করতে পারে। এটা একেবারেই সত্য নয়। ম্যাগনেটিক-শিল্ড বা চুম্বকীয়-ঢাল ওভেনের চারিদিকে থাকার ফলে ওভেনের চুম্বক ক্ষেত্র বাইরে আসতে পারে না এবং এর থেকে উদ্ভূত মাইক্রোওয়েভও বাইরে আসতে পারে না। তবে কোন মোডে কোন পাত্র রাখা যেতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সাথে একটি বই দেওয়া হয়, যাতে চালন পদ্ধতি বিশদ ভাবে লেখা থাকে। বিভিন্ন ভারতীয় মাইক্রোওয়েভে রান্নার পদ্ধতিও সাধারণত ওভেন কেনবার সময় সব কোম্পানিই দিয়ে থাকে। এই সমস্ত তথ্য পড়ে নিলে শুধু যে দুর্ঘটনা এড়ানো যায় তাই নয়, সুস্বাদু রান্নায় ভুরিভোজও করা যায়।


অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়: পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে দিল্লী আই.আই.টিতে।বর্তমানে প্রায় তিন দশক ধরে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ে লেখার পাশাপাশি ছোটগল্প লেখেন।