করোনার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তিঃ কী, কেন, কীভাবে?
কয়েকদিন আগে আমার এক সহকর্মীকে কথা প্রসঙ্গে ঠাট্টাচ্ছলে বলছিলাম, করোনা তো বুদ্ধিমান ভাইরাসের মতো নিজের জিনের নক্শা বদলাচ্ছে, উপসর্গ বদলাচ্ছে, এবার যদি করোনা হঠাৎ বুঝে যায় যে আমাদের মতো গরিব দেশে মশাঘটিত ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গুতেই প্রচুর লোক মারা যায়, আর সেইমত সে যদি মশার দেহে ঢুকে পড়ে, তাহলে কী হবে? কথাটা রসিকতা করে বললেও বলার পরে নিজের ভেতরেই একটা টেনশন হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম ‘হু’ (WHO) বা অন্য কোন সংস্থা এখনো অব্ধি এই সম্ভাবনার কথা বলেনি। বরং এটাই বলছে যে কোভিড-১৯ যেহেতু শ্বাসকষ্টজনিত ভাইরাস, তাই মশার দেহ দিয়ে আপাতত এর সংক্রমনের কোন ভয় নেই। আশ্বস্ত হলাম। ভাগ্যিস তথ্য প্রযুক্তির দৌলতে ইন্টারনেট আমাদের হাতে আছে।
ইনফর্মেশন টেকনোলজি বা তথ্য প্রযুক্তি। প্রযুক্তিবিদ্যার এক বিশেষ ভাগ, যেটা ছাড়া এখন আমরা এক মুহুর্তও থাকতে পারি না। খুব সহজ ভাষায় বললে এটাই বলা উচিৎ যে মাকড়সার জালের মত অনেক কম্পিউটারের সংযোগ ঘটিয়ে গাণিতিক পরিভাষার মাধ্যমে তথ্য জমা করা, এক জায়গা থেকে পৃথিবীর আরেক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া ও প্রয়োজনমতো ব্যবহার করার নামই তথ্য প্রযুক্তি। আরেকটু বড় অর্থে তথ্য ও সংযোগ প্রযুক্তি (ICT)। ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল এর এক সুন্দর ব্যবহারিক প্রয়োগ। প্রশ্ন উঠবে, তথ্য কী? তথ্য হল পৃথিবীর এক প্রান্তের ব্যবহারিক যে কোন জ্ঞান যা অন্য প্রান্তে বসে একজনের জানা দরকার হতে পারে। ধরা যাক, কেউ যদি কলকাতায় বসে জানতে চায় বোন ম্যারোর বিখ্যাত ইতালিয়ান ডিশ ‘অসোবুকো’ কী ভাবে বানাতে হয়, সেটা তখন তথ্য। আবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় করোনা ভ্যাক্সিন নিয়ে কী রকম কাজ করছে এবং সেই ভ্যাক্সিন কবে নাগাত বাজারে আসবে, সেটা যদি কেউ বর্ধমানে বসে জানতে চায়, সেটাই তার কাছে তথ্য। অথবা, কোনো মাঝি মাছ ধরবে বলে ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি দেবার আগে আবহাওয়া দপ্তরের কাছে যদি জানতে চায় কোথায় মাছের ঝাঁক রয়েছে আর সেই পথে কোনো সামুদ্রিক ঝড় ধেয়ে আসছে কিনা, সেটাও তথ্য। এইসব তথ্য যে কেউ ইন্টারনেটের মাধ্যমে জেনে নিতে পারে। মোবাইলের মাধ্যমেও। সেখানেই তথ্য ও সংযোগ প্রযুক্তির সাফল্য।
করোনা প্রসঙ্গে তথ্য ও সংযোগ প্রযুক্তি যেটা করছে তা হল, এই সংক্রান্ত পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কো্নো ধরনের তথ্য নির্দিষ্ট যেসব ব্যক্তি, সংস্থা বা সরকার তুলে ধরছে, তা আরেক জায়গায় সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আর সেইসব আমরা ঘরে বসেই কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইলের মাধ্যমে জেনে যাচ্ছি। এবং সেই জানার প্রেক্ষিতে আমরা নতুন কিছু শিখছি, সাবধান হয়ে যাচ্ছি বা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এটা ঠিক যে তথ্য প্রযুক্তি দিয়ে কোন ভাইরাসকে মারা যায় না বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন তৈরি করা যায় না। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি দিয়ে যেভাবে কোনো মহামারীর সংক্রমন আটকানো যায় ও মানুষকে সচেতন করা যায়, তা অন্য কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। কোভিড-১৯ প্রসঙ্গে তথ্য প্রযুক্তি দুনিয়া জুড়ে কীভাবে কাজ করে চলেছে, সেই বিষয়ে আরো গভীরে ঢুকব। এবং পাঠককে উৎসাহ দেব ১৪ এপ্রিল ২০২০ এম-আই-টি টেকনিকাল রিভিউ-তে লেখা প্রফেসর জেমস ক্র্যাবট্রি-র ‘হাউ টু ম্যানেজ এ প্যান্ডেমিক’ পড়ে দেখতে। তবে তার আগে মহামারী বা অতিমারির সঙ্গে তথ্য ও সংযোগ প্রযুক্তির ইতিহাস একটু ঝালিয়ে নিই।
চিনের গুয়াংডং প্রদেশে নভেম্বর ২০০২-এ প্রথম দেখা গেছিল সার্স-করোনা ভাইরাস। যদিও চিনের তৎকালীন সরকার সেটা খুব দক্ষভাবে চেপে রেখেছিল ফেব্রুয়ারি ২০০৩ অব্ধি। কিন্তু মার্চে হু এই ভাইরাসকে পৃথিবী জুড়ে বিপজ্জনক মহামারী হিসেবে ঘোষনা করার পর ইন্টারনেট, মোবাইল আর ই-মেল ছেয়ে যায় সেই ঘোষনায়। মানুষ ভয় পেয়ে যায়। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। সেটাই ছিল মহামারীর বিরুদ্ধে তথ্য ও সংযোগ প্রযুক্তির প্রথম সাফল্য। সার্স ভাইরাসের সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি দেখে এপ্রিলে হু ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীতে এক সাবধানবার্তা ছড়িয়ে দেয় যাতে মানুষ কিছুদিনের জন্য হংকং আর গুয়াংডং প্রদেশে যাওয়া বন্ধ রাখে।
চিন সরকার সেই প্রথম শেখে যে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে, ইন্টারনেট-মোবাইলের যুগে, কোনো তথ্য গোপন রাখা যায় না। বরং তাকে নিজের হাতিয়ার করে মহামারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা উচিৎ। এরপর মার্চ ২০০৯-এর মেক্সিকোয় H1N1 ভাইরাস বা সোয়াইন ফ্লু অতিমারী। এখন যেমন ওয়ার্ল্ডোমিটার সারা পৃথিবীর করোনায় আক্রান্ত, মৃত ও সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের পরিসংখ্যান দিচ্ছে, সেই সময় আমেরিকা-কানাডা মিলে তৈরি করেছিল ‘হেলথ-ম্যাপ’ নামক ইন্টারনেট নির্ভর এক সফট্অয়্যার, যা সেই সময়ে সোয়াইন ফ্লু-তে আক্রান্ত, মৃত ও সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের পরিসংখ্যান দিত এবং সেই ফ্লু-এর গতি কোন্ দিকে এগোচ্ছে বা কোন্ দেশ এই রোগের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে, সেটাও বলে দিত। এর ফলে সতর্কতা নিতে সুবিধে হত। যেহেতু সেই সময়েও অনেক দেশ লক-ডাউন করতে বাধ্য হয়েছিল, ফলে জাপানের তৈরি ‘ইজি কমিউনিকেটর’ নামক এক ভিডিও ও ইন্টারনেট নির্ভর প্রযুক্তি দেশে দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের লোকজন ঘরে বসেই ওয়েব-মিটিং বা কনফারেন্স করতে পারত। এমনকী এর মাধ্যমে দূরে বসে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা অতিমারীর সাম্প্রতিক খবর, সবই করা বা জানা যেত। এরপর এল ২০১৪-য় নাইজেরিয়া থেকে পুরো পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়া ইবোলা ভাইরাস মহামারী। ততদিনে তথ্য ও সংযোগ প্রযুক্তি যথেষ্ট পরিণত। এই প্রযুক্তির সাহায্যে হু প্রায় পুরো পশ্চিম আফ্রিকায় একটা ‘ন্যাশনাল হেলথ ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম’ বানিয়ে ফেলেছিল যা এই মহামারীর সংক্রমণ বেশ খানিকটা প্রশমিত করেছিল। সেই সময় তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে মূলত যা যা করা হয়েছিল, তা অনেকটা এরকমঃ
(ক) মোবাইল মেসেজ – সেই সময় আফ্রিকায় বসবাসকারী যার যার কাছে মোবাইল ছিল, তাদের নম্বর নিয়ে প্রতিদিন অন্তত ১০ লাখ মোবাইলে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে তাদের সাবধান করা হত। কিন্তু আফ্রিকানরা তখন যেহেতু স্মার্ট ফোনের ব্যবহার প্রায় করত না বললেই চলে, ফলে অন্য কোন ভাবেই (যেমন ইন্টারনেট বা অ্যাপের মাধ্যমে) সেই সময় তাদের সতর্ক করার উপায় ছিল না।
(খ) স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ – আফ্রিকার স্থানীয় ভাষায় কম্পিউটার গেমের মতো এক অ্যাপ্লিকেশন সফট্অয়্যার বানানো হয়েছিল, E-BUDDI, যা দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের কম্পিউটার বা ল্যাপটপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। ইবোলা রুগির সঙ্গে কী করা উচিৎ, কী করা উচিৎ নয়। কী ওষুধ দিতে হবে, কখন দিতে হবে। সংক্রমণ বাঁচিয়ে কীভাবে পরিচর্যা করতে হবে ইত্যাদি। বলা যায়, টেলি-মেডিসিনের প্রথম ধাপ।
(গ) ডেটাবেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম – আগেই বলেছি, পুরো পশ্চিম আফ্রিকায় একটা ‘ন্যাশনাল হেলথ ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম’ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল, যেটা করেছিল স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা। ইন্টারনেটে এই পুরো সিস্টেম রেখে কেস হিস্ট্রির সাহায্যে চিকিৎসা সেই সময়ে যথেষ্ট কার্যকর উপায় হিসেবেই দেখা হত।
(ঘ) কম্পিউটার ম্যাপের মাধ্যমে সংক্রামিত অঞ্চলে নজরদারি – তখনো অব্ধি স্মার্ট ফোনের ব্যবহার পশ্চিম আফ্রিকায় ছড়ায়নি। মোবাইল অ্যাপ কী জিনিষ লোকেরা জানত না। বেশির ভাগ অঞ্চল ছিল প্রত্যন্ত গ্রাম। সেখানে ঐ ডেটাবেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের সাহায্যে রুগি ধরে ধরে তাদের আত্মীয়দের খুঁজে বের করে ইবোলা টেস্ট করা সময়সাপেক্ষ কাজ ছিল। ডিজিটাল ম্যাপ দরকার ছিল। সেটা ধীরে ধীরে ছ’মাস সময় নিয়ে করে ফেলেছিল কোনো এক গবেষণা সংস্থা। এবং সেই ম্যাপ সম্ভাব্য ইবোলা আক্রান্তদের ওপর নজরদারি চালাতে বেশ কাজে এসেছিল।
ইবোলার পর বেশ কিছু বড় টেক কোম্পানি ঠিক করে যে এবার তথ্য ও সংযোগ প্রযুক্তিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যাতে এরপর মহামারী হলে পৃথিবীতে কেউ যেন বিচ্ছিন্ন না থাকে। তথ্য যেন সবার কাছে ঠিকঠাক সময়ে পৌঁছে যায়। তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে যে কোনো কারুর অবস্থান যখন খুশি যেন খুঁজে নেওয়া যায়। এটা ঠিক, আজ তথ্য প্রযুক্তি যেভাবে কাজ করছে, মাঝে মাঝে মনে হয় কল্পবিজ্ঞানের সিনেমা দেখছি। আসুন, এবার দেখে নেওয়া যাক এই মুহুর্তে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তথ্য ও সংযোগ প্রযুক্তি কীভাবে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে।
১) মোবাইলের মাধ্যমে সাবধান করাঃ কখনো এস-এম-এস, কখনো ফোন করলে এক নির্দিষ্ট সাবধান বার্তার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার রোজ তাদের নাগরিকদের কোভিড-১৯ এর ব্যাপারে সচেতন করে দিচ্ছে। ভারত সরকার এই বিষয়ে এখনো অব্ধি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছে। সিঙ্গাপুর আবার একধাপ এগিয়ে ওখানকার নাগরিকদের প্রায় প্রতিদিন এস-এম-এস বা হোয়াটস্অ্যাপের সাহায্যে সে দেশে নতুন কতজন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে ও সরকার তার বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটাও জানিয়ে দিচ্ছে।
২) অবস্থান নির্ণয়ঃ করোনা ভাইরাস যার দেহে পাওয়া গেছে, তার মোবাইল থেকে খুঁজে বের করা হচ্ছে শেষ ৩০ দিন সে কোথায় কোথায় গেছে। সেই সেই জায়গায় গিয়ে কথা বলে তার সংস্পর্শে আসা মানুষজনকে দ্রুততার সঙ্গে কোয়ারান্টাইন করে দেওয়া হচ্ছে। এটা খুব সহজেই গুগ্ল ম্যাপ বা সার্ভার থেকে খুঁজে বের করা যায়। তাইওয়ান, চিন ও দক্ষিণ কোরিয়া ইতিমধ্যেই এই পদ্ধতিতে সফলভাবে বহু করোনা আক্রান্তকে খুঁজে পেয়েছে। ইউরোপে যেহেতু তথ্য গোপনীয়তার কড়াকড়ি আছে, জার্মানি ও ইতালি সেজন্য কোন ব্যক্তিবিশেষের মোবাইল এভাবে ট্র্যাক না করে সাধারন ভাবে খুঁজে নিচ্ছে লক-ডাউনের সময় কোন্ কোন্ পাবলিক প্লেসে একত্রে পাঁচ বা তার বেশি মোবাইলের সিগনাল পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে তৎক্ষণাৎ পুলিশ গিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।
৩) সিসিটিভি ভিডিওঃ কোনো করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি যদি কো্নো পাবলিক প্লেসে গিয়ে থাকেন, তাহলে সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে খতিয়ে বের করা হচ্ছে সে সম্ভাব্য কাকে কাকে সংক্রামিত করে থাকতে পারে। সেইসব মানুষজনকে খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করে তাদের কোয়ারান্টাইন করে করোনার টেস্ট করা হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সফল হয়েছে। এখানে বলা দরকার কেরলের কথাও। ভারতের প্রথম ছ’জন করোনা সংক্রামিতের তিনজন ছিলেন কেরলের। এক পরিবারের তিন সদস্য যারা সদ্য ইতালি ফেরৎ। তাদের সঙ্গে কথা বলে কেরল সরকার বোঝে তারা অনেক পাবলিক প্লেসে ঘুরেছে। সেই সমস্ত জায়গার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে কেরল সরকার অন্তত ৯০০ জনকে দ্রুততার সঙ্গে খুঁজে বের করে ও তাদের কোয়ারান্টাইন করে করোনা টেস্ট করে।
৪) রোবট ও ড্রোনঃ চিনের উহান প্রদেশ, যেখান থেকে এই কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎপত্তি, সেখানেই কিন্তু প্রথম রোবট ব্যবহার করে করোনা সংক্রামিত রুগীদের তাপমাত্রা মাপা, পরিচর্যা করা, ওষুধ খাওয়ান, খাবার দেওয়া, ডাক্তারের সঙ্গে রোবটের মাধ্যমে কথা বলা এমনকী রোবট দিয়ে পুরো হাসপাতাল সাফ পর্যন্ত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে একই পদ্ধতি অনুসরণ করে সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য কিছু দেশ। এখন বেঙ্গালুরুতেও নতুন করোনা রুগিদের সনাক্তকরণ ও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে।
পুলিশের তরফ থেকে রিমোট চালিত ছোট্ট ড্রোন আকাশে উড়িয়ে ভিড় শনাক্ত করা বা আড্ডারত মানুষদের সাবধান করা তো এখন আমরা ভারতের সব জায়গাতেই দেখতে পাচ্ছি। এর আরো কিছু ভালো প্রয়োগ করা হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য কয়েকটা জায়গায়। যেমন এই ড্রোন উড়িয়ে থার্মাল ক্যামেরার সাহায্যে চিনে খুঁজে বের করা হচ্ছে ভিড়ের মধ্যে কারো গায়ে জ্বর আছে কিনা। অথবা কেউ যদি মুখে মাস্ক না পরে রাস্তায় অনেকের মাঝে বেরিয়ে পড়ে, তাহলে মুখ সনাক্তকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে সেটা খুঁজে বের করে তাকে জরিমানা করা হচ্ছে। তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চিন, অনেকেই এযাবৎ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।
৫) মোবাইল অ্যাপঃ মোবাইল অ্যাপ হল এক বিশেষ সফট্অয়্যার অ্যাপ্লিকেশন যা দিয়ে মোবাইলের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট কাজ করা যায়। ধরা যাক, আমি ড্রোন ওড়াতে চাই। সেটার জন্য এক নির্দিষ্ট মোবাইল অ্যাপ থাকবে। আমি লোকাল ট্রেনের সময়সূচী চাই বা মোটর রেসিং খেলতে চাই বা ইউটিউব-এর ভিডিও দেখতে চাই, সবকিছুই এখন মোবাইল অ্যাপে পাওয়া যায়।
কোভিড-১৯ কে কব্জা করার জন্য মোবাইল অ্যাপ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে চিনের আলিবাবা (ভারতে যেমন মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স, চিনে তেমন জ্যাক মা-র আলিবাবা) জানুয়ারিতে সেখানে লক-ডাউনের পরেই এক অদ্ভুত অ্যাপ বের করেছে ‘আলিপে হেলথ কোড’ যা চিনের নাগরিকদের শেষ ছ’মাসের স্বাস্থ্য অবস্থা ও আন্তর্জাতিক বা আন্তঃরাজ্য যাত্রার ইতিহাস একত্রিত করে সেই অনু্যায়ী তাদের প্রত্যেককে একটা QR কোড ও রং দিচ্ছে। যারা এই অ্যাপে সবুজ রং পাচ্ছে, তারা পুলিশকে নিজের মোবাইলের অ্যাপ দেখিয়ে যে কোনো শপিং মল বা মেট্রো স্টেশন বা আন্তঃরাজ্য পরিবহনে যাবার সুযোগ পাচ্ছে। হলুদ রং মানে আরো ৭ দিন ঘরের ভেতর থাকতে হবে আর লাল রং মানে ১৪ দিন ঘরের ভেতর, সাথে সাথে করোনার একপ্রস্থ টেস্ট।
ভাবুন, শুধুমাত্র এই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে চিন বিভিন্ন প্রদেশে লক-ডাউন তুলে দিয়েছে এবং কোভিড-১৯ চিহ্নিত করতে আজ তারা সফল। এমনকী ‘সায়েন্স’ পত্রিকার মার্চ সংখ্যায় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এই অ্যাপের জন্য চিনকে বাহবা জানিয়েছে কারণ এই ডিজিটাল কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ স্বাস্থ্যকর্মীদের একেক সপ্তার কাজ কয়েক ঘন্টায় করে দিচ্ছে। যদিও এই অ্যাপ নিয়ে বেশ কিছু মানবতাবাদী সংস্থা ব্যক্তিস্বাধীনতা ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে। তাদের মতে এই অ্যাপ জনগনের তথ্য গোপনীয়তার পরিপন্থী এবং সরকার এটা নিজের ইচ্ছেমতো জনগনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সরকার সেইসব কথায় কান দেয়নি। তাদের মনে হয়েছে সমাজ ও জাতিকে বাঁচাতে গেলে এটা করতে হবে।
তাইওয়ানে তো অনেকদিন ধরে এই ব্যবস্থা চালু আছে। সরকারের কাছে এক বিশেষ সার্ভারে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্য ও যাত্রা সংক্রান্ত সমস্ত ইতিহাস রাখা থাকে। সেই তথ্য একত্রিত করে এই কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ওরা এত সুন্দর ব্যবহার করেছে যে সেখানে একদিনও লক-ডাউনের প্রয়োজন হয়নি। এমনকী, অনেক বিশেষজ্ঞ এটাও বলছেন যে আমেরিকা বা ইউরোপে করোনা সংক্রান্ত ভরাডুবির অন্যতম কারণ এই ইনফর্মেশন প্রাইভেসি বা তথ্য গোপনীয়তার বাড়াবাড়ি। সরকারের হাতে নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও যাত্রা সংক্রান্ত সমস্ত ইতিহাস থাকলে এই অতিমারির সময় অনেক ভালো ফল পাওয়া যেত।
যাইহোক, চিনের এই অ্যাপ দেখে দক্ষিণ কোরিয়া বের করেছে একটু অন্যরকম Corona 100m অ্যাপ যা সরকারি তথ্য থেকে পাওয়া যে কোনো করোনা সংক্রামিতের শেষ ৩০ দিনের যাত্রাপথ তুলে ধরছে এবং তার সাহায্যে ঐ অ্যাপ এইরকম কোনো পয়েন্টের ১০০ মিটারের ভেতর এলেই অ্যাপ ব্যবহারকারীকে সাবধান করতে থাকে।
ব্লু-টুথের সাহায্যে সিঙ্গাপুর এনেছে Trace Together অ্যাপ। সরকার সমস্ত নাগরিককে বলছে মোবাইলে ব্লু-টুথ অন করে রাখতে। কোনো মোবাইল আরেক মোবাইলের কাছাকাছি এলে দুটো মোবাইলেই অন্যের তথ্য জমা হয়ে যাচ্ছে। এবার কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হয়, তার মোবাইল ঘেঁটে সরকার সহজেই খুঁজে বের করে ফেলছে শেষ ১৪ দিনে কে কে তার কাছাকাছি এসেছিল।
অস্ট্রেলিয়াও একই রকম অ্যাপ ব্যবহার করছে। হংকং হোম কোয়ারান্টাইনে থাকা করোনা আক্রান্তদের জন্য তৈরি করেছে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি হাতের বালা যা সেই ব্যক্তি বাড়ি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করলেই পুলিশকে এক বিশেষ অ্যাপে সতর্ক করে দিচ্ছে।
ভারতেও করোনা মোকাবিলায় এক অ্যাপ ব্যবহার শুরু হয়েছে। সরকারের তরফে ন্যাশনাল ইনফর্মাটিক্স সেন্টার তৈরি করেছে ‘আরোগ্য-সেতু’ অ্যাপ। প্রথমেই আপনার নাম, বয়স, অবস্থান, মোবাইল নম্বর এইসব জানার পর আপনার এইসব তথ্য সরকারি সার্ভারে জমা হবে। তারপর শারীরিক কয়েকটা প্রশ্ন। আপনার জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট আছে কিনা। আপনি শেষ কয়েক মাস অন্য রাজ্যে বা বিদেশে গেছেন কিনা। সেই অনুযায়ী বলা হবে আপনি নিরাপদে আছেন নাকি সংক্রমনের আশঙ্কা আছে।
এছাড়াও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিভিন্ন সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা এখানে দেখানো হচ্ছে। আর ব্লু-টুথ ও অন্যান্যদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলে দেওয়া হবে আপনি কোনো সম্ভাব্য করোনা আক্রান্তের আশেপাশে আছেন কিনা। পুরোপুরি গ্রাহকের দেওয়া তথ্য নির্ভর অ্যাপ। একদম এইমুহুর্তে ইংল্যান্ডে ব্যবহৃত C-19 অ্যাপের মতো। অবশ্য ইউরোপ ও আমেরিকা এখন অ্যাপ্ল আর গুগ্ল কে যৌথ দায়িত্ব দিয়েছে তথ্য গোপনীয়তা বজায় রেখে কার্যকর একটা অ্যাপ বানানোর।
‘আরোগ্য-সেতু’ নিয়ে কয়েক কথা বলি। যদিও নেইমামার থেকে কানামামা ভাল, তবুও এই অ্যাপ নিয়ে আমার একটু অন্যরকম বক্তব্য আছে। প্রথমত, ভারতে এই মুহুর্তে প্রায় ৪৫ কোটি 2G মোবাইল ফোন, ১২ কোটি 3G ফোন ও ৪৩ কোটি 4G ফোন রয়েছে। অর্থাৎ 2G ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবথেকে বেশি। ঠিক সেই কারণেই এখনো অব্ধি ভারতের প্রায় ৫ লাখ মোবাইল টাওয়ারের প্রায় সবকটাতেই 2G-3G-4G অ্যান্টেনা মিশে থাকে। আরোগ্য-সেতু অ্যাপ কেবলমাত্র 4G ফোন ব্যবহারকারীদের জন্য। সেক্ষেত্রে, যারা 2G বা 3G ফোন ব্যবহার করে (এবং সেই সংখ্যাটাই বেশি), তাদের কী হবে?
পরিশেষে বলি, এখন আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাই এখন দরকার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও আস্তে আস্তে প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে জনজীবন স্বাভাবিক করা। সাধারণ জনগনকে সচেতন ও বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলে তাদের বোঝানো যে আগামী এক-দেড় বছর করোনার বিরুদ্ধে আমাদের এভাবেই সাবধানে এগোতে হবে। আমাদের দেশে দক্ষ প্রযুক্তিবিদের অভাব নেই। আই-আই-টি, এন-আই-টি, ট্রিপল-আই-টি, নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই। এই তো সঠিক সময়, সরকারিভাবে এই দক্ষতাকে মানুষ ও সমাজের মঙ্গলের কাজে লাগানোর।
অভিজিৎ মিত্র: লেখক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং আই-আই-টি গুয়াহাটির প্রাক্তন অধ্যাপক। প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক, IIT গুয়াটি