হরধনু ভাঙনের বিজ্ঞান
হরধনু ভাঙনের বিজ্ঞান
সুজিতকুমার নাহা
হরধনু কেন দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল তার সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক কারণ জানাতে বসে প্রথমেই মনে পড়ল রমেন স্যারের কথা। চেনা-জানা উদাহরণ সহযোগে আলাপচারিতার ভঙ্গিতে স্যার ভৌতবিজ্ঞান পড়াতেন, তাই বিষয়টা বোধের পরিধিতে ঢুকে পড়ত সহজেই । শক্তি (এনার্জি) প্রসঙ্গে স্যার একবার বলেছিলেন, ‘তোদের সেই ভয়ংকর জিনের গল্পটা মনে আছে তো ? কাজ করতে না দিলেই যে যেত ভীষণ চটে । সঞ্চিত এনার্জির হাবভাব অনেকটা সেই দানোটার মতোই। ঠিকভাবে চালনা করলে চটপট সব কাজ করে দেবে, নইলে কিন্তু হতে পারে সমূহ বিপদ !‘ ধূসর অতীতে স্যারের বক্তব্য এতদিন বাদে সহসা মনে পড়ার হেতু অবশ্যই আছে । সুপ্রিয় পড়ুয়া, কারণটা জানতে আগ্রহ হচ্ছে কী ? তাহলে সবকিছু বরং খোলসা করেই বলি।
আমার ধারণা, হরধনুর বেলাতেও সঞ্চিত শক্তির ‘দৈত্য’ তার নির্ধারিত কাজ করতে না পেরে ‘প্রচণ্ড আক্রোশে’ ভেঙ্গে দিয়েছিল গোটা ধনুকটাকেই ! কীভাবে ঘটেছিল সেই আশ্চর্য কাণ্ডটা ? জানতে হলে প্রথমেই পরিজ্ঞাত হতে হবে ধনুক নামক সুপ্রাচীন অস্ত্রটির রীতিচরিত্র ও কর্মপদ্ধতির সাথে।
দক্ষতার (এফিসিয়েন্সি) বিবেচনায় মান্ধাতার আমলের ধনুক সহজেই টেক্কা দেবে আধুনিক কালের রাইফেলকেও। আশ্চর্য মনে হলেও কথাটা কিন্তু নির্ভেজাল সত্যি। উন্নত মানের একটি ধনুক প্রাপ্ত শক্তির নব্বই শতাংশেরও বেশি ভাগকে শরক্ষেপণের কাজেই ব্যবহার করে । অপচয়িত হয় দশ শতাংশেরও কম ভাগ । তুলনায় একটি রাইফেল প্রাপ্ত শক্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশের মতো ভাগকেই কাজে লাগায় বুলেটকে গতিশীল করার জন্য । বাকী প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই অপচয় হয় ।
ধনুকে তির ছোঁড়ার ক্রিয়াবিধি
ধনুকে তির ছোঁড়ার ক্রিয়াবিধি (মেকানিজম) এবার আমরা খুব সংক্ষেপে জেনে নেব। তিরের গোড়ার খাঁজটাকে (nock) ছিলায় বসিয়ে সেটিকে সজোরে টেনে আনা হয়। এর ফলে ছিলা ইংরেজি V অক্ষরের মতো চেহারা নেয় এবং ধনুকের বাহুদ্বয় চলে আসে পরস্পরের কাছে। ধনুকের এই বিকৃতির (deformation) ফলশ্রুতিতে ধনুর্ধারীর পেশিশক্তি রূপান্তরিত হয় ধনুকের স্থিতিশক্তিতে। অত:পর তিরসমেত ছিলাকে ছেড়ে দিলে ধনুকের স্থিতিশক্তির সিংহভাগই (90% বা তার বেশি) পালটে যায় তিরের গতিশক্তিতে। স্থির অবস্থা থেকে কয়েক মুহূর্তেই ঘন্টায় প্রায় 100 মাইল বেগে তিরটি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ধনুকের স্থিতিশক্তির অবশিষ্ট অংশ (10% বা তার কম) ধনুকে বারকয়েক মৃদু ঝাঁকুনির সৃষ্টি করার পর ধনুক ফিরে আসে স্বাভাবিক, অবিকৃত আকারে।
তির ছোঁড়ার তালিম নেওয়ার জন্য তিরন্দাজি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হলে প্রথম ক্লাসেই প্রশিক্ষক প্রায় পাখি পড়ানোর স্টাইলে শিক্ষার্থীকে জানিয়ে দেন, ছিলায় তির না লাগিয়ে সে যেন কখনও ধনুক না চালায়। এমন ভুল কাজ করে বসলে শুধু যে ধনুকটির ভাঙন প্রায় অবধারিত তাই নয়, সে নিজেও পেতে পারে মারাত্মক চোট ।
তিরহীন ধনুক চালনা
তিরহীন ধনুক চালনাকে ইংরেজিতে বলা হয় Dry firing । বাংলায় এর কোনো প্রতিশব্দ নেই। আজ যখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসেছি, একটা লাগসই প্রতিশব্দ আমরাই বরং বানিয়ে ফেলি। পরবর্তীতে ‘শরহীন ধনুসঞ্চলন’ শব্দবন্ধটিকেই আমরা Dry firing-এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করব।
ধনুক, ধনুর্ধারী, এমনকী আশপাশের লোকের জন্যও শরহীন ধনুসঞ্চলন কেন এত বিপজ্জনক ? আসলে, শর বিহনে ধনুকের স্থিতিশক্তি ধনুক ছেড়ে বেরোনোর কোনো উপায় না পেয়ে ‘আক্রমণ’ করে বসে ধনুকটাকেই ! প্রচণ্ড শব্দে শক্তির সুনামি ধনুকের ওপর আছড়ে পড়ে সৃষ্টি করে সুতীব্র কম্পন। কম্পনের বিস্তার এত বেশি যে ধনুর্ধারীরও আশঙ্কা থাকে ধাক্কা লেগে আহত হওয়ার। বড়োই ভয়ঙ্কর সেই কম্পন সামাল দেওয়া প্রায় কোনো ধনুকের পক্ষেই সম্ভব না হওয়ায় প্রায়শই ধনুকটি যায় ভেঙে। ভাঙা ধনুকের টুকরো-টাকরা ভীমগতিতে ধাবিত হয়ে আঘাত হানতে পারে ধনুর্ধারী ও আশপাশের লোকদের।
রামচন্দ্র হরধনুতে গুণ পরিয়েই ক্ষান্ত হলে অক্ষতই থাকত হরধনু। তাঁর শরহীন ধনুসঞ্চলনের ফলশ্রুতিতেই সম্ভবত দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল জনকরাজের সংগ্রহে থাকা প্রকাণ্ড সেই শিবের ধনুক !